“জামাতের নেতাদের অন্যায়ভাবে ফাঁসি দিছি” – একথা বলেছেন সিনহা?

Published on: January 28, 2022

জামাতের নেতাদের আমি অন্যায় ভাবে ফাঁসি দিছি! সাবেক বিচারপতি সিনহা কি বলে!- এমন ক্যাপশন সহযগে একটি ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। এই ভিডিওতে সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল এর ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে কথা বলতে শোনা গিয়েছে। ১০ মিনিটের পুরো ভিডিও ক্লিপ এর কোথাও জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের বিচার কিংবা ফাঁসি নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি ।

বিভ্রান্তির উৎস

২৩শে জানুয়ারি রাত ১০ টা ২২ মিনিটে ইলিয়াস হোসাইন নামক ফেসবুক পেজ থেকে ১০ মিনিট ৫৬ সেকেন্ডের এই ভিডিওটি আপলোড করা হয়েছিল।

পেজের পক্ষ থেকে ফলোয়ারদের এই ভিডিওটা বেশি বেশি শেয়ার করতে অনুরোধ করা হয়।

ফলশ্রুতিতে বিভিন্ন গ্রুপে এই ভিডিওটা পরবর্তী কয়েকদিন ধরে শেয়ার হতে দেখা যাচ্ছে। যেমন দেখুন এখানে, এখানে, এখানে


তবে এই ভিডিও ক্লিপটি বছরখানেক ধরেই ফেসবুকে দেখা গিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে ইলিয়াস হোসেন ভিডিওটিকে নতুন করে ভাইরাল করেছে।

ফ্যাক্টওয়াচ অনুসন্ধান

২০১৮ সালের ২২শে সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্কভিত্তিক টাইম টেলিভিশন এর ফেসবুক পেজে সাবেক বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা’র একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার লাইভ সম্প্রচার করা হয়।

ইউটিউবেও এই সাক্ষাৎকারটা  জোবায়েন সন্ধি  (Zobaen Sondhi) নামক চ্যানেলে দেখা যাচ্ছে।

২ ঘন্টা ৫৫ মিনিটের দীর্ঘ এই সাক্ষাৎকার এর ১ ঘন্টা ২০ মিনিট থেকে ১ ঘন্টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত অংশটুকু ইলিয়াস হোসেনের পেজে আপলোড করা হয়েছে বলে দেখা যাচ্ছে।

সুদীর্ঘ এই সাক্ষাৎকারের ৪৬ তম মিনিট থেকে এস কে সিনহা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল এর রায়, এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল এবং আপিল খারিজ এর রায় এর বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহ আলোচনা করছিলেন।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য,  বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে নিতে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী জাতীয় সংসদে পাস হয়। ওই সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০১৪ সালের ৫ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের নয়জন আইনজীবী হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০১৬ সালের  ৫ মে হাইকোর্টের তিনজন বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত বিশেষ বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। এই রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ ২০১৭ সালের ৪ জানুয়ারি আপিল করে। এরপর ২০১৭ সালের ৩ জুলাই আপিল খারিজের রায় ঘোষণা করেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা।

আলোচিত এই ভিডিওর প্রথম মিনিট থেকেই শোনা যায়, সুরেন্দ্র কুমার সিনহা ২০১৭ সালের ২ রা জুলাই এর ঘটনা বর্নণা করছেন। ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের আপিলের মামলার জন্য এজলাসের ৭ জন বিচারপতির প্রত্যেকের মতামত শুনছিলেন তিনি। প্রথম অবস্থায় বিচারপতিরা  দ্বিধাবিভক্ত মতামত এলেও পরে আলোচনার মাধ্যমে সবাই সর্বসম্মত ভাবে (unanimously) এই আপিলের বিরুদ্ধে মতামত দেন।

১০ মিনিটের এই ভিডিও ক্লিপসে সেই ২০১৭ এর জুলাই মাসের ঘটনাই বর্ণনা করে গেছেন সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। এখানে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় ছাড়া অন্য কোনো বিষয় আলোচিত হয়নি।

জনমনে বিভ্রান্তি

ভুল তথ্য সম্বলিত ক্যাপশন যোগ করার কারণে অনেকেই বিভ্রান্ত হচ্ছেন। পুরা ভিডিও না দেখে, কিংবা ভিডিও ক্লিপ এর কথোপকথনের প্রসঙ্গ বুঝতে না পেরে অনেকেই ধারণা করছেন, যুদ্ধাপরাধ এর দায়ে জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের বিচারের প্রসঙ্গে এখানে কথা বলা হচ্ছে। এমন কয়েকজন বিভ্রান্ত পাঠকের মন্তব্য দেখুন এখানে।

এস কে সিনহা কি কোনো যুদ্ধাপরাধী বা জামায়াত নেতার ফাসির আদেশ দিয়েছেন ?

১৯৭১ এর যুদ্ধাপরধীদের বিচারের লক্ষে ২০১০ সালের ২৫শে মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল গঠন করা হয়। পরবর্তীতে ২০১২ সালের ২২শে মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল -২ গঠন করা হয় । এসব ট্রাইবুনালে বিচারক হিসেবে বিভিন্ন সময়ে ১২ জন দায়িত্ব পালন করেন । এরা হলেন- বিচারপতি মোঃ নিজামুল হক, এ টি এম ফজলে কবীর, এ কে এম জহির আহমেদ, বিচারপতি আনোয়ারুল হক , বিচারপতি ওবায়দুল হাসান , বিচারপতি মোঃ শাহিনুর ইসলাম , বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন , বিচারপতি মোঃ মজিবুর রহমান মিয়া, বিচারপতি এম এনায়েতুর রহিম, বিচারপতি মোঃ সোহরাওয়ার্দী, বিচারপতি আমির হোসেন, বিচারপতি মোঃ আবু আহমেদ জমাদার। লক্ষণীয় , এদের মধ্যে সুরেন্দ্র কুমার সিনহা কখনোই বিচারক ছিলেন না ।

বিভিন্ন যুদ্ধাপরাধ এর মামলায় এই দুইটা ট্রাইবুনাল থেকে জামায়াতে ইসলামীর নেতা আব্দুল কাদের মোল্লা, মোহাম্মদ কামারুজ্জামান , আলি আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ , মতিউর রহমান নিজামী সহ জনের ফাসির আদেশ দেওয়া হয়।

অন্যদিকে ১৮ই জানুয়ারি ২০১৫ থেকে নভেম্বর,২০১৭ পর্যন্ত সুরেন্দ্র কুমার সিনহা প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালন করেছেন।

তবে যেহেতু সুরেন্দ্র কুমার সিনহা কখনোই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল  এর বিচারক ছিলেন না, তাই তার বিরুদ্ধে “জামায়াত নেতাদের ফাসি দেওয়ার” অভিযোগ ধোপে টেকে না।

সুরেন্দ্র কুমার সিনহার ক্যারিয়ার এর আরেকটি উল্লেখযোগ্য অর্জন হচ্ছে, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার চূড়ান্ত রায় দেওয়া বেঞ্চেও সদস্য হিসাবে ছিলেন তিনি  । ২০১০ সালের এই আপিলে ১২ জনের ফাসির আদেশ।  দেওয়া হয়, যাদের সবাই ছিলেন সেনাবাহিনীর সদস্য। জামায়াতে ইসলামী কিংবা কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা ছিলেন না কেউই।

ইলিয়াস হোসেন’ পেজ থেকে অপপ্রচার

অতীতে বিভিন্ন সময়ে ‘ইলিয়াস হোসেন’ ফেসবুক পেজ থেকে অপপ্রচার চালানো হয়েছিল। ২০২০ সালের আগস্ট মাসে ওসি প্রচীপ কুমার দাসকে ভারতীয় নাগরিক বলে দাবি করেছিল ইলিয়াস হোসেন। এই দাবিটিকে সেই সময়ে বুম বিডি মিথ্যা হিসেবে সনাক্ত করেছিল।

সঙ্গত কারণে বর্তমানে ভাইরাল হওয়া ভিডিওটির শিরোনামের দাবিকে ফ্যাক্টওয়াচ মিথ্যা সাব্যস্ত করছে।

আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন?
কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন?
নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?

এসবের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে জানান।
আমাদেরকে ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh

Leave a Reply