নামাজের নিষিদ্ধ সময়ের সাথে চৌম্বকক্ষেত্রের সম্পর্ক নিয়ে বিভ্রান্তিকর দাবি

Published on: October 3, 2022

সূর্য এবং পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রের কারণে মানব দেহের সম্ভাব্য ক্ষতির ব্যাপারে একটি পোস্ট ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। এখানে দাবি করা হয়েছে,দিনের নির্দিষ্ট কিছু সময়ে নামাজ পড়লে সূর্য ও পৃথিবীর ওই সময়কার ম্যাগনেটিক ফিল্ড বা চৌম্বক ক্ষেত্রের  কারণে মানবদেহের ক্ষতি হবে। তবে ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে এই দাবির কোনো সত্যতা মেলেনি। নির্দিষ্ট কিছু সময়ের জন্য নয়, বরং চৌম্বকীয় বস্তুর চৌম্বক ক্ষেত্র সবসময়েই কার্যকর থাকে।

গুজবের উৎস

ভাইরাল হওয়া এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে,এখানে,এখানে,এখানে,এখানে


পুরো পোস্টটি পড়ুন এখানে-

ছোট থেকে আমার ব্রেনে সবসময় ঘুরতকেন নামাযের নিষিদ্ধ সময় আছে

অনেক খুজাখুজির পর যা উত্তর পেলাম!!

সূর্য সহ মহাজাগতিক সবকিছুতে থাকে কসমো ম্যা্গনেটিক ফিল্ড, আমাদের পৃথিবীতে আছে জিওম্যা্গনেটিক ফিল্ড, আর আমাদের শরীরে আছে বায়ো ম্যা্গনেটিক ফিল্ড। সিজদাই এসব ম্যা্গনেটিক ফিল্ড এর ক্রিয়া ঘটে, ফলে যদি শরীরে বিশেষ করে ব্রেন যেটা ঠিক কপালের পিছনে থাকে (একে ফ্রন্টাল লোব বলে এবং তা দেহের বৃদ্ধি আবেগ নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র) তাতে কোন আধান ঘাটতি( হতাশা) বা আধিক্য( উত্তেজনা) থাকলে সেটা পুরণ বা নিস্ক্রিয় করে দেয়। ফলে আমরা দীঘক্ষন সেজদা করার পর মাথা খুব হালকা আর মনে প্রশান্তি অনুভব করি। কিন্তু যখন সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত সূর্য যখন ঠিক মাথার উপরে থাকে তখন কসমো ম্যা্গনেটিক ফিল্ড জিও ম্যা্গনেটিক ফিল্ড (সূর্যের কাছে দূরের অবস্থানের কারণে) বায়ো ম্যা্গনেটিক ফিল্ডের ক্ষতি হবে এমন অবস্থায় থাকে। তাই তখন দীঘক্ষন সিজদা করলে মেজাজ খিটখিটে, ক্লান্তি আর মাথা ঘুরা ভাব লাগে। তাই দিনের এই তিন সময়েই নামায পড়া নিষিদ্ধ বা হারাম বলা হয়েছে।

রেফারেন্স বইসিজদাহর বিজ্ঞান ( জিয়াঊল হক)’


একটি পোস্টে সূর্যের অবস্থান , নামাজের ওয়াক্ত এবং একটি ঘড়ির সময় দেখিয়ে একটি গোল ডায়ালে বিভিন্ন রঙের বিন্যাস দেখানো হয়েছে। তবে এই রঙগুলো দিয়ে কি নির্দেশ করে , তা বলা হয়নি। কাজেই সম্পূর্ণ ডায়াগ্রামটি কোনো অর্থ তৈরি করতে পারেনি।

ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানঃ

সিজদাহর বিজ্ঞান  ও জিয়াউল হক

জিয়াউল হক একজন লেখক । বিভিন্ন বইয়ের ওয়েবসাইটে তার ২০টিরও বেশি বই এর কথা জানা যায়।

বই বিক্রির ওয়েবসাইট রকমারি ডট কমের লেখক পরিচিতিতে জিয়াউল হক সম্পর্কে লেখা হয়েছে-

মেন্টাল হেলথ্ নার্সিং, মেন্টাল হেলথ, সাইকিয়াট্রিক রিহাবিলিটেশন পড়াশোনা করেছেন তিনি। সর্বশেষ ইংল্যান্ডের ব্রিস্টল ইউনিভার্সিটি থেকে মেন্টাল হেলথ, ইএমআই ডিমেনশিয়া ম্যানেজমেন্ট কোর্স শেষ করে ইংল্যান্ডেরই একটি বেসরকারি মেন্টাল হাসপাতালের ডেপুটি ম্যানেজার ক্লিনিকাল লিড হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এখন লেখালিখিতেই ব্যস্ত।

এছাড়া, তার মন ও মানসিক স্বাস্থ্য বইটায় ‘লেখকের কথা’ অংশে তিনি লিখেছেন, আমি অতি সাধারণ মানুষ, কোনো বিশেষজ্ঞ নই।

জিয়াউল হক এর আনভেরিফাইড ফেসবুক একাউন্ট থেকেও তার একাডেমিক লেখাপড়া সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া সম্ভব হয়নি।

কাজেই এসব আলোচনা থেকে নিশ্চিত হওয়া যায়, জিয়াউল হক  কোনো পদার্থবিজ্ঞানী নন, কিংবা ইলেক্ট্রিসিটি বা ম্যাগনেটিজম তার দক্ষতার বিষয় নয়।

কিছুদিন পূর্বে ডেল্টা স্লিপ নিয়ে একটি গুজব ভাইরাল হয়েছিল। অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, ডেল্টা স্লিপ গুজবের প্রবক্তা জিয়াউল হক এবং সিজদাহ’র বিজ্ঞান এর লেখক জিয়াউল হক একই ব্যক্তি।

ডেল্টা স্লিপ সম্পর্কিত গুজবে অনেক ফেসবুক ব্যবহারকারী তাকে ডা. (ডাক্তার) হিসেবে উল্লেখ করলেও ফ্যাক্টওয়াচ নিশ্চিত হয়েছে, জিয়াউল হক এর কোনো এমবিবিএস বা সমতুল্য ডিগ্রি নেই।

(ডেল্টা স্লিপ নিয়ে ফ্যাক্টওয়াচ এর ফ্যাক্টচেকিং রিপোর্টটি দেখুন এখানে )

ম্যাগনেটিক ফিল্ড কি ?

ম্যাগনেটিক ফিল্ড এর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে ব্রিটানিকা বলছে, magnetic field, a vector field in the neighbourhood of a magnet, electric current, or changing electric field, in which magnetic forces are observable. (ম্যাগনেটিক ফিল্ড হল কোনো চুম্বক বা বিদ্যুৎ বর্তনীর আশেপাশে তৈরি হওয়া একটি নির্দিষ্ট জায়গা, যেখানে চৌম্বক শক্তি দেখা যায়)

ব্যাপারটাকে তুলনা করা যেতে পারে আরব্য রজনীর কল্পকাহিনীর সাথে। আরব্য রজনী বা আলিফ লায়লার বিভিন্ন দৃশ্যে যেমন দেখা যায়, জাদুকর তার জাদুর কার্যকর ক্ষমতা পর্যন্ত একটা বৃত্ত একে দেয়। এই বৃত্তের মধ্যে তার যাদু কাজ করবে, কিন্তু বৃত্তের বাইরে আর কাজ করবে না।

ম্যাগনেটিক ফিল্ড ও সেইরকম জিনিস। কোনো চুম্বক ( বা চৌম্বকীয় পদার্থ) এর আশেপাশের কিছু এলাকায় থাকা অন্য বস্তুকে  চৌম্বকীয় বলে আকর্ষণ করতে পারে। কিন্তু এই এরিয়ার বাইরের কোনো বস্তুকে সে আকর্ষণ করতে পারেনা ৷ যে জায়গার মধ্যে আকর্ষণ কাজ করবে,  সেই জায়গাটুকুকে বলে ওর ম্যাগনেটিক ফিল্ড।   ( আলিফ লায়লার সাথে তুলনা করলে- ম্যাগনেটিক ফিল্ড এর মধ্যে যাদুকরের যাদু কাজ করবে, এর বাইরে কাজ করবে না।)

এই ম্যাগনেটিক ফিল্ড এর মধ্যে কোনো চুম্বক কণা, বা চার্জিত পার্টিকেল এসে পড়লে সে ম্যাগনেটিক ফিল্ড এর কারণে একটি বল অনুভব করবে।

কিন্তু অন্য কোনো বস্তু ওই ফিল্ড-এর মধ্যে চলে আসলে সে কোনো বল অনুভব করবে না।

(কিছুদিন আগে একটি গুজব ভাইরাল হয়েছিল, যেখানে দাবি করা হচ্ছিল, রেল লাইনে ট্রেন চলন্ত অবস্থায় পুরো লাইনে ম্যাগনেটিক ফিল্ড তৈরি হয় এবং লাইনে কোনো মানুষ পার হওয়ার চেষ্টা করলে এই ম্যাগনেটিক ফিল্ড আটকে রাখে। ব্যাপারটা সত্য নয়। এমন কোনো ম্যাগনেটিক ফিল্ড এখানে তৈরি হয় না, এবং মানব শরীর কে ম্যাগনেটিক ফিল্ড এভাবে আটকে রাখতে পারে না। বিস্তারিত দেখুন ফ্যাক্টওয়াচ এর এই প্রতিবেদনে )

আলোচ্য পোস্টে কসমো ম্যাগনেটিক ফিল্ড, জিও ম্যাগনেটিক ফিল্ড এবং বায়ো ম্যাগনেটিক ফিল্ড শব্দগুলো ব্যবহার করা হয়েছে। এই শব্দগুলো বোঝার চেষ্টা করি।

Geomagnetic Field বলতে বোঝায় আমাদের পৃথিবীর কেন্দ্রের ম্যাগনেটিক ফিল্ড টা। পৃথিবীর কেন্দ্রে গলিত কঠিন ধাতুর স্তর এর প্রভাবে পৃথিবী উত্তর -দক্ষিণ বরাবর একটি বিরাট দণ্ড চুম্বকের মত আচরণ করে। এর প্রভাবে যেকোনো দন্ড চুম্বক সর্বদা উত্তর-দক্ষিণ বরাবর অবস্থান করে। এই ধর্ম কাজে লাগিয়ে কম্পাস তৈরি করা হয় এবং উত্তর দিক সনাক্ত করা হয়।

যেহেতু উত্তর দক্ষিণ দিকে পৃথিবীর ম্যাগনেটিক ফিল্ড এর শক্তি বেশি থাকে, তাই এই দুই অঞ্চলে মহাকাশ থেকে আসা চার্জিত কণাগুলো জমা হয়, এবং বায়ুমন্ডলে সেগুলো উজ্জ্বল বিচিত্র বর্ণ দেখায় । একে অরোরা বা মেরুজ্যোতি বলে।

পৃথিবীর বাইরের অন্যান্য গ্রহ নক্ষত্রের ম্যাগনেটিক ফিল্ডকে সাধারণভাবে কসমিক ম্যাগনেটিক ফিল্ড বলা হয়। একেক গ্রহ নক্ষত্রের ম্যাগনেটিক ফিল্ড একেক রকম। বৃহস্পতির ম্যাগনেটিক ফিল্ড খুবই শক্তিশালী। অন্যদিকে চাঁদ,শুক্র কিংবা বুধ এর ম্যাগনেটিক ফিল্ড খুবই দুর্বল। নেই বললেই চলে।

(আলোচ্য পোস্টে কসমো ম্যাগনেটিক ফিল্ড  বলা হলেও ঠিক এই নামে কোনো পরিভাষা খুজে পাওয়া যায়নি। অনুমান করি, কসমিক ম্যাগনেটিক ফিল্ডকেই সম্ভবত কসমো ম্যাগনেটিক ফিল্ড বলে উল্লেখ করা হয়েছে)

মানুষ কিংবা অন্যান্য প্রাণীর শরীরের বিভিন্ন কোষের মধ্যেও চার্জিত কণা থাকে। এর কারণে প্রাণীদেহেও ম্যাগনেটিক ফিল্ড তৈরি হয়। তবে এটা খুব দুর্বল ম্যাগনেটিক ফিল্ড।

যদি তুলনা করতে যাই, তাহলে দেখা যাবে, পৃথিবীর ম্যাগনেটিক ফিল্ড এর পরিমাণ ২৫ হাজার থেকে ৬৫ হাজার ন্যানো টেসলা (বিষুব অঞ্চলে ৩০,৫০০ ন্যানো টেসলা, বা ০.৩০৫*১০e-৪ টেসলা)। সেখানে চাঁদের মাটিতে সর্বোচ্চ ম্যাগনেটিক ফিল্ড পাওয়া গিয়েছে ৩১০ ন্যানো টেসলা। অন্যদিকে মানবদেহের হৃদপিণ্ডের ম্যাগনেটিক ফিল্ড মাত্র ১০*e-১১ থেকে ১০*e-১৪ টেসলা (০.০০০০১ ন্যানো টেসলা থেকে ০.০১ ন্যানো টেসলা) এবং মানব মস্তিষ্কের ম্যাগনেটিক ফিল্ড গড়ে ৩০০ ফ্যামটোমিটার (০.৩ ন্যানোমিটার) । ১৯৮০ সালের অপর এক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, মানবদেহের গড় ম্যাগনেটিক ফিল্ড ১০e-৯ থেকে ১০e-১৪ টেসলা।

ম্যাগনেটিক ফিল্ড বা চৌম্বুকক্ষেত্র কি আমাদের শরীরে কোন বিরুপ  প্রতিক্রিয়া তৈরি করে?

MRI বা এই ধরনের কোনো মেশিনে যখন কোনো রোগীকে টেস্ট করানো হয় , তখন রোগীকে শক্তিশালী ম্যাগনেটিক ফিল্ড এর সামনে আনা হয়। এম আর আই মেশিন এ ব্যবহৃত ম্যাগনেট  থেকে  সাধারণত ০.৫ টেসলা এবং ৩ টেসলা-এই রেঞ্জের ম্যাগনেটিক ফিল্ড তৈরি হয়।  যা পৃথিবীর ম্যাগনেটিক ফিল্ডের চেয়ে ৩০,০০০ গুণ বেশি। যদি মেডিকেল স্ক্যানারের ম্যাগনেটিক ফিল্ড পৃথিবীর ম্যাগনেটিক ফিল্ড এর চেয়ে ১০০,০০০ গুণ বেশি হয়, তখন রোগীর বমি বমি ভাব, অবসন্নতা এবং মুখের মধ্যে ধাতব স্বাদ লাগতে পারে। তবে এটা সাময়িক।

 

পৃথিবীতে কিছু প্রাণী খাবার খুঁজতে কিংবা ভ্রমণে দিক ঠিক রাখতে পৃথিবীর জিও ম্যাগনেটিক ফিল্ডের ব্যবহার করে থাকে। এইসব প্রাণী পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র অনুভব করতে পারে। (যেমন-কবুতর এবং বিভিন্ন প্রজাতির অতিথি পাখি)। কিন্তু মানুষের কোনো ইন্দ্রিয় এভাবে পৃথিবীর চৌম্বুকক্ষেত্র অনুভব করতে পারে না।

তবে ২০২২ সালের ৩০শে মে স্বীকৃত জার্নাল নেচারে প্রকাশিত একটি রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে, মানুষের ইন্দ্রিয়গুলো চৌম্বুকক্ষেত্রের প্রতি সাড়া দেয়।

নেচারের রিপোর্টটি দেখুন এখানে

তাহলে চৌম্বুকক্ষেত্র কি আমাদের শরীরে বিরূপ কোন প্রতিক্রিয়া তৈরী করতে পারে?

কয়েক যুগ আগে আমেরিকায় ইলেকট্রিক এবং ম্যাগনেটিক ফিল্ড নিয়ে বিজ্ঞানী এবং সরকারী কর্মকর্তাদের ভিতর বিতর্ক শুরু হয়েছিল যা জনসাধারণের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাড়ায়। এজন্য কংগ্রেস ১৯৯১ সালে ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্স (নাসা)-এ প্রকাশিত গবেষণাগুলোকে পুনঃমূল্যায়ন করতে বলে। মানুষের শরীরে চৌম্বুকক্ষেত্রের প্রভাব নিয়ে গবেষণার এই কাজে ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সের সাথে ইউএস ডিপার্টমেন্ট অফ এনার্জিও যোগ দেয়।

ন্যাশনাল একাডেমি একাডেমি অব সায়েন্স এবং ইউএস ডিপার্টমেন্ট অফ এনার্জি সম্মিলিতভাবে মানুষের কোষ, টিস্যু, এবং অর্গানিজমের উপর ইলেকট্রিক এবং ম্যাগনেটিক ফিল্ডের প্রভাবের উপর করা গবেষণাগুলোর মূল্যায়ণ শুরু করে। তাদের মূল্যায়ণে ম্যাগনেটিক ফিল্ড মানবস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ — এমন কোন আলামত পায়নি। ন্যাশনাল একাডেমি একাডেমি অব সায়েন্স এবং ইউএস ডিপার্টমেন্ট অফ এনার্জি-র করা মূল্যায়ণে তারা বৈদ্যুতিক এবং চৌম্বুকক্ষেত্র ক্যান্সার সৃষ্টি করে, মস্তিষ্কে আচরণগত সমস্যা সৃষ্টি করে,অথবা প্রজনন এবং মানববৃদ্ধি জনিত কোন বাধা সৃষ্টি করে– এমন কোন প্রমাণ পায়নি।

রিপোর্টটি দেখুন এখানে

তাছাড়া ইউনাইটেড স্টেট জিওলজিক্যাল সার্ভের ওয়েবসাইটেও বলা হচ্ছে পৃথিবীর চৌম্বুকক্ষেত্র সরাসরি মানুষের স্বাস্থ্যের উপর কোন প্রভাব ফেলে না। মানুষ এটার সাথে মানিয়ে নিয়ে এভাবেই এই গ্রহে বসবাসের জন্য বিবর্তিত হয়েছে। যদিও অনেক উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া পাইলট এবং নভোচারীরা চৌম্বকীয় ঝড়ের সময় উচ্চ স্তরের বিকিরণ অনুভব করতে পারেন। তবে বিপত্তিটি চৌম্বক ক্ষেত্রের কারণে নয়, বরং বিকিরণের কারণে হয়।

ইউনাইটেড স্টেট জিওলজিক্যাল সার্ভের ওয়েবসাইটের লেখাটি পড়ুন এখানে

 

উক্ত আলোচনায় এটা পরিষ্কার  ভূ-চৌম্বকক্ষেত্র বা জিও ম্যাগনেটিক ফিল্ড আমাদের দেহে কোন প্রভাব ফেলতে পারে না।

 

ফ্রন্টাল লোব কি দেহের আবেগ এবং বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করে?

 

ভাইরাল পোস্টে দাবি করা হয়, ফ্রন্টাল লোব দেহের বৃদ্ধি ও আবেগের নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র। তবে হেলথলাইন থেকে জানা যাচ্ছে  লিম্বিকতন্ত্রই মূলত মানুষের আবেগ নিয়ন্ত্রণের কাজটি করে থাকে। আবেগ নিয়ন্ত্রণে ফ্রন্টাল লোব এরও ভুমিকা আছে, তবে তার প্রধান কাজ দৈহিক কর্মকাণ্ড, ভাষা, মনোযোগ, স্মৃতি, পরিকল্পনা করা ইত্যাদি।

 

অন্যদিকে মানুষের বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করে মস্তিস্কে থাকা পিটুইটারি গ্রন্থিপিটুইটারি গ্রন্থি মানব মস্তিষ্কের খুবই ছোট একটি গ্রন্থি যার কাজ হরমোন উৎপন্ন করা এবং সরবরাহ করা।

 

সূর্যোদয়-সূর্যাস্তের সময় কি সূর্য দূরে অবস্থান করে?

 

ভাইরাল পোস্টে বলা হয়েছে সূর্য দূরে বা কাছে থাকার কারণে সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত এবং সূর্য মাথার উপর থাকার সময় কসমো-ম্যাগনেটিক ফিল্ড এবং জিও-ম্যাগনেটিক ফিল্ড বায়ো ম্যাগনেটিক ফিল্ডকে ধ্বংস করে দেয়।

একটু গাণিতিক হিসাবে আসা যাক। পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে সূর্যের গড় দূরত্ব হল ১৪৯,৫৯৭,৮৭০.৭ কিলোমিটার। এই দূরত্বকে এক এ্যাস্ট্রনোমিকাল ইউনিট (AU) বলে ।

অন্যদিকে, আমরা জানি, পৃথিবীর ব্যাসার্ধ ৬৩৭১ কিলোমিটার।

তাহলে, বিষুবীয় অঞ্চলে অবস্থিত কোনো পর্যটকের থেকে ঠিক দুপুর বেলা সূর্যের দূরত্ব হবে, ১৪৯,৫৯৭,৮৭০.৭-৬৩৭১=১৪৯,৫৯১,৪৯৯.৭ কিলোমিটার।

আবার ঠিক মধ্যরাতে, যখন সূর্য প্ররথিবীর ঠিক অপর পাশে থাকবে, তখন তার নিকট থেকে সূর্যের দূরত্ব হবে  ১৪৯,৫৯৭,৮৭০.৭+৬৩৭১=১৪৯,৬০৪,২৪১.৭ কিলোমিটার।

আবার সূর্যাস্ত কিংবা সূর্যোদয়ের সময় সূর্য থেকে তার দূরত্ব হবে ১৪৯,৫৭৯,৮৭০.৮ কিলোমিটার (পীথাগোরাস এর সমকোণী ত্রিভুজের সূত্র প্রয়োগ করে)।

দেখা যাচ্ছে, এই দূরত্বের পার্থক্য খুব বেশি নয়। নির্দিষ্ট এক দিনে সকাল বিকাল রাত সবসময়েই দূরত্ব ১৪৯ মিলিয়ন কিলোমিটার এর মধ্যেই থাকছে।

অর্থাৎ, পৃথিবীর আহ্নিক গতির কারণে সূর্য থেকে দূরত্বের খুব সামান্যই পার্থক্য ঘটে।

তবে বার্ষিক গতির জন্য সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্বের বড় ধরনের পার্থক্য ঘটে। যেহেতু পৃথিবী উপবৃত্তাকার পথে সূর্যকে কেন্দ্র করে আবর্তন করে, তাই উপবৃত্তাকার পথে আবর্তনের কারণে কখনো পৃথিবী সূর্যের কাছে চলে যায়, কখনো দূরে সরে যায়। ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে পৃথিবী সূর্যের সব থেকে কাছে থাকে অন্যদিকে জুন-জুলাই মাসে পৃথিবী সূর্যের থেকে সব থেকে দূরে অবস্থান করে। জানুয়ারি মাসে এই দুরত্ব থাকে  সর্বনিম্ন ১৪৭ মিলিয়ন কিলোমিটার এবং জুলাই মাসে এই দূরত্ব থাকে সর্বোচ্চ ১৫২ মিলিয়ন কিলোমিটার।

এক্সপ্লেইনিং সায়েন্সের রিপোর্টটি পড়ুন এখানে

একটি ম্যাগনেটিক ফিল্ড কি আরেকটি ম্যাগনেটিক ফিল্ড ধ্বংস করতে পারে?

একটি ম্যাগনেটিক ফিল্ডের মধ্যে যদি আরেকটি ম্যাগনেটিক ফিল্ডকে আনা হয় (যেমন, একটি দণ্ড চুম্বকের চৌম্বক ক্ষেত্রের মধ্যে আরেকটি দণ্ড চুম্বক আনা হলে) দু’টি চুম্বকের মেরুর উপর নির্ভর করে এদের ম্যাগনেটিক ফিল্ড আরো শক্তিশালী হবে, অথবা দুর্বল হবে।

আমরা জানি,  যখন চৌম্বুকের দুইটি বিপরীতমেরু কাছে আনা হয় তখন চৌম্বকক্ষেত্র একে অপরকে আকর্ষণ করে অন্যদিকে যখন সমমেরু কাছে আনা হয় তখন চৌম্বকক্ষেত্র একে অপরকে বিকর্ষণ করে।

সেক্ষেত্রে , সমক্ষমতাসম্পন্ন দু’টি দণ্ড চুম্বককে একে অপরের নিকটে বিপরীত দিক থেকে আনা হলে তাদের ম্যাগনেটিক ফিল্ড আরো বড় হবে । এবং তাদেরকে বিপরীত মেরুর দিক থেকে কাছাকাছি আনা হলে তাদের ম্যাগনেটিক ফিল্ড একে অপরকে বিকর্ষণ করবে।

এইরকম কয়েকটি বিন্যাস নিচে ছবির মাধ্যমে দেখানো হল।

ব্রাইটস্ট্রোমের ওয়েবসাইটে এই আলোচনা দেখুন এখানে-

তবে একটি বড় চুম্বকের ম্যাগনেটিক ফিল্ড এর মধ্যে অন্য একটি ছোট চুম্বক খুব সহজেই অবস্থান করতে পারে । এক্ষেত্রে ছোট চুম্বকের ম্যাগনেটিক ফিল্ড বজায় থাকে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বিশাল পৃথিবীর ভূ-চৌম্বক ক্ষেত্রের মাঝেই অন্য সকল দণ্ড চুম্বক ঠিকঠাকমত অবস্থান করছে। এদের কারো ম্যাগনেটিক ফিল্ড নষ্ট হয়নি। পৃথিবী পৃষ্ঠে সকল চুম্বকই তাদের ক্ষমতা দেখাচ্ছে, এবং তাদের নিয়ে বিভিন্ন ট্রিকও দেখানো সম্ভব হচ্ছে।

এছাড়া, মানব শরীরের বায়ো ম্যাগনেটিক ফিল্ড যেটা পরিমাপ করা হয়েছে, (১০e-৯ থেকে ১০e-১৪ টেসলা) সেটা পৃথিবীর ম্যাগনেটিক ফিল্ডের মধ্য থেকেই পরিমাপ করা হয়েছে।

আবার , পৃথিবী, চাঁদ বা অন্যান্য গ্রহের যে ম্যাগনেটিক ফিল্ড পরিমাপ করা হয়েছে, সেটা সূর্যের ম্যাগনেটিক ফিল্ডের মধ্য থেকেই পাওয়া গিয়েছে। সূর্যের বিশাল কসমিক ম্যাগনেটিক ফিল্ড এর মধ্যে অবস্থান করেই পৃথিবী তার নিজস্ব ম্যাগনেটিক ফিল্ড ধরে রেখেছে।

মূল পোস্টের দিকে নজর দেওয়া যাক। এখানে দাবি করা হয়েছে, যখন সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত ও সূর্য যখন ঠিক মাথার উপরে থাকে তখন কসমো ম্যা্গনেটিক ফিল্ড ও জিও ম্যা্গনেটিক ফিল্ড (সূর্যের কাছে দূরের অবস্থানের কারণে) বায়ো ম্যা্গনেটিক ফিল্ডের ক্ষতি হবে এমন অবস্থায় থাকে। তাই তখন দীর্ঘক্ষন সিজদা করলে মেজাজ খিটখিটে, ক্লান্তি আর মাথা ঘুরা ভাব লাগে।

উপরের আলোচনায় দেখানো হয়েছে, কসমিক কিংবা জিও ম্যাগনেটিক ফিল্ড তাত্ত্বিকভাবে মানবদেহের বায়ো ম্যাগনেটিক ফিল্ডের কোনো ক্ষতি করতে পারে না।

এছাড়া, মানবদেহের ম্যাগনেটিক ফিল্ড এর ক্ষতি হলে মূল মানবদেহের সমস্যা হবে কেন ( মেজাজ খিটখিটে, ক্লান্তি ,মাথা ঘোরা), সেটা বোধগম্য নয়।

সিজদায় কি কসমিক, জিও এবং বায়ো ম্যাগনেটিক ফিল্ড এর ক্রিয়া ঘটে ?

পদার্থের চুম্বকত্ব ধর্মটা সব সময়, সব জায়গাতেই কাজ করে। এমনকি যেখানে অভিকর্ষ বল নেই, সেখানেও কাজ করতে পারে।

পৃথিবী নামক বিশাল দণ্ড চুম্বক এর মধ্যে অন্য ক্ষুদ্র চুম্বক যখন যে অবস্থাতেই থাকুক না কেন, তার উপর ভূ-চুম্বক এর প্রভাব পড়বেই। এই প্রভাবের ফলে সে সর্বদা উত্তর-দক্ষিণে মুখ করে থাকতে চায়।

তেমনিভাবে , মানবদেহের মধ্যে যে সকল চার্জিত আধান রয়েছে, তাদের উপরেও ভূ-চুম্বক এর একই ধরনের প্রভাব রয়েছে। দণ্ড চুম্বকের উদাহরণ টেনে বলা যায়, মানব শরীর যে কোনো অবস্থাতেই থাকুক না কেন, তার উপরে প্রভাব একই থাকবে। সিজদায় কিংবা বিশেষ কোনো সময়ে ম্যাগনেটিক ফিল্ড এর ক্রিয়া ঘটবে, অন্য সময়ে ঘটবে না-এমনটি নয়।

সারমর্ম

ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে মস্তিস্কের ফ্রন্টাল লোব দেহের বৃদ্ধি এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে, সিজদায় বিভিন্ন ম্যাগনেটিক ফিল্ডের ক্রিয়া ঘটে, কসমো-ম্যাগনেটিক ফিল্ড এবং জিও-ম্যাগনেটিক ফিল্ড আমাদের বায়োম্যাগনেটিক ফিল্ডের ক্ষতি করে এই দাবিগুলোর কোন সত্যতা পাওয়া যায়নি। মূল পোস্টের দাবির সপক্ষেও কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ কিংবা গবেষণার উল্লেখ করা হয়নি । তাই ফ্যাক্ট-ওয়াচ ভাইরাল পোস্টগুলোকে “বিভ্রান্তিকর” হিসেবে চিহ্নিত করছে।

আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন?
কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন?
নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?

এসবের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে জানান।
আমাদেরকে ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh