ঘুম থেকে উঠে হুট করে দাঁড়িয়ে পড়লে কি স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক হয়?

Published on: April 20, 2022

সম্প্রতি স্বাস্থ্য সম্পর্কিত একটি গুজব ভাইরাল হয়েছে। দাবি করা হচ্ছে, ঘুম থেকে উঠেই তাড়াহুড়ো করে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লে স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক করবে।

বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে এমন দাবির সপক্ষে কোন বৈজ্ঞানিক প্রমাণ খুজে পাওয়া যায় নি। এ এফ পি সহ কয়েকটি ফ্যাক্ট চেকিং সংস্থা অনুসন্ধানে জানিয়েছে , এটা নিছকই গুজব। ফ্যাক্ট ওয়াচের অনুসন্ধানেও এটাই প্রতীয়মান হচ্ছে।

গুজবের উৎস

গত কয়েক বছর ধরেই অনলাইনে এই গুজবটা দেখা যাচ্ছে।


তবে সম্প্রতি ১০ ই এপ্রিল ২০২২ তারিখ থেকে এই গুজবটা নতুন করে ভাইরাল হয়েছে।


যেমন- ২০১৭ সালের ১৩ই এপ্রিল ডাক্তার সারমিন সুলতানা নামক পেজ থেকে নিচের এই পোস্টটি শেয়ার করা হয়।

যারা রাত্রে বা ভোরে বাথরুমে যাবার জন্য ঘুম থেকে ওঠেন তাদের জন্য ডাক্তারদের একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ:

আমরা প্রায়ই শুনতে পাই একেবারে সুস্থ একজন মানুষ রাতের বেলা হঠাৎ মারা গেছেন। এটার একটা কারন হচ্ছে রাতে বাথরুমে যাবার জন্য ঘুম ভেঙ্গে গেলে আমরা তাড়াহুড়ো করে

হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে পড়ি যা ব্রেইনে রক্তের প্রবাহ হঠাত কমিয়ে দেয়। এটা আপনার ইসিজি প্যাটার্নও বদলে দেয়।

হুট করে ঘুম থেকে উঠেই দাঁড়িয়ে পড়ার দরুন আপনার ব্রেইনে সঠিক ভাবে অক্সিজেন পৌছাতে পারেনা, যার ফলে হতে পারে হার্ট এ্যাটাকের মত ঘটনাও।

ডাক্তাররা ঘুম থেকে উঠে বাথরুমে যাবার আগে সবাইকে ‘দেড় মিনিট’ সময় নেয়ার একটি ফর্মুলা দিয়েছেন।

এই দেড় মিনিট সময় নেয়াটা জরুরি কারন এটা কমিয়ে আনবে আপনার আকস্মিক মৃত্যুর সম্ভাবনা।

হঠাত এই উঠে পড়ার সময়ে এই দেড় মিনিটের ফর্মুলা বাঁচিয়ে দিতে পারে আমাদের জীবন।

১। যখন ঘুম থেকে উঠবেন, হুট করে না উঠে মিনিমাম তিরিশ সেকেন্ড বিছানায় শুয়ে থাকুন।

২। এরপর উঠে বিছানায় বসে থাকুন তিরিশ সেকেন্ড।

৩। শেষ তিরিশ সেকেন্ড বিছানা থেকে পা নামিয়ে বসুন।

এই দেড় মিনিটের কাজ শেষ হবার পর আপনার ব্রেইনে পর্যাপ্ত পরিমানে অক্সিজেন পৌছাবে যা আপনার হার্ট এ্যাটার্ক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি একদম কমিয়ে আনবে।

খুবই গুরুত্বপুর্ন এই স্বাস্থ্য সম্পর্কিত তথ্যটি ছড়িয়ে দিন আপনার পরিবার,বন্ধু এবং পরিচিত লোকজনের মাঝে। নিজে এই ফর্মুলাটি মেনে চলুন এবং অন্যদেরকেও মানতে বলুন।

মনে রাখবেন যেকোন বয়সের মানুষের ক্ষেত্রেই এমন দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তাই সাবধান থাকতে হবে সবাইকেই।

ডাক্তার শারমিন সুলতানা নামক পেজটি কোনো ডাক্তার কর্তৃক পরিচালিত হয় কিনা, সেটা ফ্যাক্টওয়াচ যাচাই করতে পারেনি। পেজ এর এবাউট সেকশনে ডাক্তার শারমিন সুলতানা সম্পর্কিত কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি । পেজ থেকে মেডিকেল সম্পর্কিত পোস্ট এর বদলে নন-মেডিকেল পোস্ট বেশি শেয়ার করতে দেখে ধারণা করা যায়, এটা কোনো ডাক্তারের পরিচালিত পেজ নয়। তারপরেও অনেকেই পেজের নাম দেখেই এটাকে ডাক্তার-পরিচালিত পেজ ভাবতে পারেন। স্ট্রোক সম্পর্কিত এই পোস্টটাই গত ৫ বছরে ৫১ হাজার বার শেয়ার করা হয়েছে।

গত ১১ই এপ্রিল ২০২২ তারিখে প্রাণের ব্রাহ্মণপাড়া শহর গ্রুপে Sydur Rahaman Liton একই কথা লিখেন। তবে এখানে তিনি কিছুটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা যোগ করেন। মূল পোস্টের শুরুতে তিনি লিখেন-

এই ডাক্তারি পরামর্শটির বাস্তব উদাহরণ আমার বন্ধু !!!

গত মার্চের তারিখের গভীর রাতে আমার ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল! দ্রুত ওঠে বাথরুমে পেসাব করে বোতলে পানি খেয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ি। তার দুইদিন পর সিমটম শুরু হলে নিউরোসাইন্স হাসপাতালে যাই। যথারীতি সিটিস্ক্যান! ধরা পড়ে মাইনর স্ট্রোক!

১৩ই এপ্রিল ২০২২ লজ্জা নয় জানতে হবে মেডিকেল সেক্স  নামক গ্রুপে জনৈক Tasnova Zaman একই পোস্ট করেন। তবে এখানে তিনি উল্লেখ করেন, এই ডাক্তারি পরামর্শটির বাস্তব উদাহরণ আমি নিজে!!!

একইভাবে গত ১৬ই এপ্রিল ২০২২ তারিখে Dr.Rejwan Gani Mazumder-Physiotherapist তার ফেসবুক পেজ থেকে একই পোস্ট করেন। এখানেও তিনি দাবি করেন, এই ডাক্তারি পরামর্শটির বাস্তব উদাহরণ আমি নিজে!!!

 

পোস্টটি খুব দ্রুতই ভাইরাল হয়ে যায় ফেসবুকে বিভিন্ন আইডি, পেজ এবং গ্রুপ থেকে শেয়ার হতে থাকে। এবং দেশব্যাপী অনেকেই জানাতে থাকেন, গত ৬ই মার্চ তারিখে তাদের ঘুম ভেঙে যায়, এবং দুইদিন পরে তাদের মাইনর স্ট্রোক ধরা পড়ে।

এমনই কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে,  এখানে, এখানে,

কয়েক জায়গায় পরামর্শদাতা হিসেবে ডাক্তার তাসনিম জারার নাম উল্লেখ করা হয় । যেমন এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে । তবে তাসনিম জারার মূল একাউন্টে এমন কোনো পোস্ট খুজে পাওয়া যায়নি।

ফ্যাক্ট ওয়াচের অনুসন্ধান

অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, এটি একটি আন্তর্জাতিক গুজব । বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই অতীতে এই গুজবটি ভাইরাল হয়েছিল ।

তারই প্রেক্ষিতে এই বিষয়টা নিয়ে এএফপি ফ্যাক্টচেক এবং এএপি ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

এএফপির প্রতিবেদনে নাইরোবির হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. বার্নার্ড গিতুরা বলেন “ পোস্টটি ভুলে ভরা এবং বিজ্ঞানে এর কোন ভিত্তি নেই। হঠাৎ জেগে উঠলে হৃৎপিণ্ড দুর্বল হতে পারে না বা মস্তিষ্কে রক্তের সরবরাহ কমে যায় না। শরীর একটি জটিল প্রক্রিয়ায় কাজ করে। যখন কেউ ঘুমন্ত অবস্থা থেকে জেগে ওঠে তখন শরীর স্বাভাবিকভাবেই রক্তচাপ এবং প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে। স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে একজন মানুষের তিন মিনিট খুবই বেশি সময়(এখানে অবশ্য দেড় মিনিট দাবি করা হয়েছে সেটাও খুবই বেশি সময়), আমাদের শরীর এত সময় নেয় না।”

তিনি আরও বলেন “ রোগাক্রান্ত অবস্থায় মানুষ রক্তের নিম্নচাপে আক্রান্ত হতে পারে এবং মস্তিষ্কের রক্তশূন্যতায় ভুগতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে যেখানে রক্ত চাপ খুব কম, এটা সত্য তখন মস্তিষ্ক রক্তের অভাবে ভুগতে পারে কিন্তু বসা অবস্থা থেকে দাড়ালে সেটা মস্তিষ্কে রক্তপ্রবাহ কমিয়ে দেয় না।”

ডা. গিতুরা ফেসবুকের ইসিজি সম্পর্কিত দাবিটিও নাকচ করে দেন। তিনি বলেন “ইসিজি অস্বাভাবিক ছন্দ সনাক্ত করে কিন্তু আমরা হঠাৎ জেগে উঠলে প্যাটার্ন পরিবর্তন হয় না।”

এএপির প্রতিবেদনে দাবি করা হয় ঘুমের থেকে হঠাৎ উঠার ফলে মৃত্যু হতে পারে এমন কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি । বিভিন্ন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ নিশ্চিত করেছেন ঘুমের থেকে উঠে ৩ মিনিট ৩০ সময় নেওয়ার কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই (ভাইরাল হওয়া পোস্টে এটাকে দেড় মিনিট বলে চালানো হচ্ছে)।

ব্রিসবেনের প্রিন্স চার্লস হসপিটালের সিনিয়র কার্ডিওলজিস্ট এবং এসোসিয়েট প্রোফেসর ড. ইসুরু রানাসিঙ্গে বলেন  হঠাৎ ঘুম থেকে উঠলে কোন ইসিজি চেঞ্জ হয় না, যেটা পোস্টে দাবি করা হয়েছে। তিনি বলেন কেউ যখন অসুস্থ থাকে তখন হঠাৎ বসা অবস্থা থেকে দাঁড়িয়ে উঠলে নিম্ন রক্তচাপ অনুভূত হতে পারে। এটাকে postural – or orthostatic – hypotension বলে। এটা বৃদ্ধদের জন্য ভয়াবহ হতে পারে কারণ তারা পড়ে গিয়ে বিভিন্ন রকম আঘাতের সম্মুখিন হতে পারে।

ইউনিভার্সিটি অফ সিডনির কার্ডিয়াক ইমেজিং প্রফেসর মার্টিন উগান্ডার বলেন postural – or orthostatic – hypotension বৃদ্ধদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। তিনি এজন্য পরামর্শদেন “খুবই ধীরে সুস্থে বসা অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়ানো উচিত। এটা এক দুই সেকেন্ড হতে পারে, সর্বোচ্চ ৩০ সেকেন্ড কিন্তু ৩ মিনিট ৩০ সেকেন্ড অনেক বেশি।

বাংলাদেশের ডা. মারুফুর রহমান অপুও ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়ে এমন দাবি নাকচ করে দিয়েছেন।

লন্ডনে বসবাসরত  কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সুপাইরভাইজার ডাক্তার তাসনিম জারা এক ভিডিও বার্তায় জানাচ্ছেন, কিছু রোগীকে আমরা পরামর্শ দেই, যেন বসা থেকে দাড়ানোর সময় তারা একটু সময় নিয়ে দাঁড়ায়। এটা নির্দিষ্ট কিছু রোগীর জন্য। postural hypotension নামে একটা রোগ আছে ,যেখানে রোগীরা যখন বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় , তখন তাদের রক্তচাপ কমে যেতে পারে। ফলে দেখা যায় তাদের একটু মাথা ঘুরাতে পারে, মাথা হালকা হালকা লাগতে পারে, শূন্য শূন্য লাগে-অনেকে বলে। আবার কিছু ক্ষেত্রে হঠাত হঠাত কোনো রোগী অজ্ঞান ও হয়ে যেতে পারে। তো, এই postural hypotension রোগটা নির্নয়ের একটা পদ্ধতি আছে, আমরা ডাক্তাররা কিছু নিয়ম মেনে এই রোগটা নির্নয় করি। যাদের এই রোগ আছে, তাদের জন্য এই পরামর্শ,যে, সকালে যখন ঘুম থেকে ওঠে তখন বিছানা থেকে নামার সময় যেন একটু সময় নিয়ে নামে। যদি পানিশূন্যতা থাকে তাহলে আমরা পানি খেতে বলি। এই পরামর্শ তো সাধারন মানুষ, সূস্থ মানুষদের জন্য না। অর্থাৎ, এই পোস্টে যেমনটি বলা হচ্ছে যে সবার জন্যই দেড় মিনিট অপেক্ষা করতে বলছে এবং এটা না করলে হার্ট এটাক হবে- ব্যাপারটা এমন না। এটা নিয়ে আপনারা দুশ্চিন্তা করবেন না। এটা নিয়ে আতঙ্কিত হবেন না। এই পোস্ট শেয়ার করা থেকে বিরত থাকুন ।

তবে আপনার যদি কখনো বসা থেকে ওঠার সময়ে মাথাব্যথা করে, হালকা লাগে বা অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান, তাহলে ডাক্তারের কাছে যাবেন। রখন ডাক্তার খতিয়ে দেখতে পারবেন যে আপনার postural hypotension আছে কিনা, কিংবা কি কারনে আপনার এমন হল। তো, এই সিম্পটমগুলো থাকলে আপনি ডাক্তারের কাছে যাবেন, কিন্তু সূস্থ স্বাভাবিক মানুষের জন্য এই পোস্ট নিয়ে ভয়ের কিছু নাই। দেড় মিনিট উঠে অপেক্ষা করতে হবে- এর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নাই।

সারমর্ম 

হুট করে ঘুম থেকে উঠলে দেড় মিনিট সময় নিয়ে দাড়াতে হবে  নয়তো হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক হতে পারে এমন দাবী বিশেষজ্ঞরা নাকচ করে দিয়েছেন। তাই ফ্যাক্টওয়াচ এটাকে ভূল এবং বিভ্রান্তিকর তথ্য হিসেবে সনাক্ত করছে।

সংশোধনী নোট :
ডাক্তার তাসনিম জারা’র বক্তব্য পরবর্তীতে সংযোজন করা হল। 

আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন?
কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন?
নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?

এসবের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে জানান।
আমাদেরকে ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh

Leave a Reply