রবীন্দ্রনাথের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতার কোনো প্রমাণ মেলে নি

Published on: July 23, 2022

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরে একটি পোস্ট ঘুরছে যেখানে দাবি করা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় বিরোধিতা করেছিলেন। তবে এই দাবির সপক্ষে কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি।

গুজবের উৎস

বিভিন্ন সময়ে ভাইরাল হওয়া কয়েকটি পোস্টের স্ক্রিনশট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে

এসব পোস্টে বলা হয়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় শুধু কঠোরভাবে বিরোধিতা করেই ক্ষান্ত হননি বরং তিনি ব্রিটিশদের সাথে রীতিমতো দেনদরবার করেছিলেন যাতে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় না করা হয়। সেসময় রবীন্দ্রনাথ এক অনুষ্ঠানে দাম্ভিকতার সাথে বলেছিলেনমূর্খের দেশে আবার কিসের বিশ্ববিদ্যালয়, তারাতো ঠিকমতো কথাই বলতে জানেনা!” অন্যত্র এক অনুষ্ঠানে এদেশের মানুষকে তীব্রভাবে কটাক্ষ করে রবী ঠাকুর বলেছিলেনসাত কোটি সন্তানের হে মুগ্ধ জননী, রেখেছো বাঙালী করে মানুষ করোনি

 

এই ধরনের পোস্ট বিগত বছরগুলোতেও বিভিন্ন সময় ভাইরাল হতে দেখা গেছে। বিগত বছর গুলোতে ভাইরাল হওয়া পোস্টগুলো দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে







একই দাবি যুক্ত ভিন্ন আরেকটি পোস্ট অনলাইনে বিভিন্ন সময়ে দেখা যায়। ভাইরাল হওয়া দ্বিতীয় পোস্টটি নিচে দেওয়া হলো

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় যারা বিরোধীতা করেছিল আজ তারাই আমাদের প্রিয় !!!! রেফারেন্সসহ ইতিহাস তুলে ধরার চেষ্টা করছি, কেউ আহত হলে মনে কষ্ট পাবোরবীন্দ্রনাথ সহ সকল বাঙ্গালী হিন্দু নেতা বুদ্ধিজীবি ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার চরম বিরোধীতা করেন। এমনকি ঢাকার হিন্দুরাও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে ছিল। === তাহলে কি রবীন্দ্রনাথ চাননি যে, তার জমিদারীর অন্তুর্ভুক্ত মুসলমান কৃষক শ্রমিক সন্তান এবং অনুন্নতরা বিশ্ববিদ্যালয়ের আলো পেয়ে ধন্য হোক। …….. বললে আরো লজ্জা হয় যে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি স্যার আশুতোষ মুখার্জীর (রবীন্দ্রনাথের ভাইঝি জামাতা) নেতৃত্বে সেই সময়কার ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জকে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন না করার জন্য ১৮ বার স্মারকলিপি দিয়ে চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল। নীচতা এত নীচে নেমেছিল যে, তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বিদ্রুপ করে বলতেন মক্কা বিশ্ববিদ্যালয়। ( সূত্র: জীবনের স্মৃতিদ্বীপে: . রমেশ চন্দ্র মজুমদার) ====১৯১২ সালের ২৮ মার্চ কলকাতার গড়ের মাঠে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে হিন্দুরা প্রতিবাদ সভা ডাকে। সভায় সভাপতিত্ব করেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। কারন তিনি ছিলেন জমিদার। তিনি মুসলমান প্রজাদের মনে করতেন গৃহপালিত পশু। (নীরোদ চন্দ্র চৌধুরী, দি অটোবায়োগ্রাফী অফ অ্যান আননোন ইন্ডিয়ান) বঙ্গভঙ্গ রদের পর পূর্ববঙ্গ আসামের ভাগ্যবঞ্চিত জনগণ বিশেষভাবে ক্ষুব্ধ হয়। নবাব সলিমুল্লাহ তখন ইংরেজ সরকারের কাছে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি জানান। পূর্বাঞ্চলীয় জনগণের বঞ্চনার কথা চিন্তা করে অবশেষে তাদেরগরু মেরে জুতা দানকরার মতো ইংরেজ সরকার ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে অন্তত এলাকার যুবসম্প্রদায় শিক্ষিত হওয়ার সুযোগ পাবে আশায় অঞ্চলের মানুষ কিছুটা আশ্বস্ত হয়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠারও তুমুল বিরোধিতা করেন। কলকাতা ইউনিভার্সিটি কমিশনের রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাবু গিরিশ বানার্জি, . স্যার রাসবিহারী ঘোষ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর স্যার আশুতোষ মুখার্জির নেতৃত্বে একদল হিন্দু বুদ্ধিজীবী বড়লাট লর্ড হার্ডিঞ্জের সঙ্গে দেখা করে ১৮ বার স্মারকলিপি দিয়েছিলেন। ১৯১১ সাল থেকে ১৯২০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট পাস হওয়া পর্যন্ত কবি রবীন্দ্রনাথসহ হিন্দু নেতারা অবিরাম এর বিরোধিতা করেছেন। সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডক্টর কাজী জাকের হোসেন বলেন —“ঘোষণা দেয়া মাত্র ওপার বাংলার তীব্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয়ে গেল। ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা? কী অলক্ষণে কথা! ‘চাষার ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলে বাসার চাকরি করবে কারা!’ যে ২২ জনমহাজ্ঞানী ব্যক্তিঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে গভর্নরের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে এক নম্বরে নাম ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে কলকাতার গড়ের মাঠে যে সভা হয়, তাতে সভাপতিত্ব করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

এমন কয়েকটি পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে

“মূর্খের দেশে আবার বিশ্ববিদ্যালয় কিসের” –রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নামে একটি ফেসবুক গ্রুপ ও খোলা হয়েছে ২০২১ সালে।

 

ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধান

প্রথম দাবি: ঢাবির জমি নবাব পরিবারের দান

ভাইরাল হওয়া পোস্টে দাবি করা হয় “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ নবাব সলিমুল্লাহ -এর দান করা ৬০০ একর জমির উপর দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু সমকালের একটি গবেষণাধর্মী কলাম থেকে জানা যাচ্ছে, এই দাবির পক্ষে জোরালো কোন সত্যতা পাওয়া যায়নি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জমির মালিকানা নিয়ে খানিকটা কথোপকথন রয়েছে সরদার ফজলুল করিম রচিত ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পূর্ববঙ্গীয় সমাজ :অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক-এর আলাপচারিতা ও অন্যান্য’ শীর্ষক বইয়ের ১৬ এবং ১৭ পৃষ্ঠায়।

সরদার ফজলুল করিম জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাককে সলিমুল্লাহ হলের নাম কেন রাখা হলো এবং নবাব পরিবারের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় কোন অর্থ দান করেছিলেন কিনা এই ব্যাপারে প্রশ্ন করেছিলেন।

প্রশ্নের উত্তরে আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘আদৌ কোনো কনট্রিবিউশন ছিল না। আবদুল্লাহ সোহরাওয়ার্দী লেখাপড়ায় ব্রিলিয়ান্ট ছিল। তারা আহসান মঞ্জিলের টাকায় লেখাপড়া শিখেছে। তারা সলিমুল্লাহর মৃত্যুবার্ষিকী পালন করত। ঢাকা ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠার প্রায় ১০ বছর পরে তার একটা মৃত্যুবার্ষিকীতে তার নামে একটা ছাত্রাবাস করার প্রস্তাব তারা করেন।’

তিনি আরো বলেন “কোনো মুসলমান ধনীর কাছ থেকেই ঢাকা ইউনিভার্সিটি ডাইরেক্টলি কোনো ফাইন্যান্সিয়াল কনট্রিবিউশন পায় নাই। কথা ছিল গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া ঢাকা ইউনিভার্সিটি করবে। সেই জন্য ১৯১০ থেকে কিছু টাকা ইন্ডিয়া গভর্নমেন্ট আলাদা করে রাখত। ১৯২০-২১-এ এই টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় ৬০ লক্ষ। কিন্তু এই ৬০ লক্ষ টাকা বেঙ্গল গভর্নমেন্ট ডিড নট গিভ টু দি ঢাকা ইউনিভার্সিটি। তারা সে টাকাটা পুরো নিয়ে নিল। সলিমুল্লাহ হল যে তৈরি হলো, তা পুরোই সরকারের টাকায়। নওয়াব পরিবারের টাকায় নয়; নওয়াব পরিবারের জায়গাতেও নয়। রমনার যে জায়গায় ঢাকা ইউনিভার্সিটি- এর পুরাই খাসমহল, সরকারের জমি। সেটলমেন্ট রিপোর্ট-এ তাই আছে। বরঞ্চ লাখেরাজ সম্পত্তি বললে রমনা কালীবাড়িকে বলা যায়। ঢাকা শহরে লাখেরাজ সম্পত্তি কী, এ নিয়ে আলোচনা চলেছে ১৮১৫ কি ১৮২০ সাল থেকে। ঢাকার নওয়াবদের জমিজমা এসেছে প্রধানত একটি সূত্র থেকে। ঢাকার স্থানীয় মুসলমানরা মৃত্যুর সময়ে কোন কোন সম্পত্তি নওয়াব আবদুল গনি ও আহসানউল্লাহকে ওয়াকফ করে দিয়ে যেত। ঢাকার নওয়াবদের জমির উৎস এই। তাও বেশি কিছু জায়গাজমি নয়। এটার ভেরিফিকেশন তো সোজা। যে কেউ ইন্টারেস্টেড, সে ঢাকা কালেক্টরেটে যেয়ে দেখে আসতে পারেন। কাজেই নওয়াব পরিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে জমি দিবে, এমন জমি কোথায় ছিল? আহসান মঞ্জিলের কোন জমি ছিল না।”

 

অবশ্য গবেষক, কলামিস্ট এবং লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদ তার বই ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশে উচ্চ শিক্ষা’ তে লেখেন “রমনা নিউ টাউনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব হতেই তার জন্য স্যার সলিমুল্লাহ তাদের নবাব এস্টেটের জমি দান করার অঙ্গীকার করেন। বিশ্ববিদ্যালয়কে তিনি তাঁদের ৬০০ একর জমি দেওয়ার ঘোষণা দেন। রমনায় প্রধানত তাদের জমিতেই এবং সরকারি ভবনে বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম শুরু হয়। যেমন কার্জন হল, পুরোনো ঢাকা কলেজ (হাইকোর্ট প্রাঙ্গণের পুরোনো সাদা বাড়ি), ঢাকা মেডিকেল কলেজের মূল ভবন প্রভৃতি। পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশ গঠনের সময় এসব ও অন্যান্য যেসব ইমারত নির্মাণ করা হয়, সেগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ব্যবহার করতে দেওয়া হয়। গুলিস্তান থেকে নীলক্ষেত পর্যন্ত এক হাজার ৮৩৯ বিঘা জমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ইজারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। ১৯৩৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সরকারের জমিসংক্রান্ত আরেকটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সেক্রেটারি অব ইন্ডিয়া ইন কাউন্সিল এম এ স্টুয়ার্ট এবং উপাচার্য স্যার এ এফ রহমান সেই চুক্তির দলিলে স্বাক্ষর করেন। দলিলে বিশ্ববিদ্যালয়কে ২৫৭.৭০ একর জমি রেজিস্ট্রি করে দেওয়া হয়। তবে দলিল রেজিস্ট্রির বাইরে নবাবদের দেওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও ৩০০ একর জমি ছিল। তার বেশিরভাগই পরে ধীরে ধীরে বেদখল হয়ে যায়।” তবে এই লেখায় তিনি জনশ্রতিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। বেশিরভাগ লেখক এবং গবেষক তার এই বক্তব্যকে নাকচ করে দিয়েছেন।

 

সৈয়দ আবুল মকসুদের এই বক্তব্যকে খণ্ডন করে শেখ মাসুম কামাল তার রচিত ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিপক্ষে রাজনীতি ও তৎকালীন বঙ্গীয় সমাজ’ বইয়ে লিখেছেন, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা প্রসঙ্গে বহুল প্রচারিত একটি মিথের অবসান ঘটানো দরকার। কথায় কথায় অনেকেই বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য নবাব স্যার সলিমুল্লাহ জমি প্রদান করেছিলেন, অথবা জমি প্রদানের অঙ্গীকার করেছিলেন। যে কথাটি খুব গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, প্রতিশ্রুতি প্রদান এবং তার বাস্তবায়ন এক জিনিস নয়।’

আবুল মকসুদের বক্তব্য বিশ্লেষণ করে তিনি বলেন, ‘এই বক্তব্য খুব সরল অঙ্কে বিশ্নেষণ করলে যেটা দাঁড়ায় তার অর্থ হলো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য নবাব স্যার সলিমুল্লাহ জমি দান করতে অঙ্গীকার করেছিলেন। লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদের দাবির ভিত্তি সম্ভবত জনশ্রুতিরই অংশ। জনশ্রুতিকেই ইতিহাসের আঙিনায় টেনে আনা হলো! লেখক কোত্থেকে এই তথ্য পেয়েছেন তার কোনো সূত্র তিনি তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেননি।”

 

অতএব গবেষকদের বিশ্লেষণের সারমর্ম করলে দাঁড়ায় নবাব স্যার সলিমুল্লাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য জমি দেবেন বলে অঙ্গীকার করে থাকতে পারেন। কিন্তু তিনি ছিলেন চরম ঋণগ্রস্থ। তার পক্ষে জমি দেওয়া সম্ভব নয়। তাছাড়া নবাব পরিবারের কাছে যথেষ্ট জমি ছিলো না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সরকারী খাস জমির উপর।

তাছাড়া নবাব সলিমুল্লাহর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় আর্থিক কোন সাহায্যেরও প্রমাণ মেলেনি। সলিমুল্লাহ হল তৈরি করা হয়েছিল সরকারের টাকায়।

 

সমকালের কলামটি দেখুন এখানে

 

দ্বিতীয় দাবি: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গড়ের মাঠের এক জনসভায় ঢাবি প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন

ভাইরাল হওয়া পোস্টগুলোতে দাবি করা হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় বিরোধিতা করেন। সারাবাংলার একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে এই দাবিটি মূলত আলোচনায় আসে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) এমএ মতিনের ‘আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ধারাবাহিকতা এবং প্রাসঙ্গিক কিছু কথা’ নামক বই থেকে। বইয়ে উল্লেখ করা হয় ‘১৯১২ সালের ২৮ মার্চ কলিকাতার গড়ের মাঠে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিবাদে এক বিশাল জনসভার আয়োজন করা হয়। এখানে বলা প্রয়োজন যে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো ব্যক্তিত্বও সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন। কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে যে, রবীন্দ্রনাথ তখন ছিলেন হিন্দু সমাজ তথা হিন্দু মনমানসিকতা ও হিন্দু চেতনা ও হিন্দু ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ একজন হিন্দু স্বভাবকবি।’’

এ তথ্য প্রকাশিত হওয়ার পর এ জেড এম আবদুল আলী সমকাল পত্রিকায় এ বক্তব্যের সত্যতা চ্যালেঞ্জ করে রেফারেন্স বা তথ্যসূত্র জানতে চান, কিন্তু কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। ২০১৪ সালে অক্টোবর মাসে বই পত্রিকায় অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রবীন্দ্র প্রসঙ্গ’ নামে একটি নিবন্ধে এ বক্তব্যের অসত্যতা প্রমাণ করেন।

প্রশান্ত কুমারের সম্পাদিত রবীন্দ্রনাথের জীবনীনির্ভর বই “রবিজীবনী” -এর ৬ষ্ঠ খণ্ডের ৫১তম অধ্যায় থেকে জানা যায়, ১৯১২ সালের ২৮শে মার্চ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কুষ্টিয়ার শিলাইদহতে অবস্থান করছিলেন।  কাজেই একই সময়ে তার পক্ষে কলকাতার গড়ের মাঠে সভাপতিত্ব করার সুযোগ নেই।
“রবি জীবনী” বই থেকে জানা যায়  ১৯১২ সালের ১৯ মার্চ রবীন্দ্রনাথের কলকাতা থেকে ‘সিটি অব প্যারিস’ জাহাজে ইংল্যান্ড যাত্রার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। একই কেবিনে তার সঙ্গী হিসেবে যাবেন মেয়ো হাসপাতালের ডাঃ দিজেন্দ্রনাথ মৈত্র। এর আগের দিন জাহাজে তার মালপত্র তুলে দেওয়া হয়। কিন্তু ১৯ মার্চ অসুস্থ হওয়ার ফলে তিনি জাহাজে উঠতে পারেননি।

“রবিজীবনী ” বইয়ের সেই অংশটুকুর স্ক্রিনশট দেখুন এখানে-

 

কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ এ ঘটনা নিম্নরূপে বর্ণনা করেছেন যা রবিজীবনী উদ্ধৃত হয়েছে। উদ্ধৃত অংশটুকু নিচে তুলে দেওয়া হলো-

“জাহাজ ছাড়বার আগের দিন রাত্রে স্যার আশুতোষ চৌধুরীর বাড়িতে বাবার নিমন্ত্রণ। কেবল খাওয়াদাওয়া নয়, সেই সঙ্গে ‘বাল্মীকিপ্রতিভা’ অভিনয়ের ব্যবস্থা হয়েছিল। দীনেন্দ্রনাথ বাল্মীকির ভূমিকায় অভিনয় করলেন। অসুস্থ শরীরে বাবাকে অনেক রাত অবধি জাগতে হলো। আমরা ঘরে ফিরলাম বেশ রাত করে। বাকি রাতটুকু বাবা না ঘুমিয়ে চিঠির পর চিঠি লিখে কাটিয়ে দিলেন। ভোরবেলা উঠে বাবার শরীরের অবস্থা দেখে আমরা ভয় পেয়ে গেলাম, ক্লান্তিতে অবসাদে যেন ধুঁকছেন। তাড়াতাড়ি ডাক্তার ডাকতে পাঠানো হলো।….জাহাজ আমাদের জিনিসপত্র সমেত যথাসময়ে পাড়ি দিল, কিন্তু আমাদের সে যাত্রা আর যাওয়া হলো না।”

উদ্ধৃত অংশটুকুর স্ক্রিনশট দেখুন এখানে-

 

২৪ মার্চ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হাওয়া পরিবর্তনের জন্য কুষ্টিয়ার শিলাইদহ -তে যান। শিলাইদহতে যাবার তথ্যটি ক্যাশবহির একটি হিসাবে লেখা আছে। এবং ২৫ মার্চ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কদম্বিনী দত্তকে লেখেন “এখনো মাথার পরিশ্রম নিষেধ। শিলাইদহে নির্জ্জনে পালাইয়া আসিয়াছি।”

“রবিজীবনী” বই থেকে সেটার স্ক্রিনশট দেখুন-

২৮ মার্চ দাবি করা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কলকাতার গড়ের মাঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সভায় সভাপতিত্ব করেছলেনস। কিন্তু সেইদিনও তিনি কুষ্টিয়ার শিলাইদহে অবস্থান করছিলেন। ২৮ মার্চ তারিখেই তিনি শিলাইদহে বসে জগদানন্দকে চিঠি লেখেন। চিঠিটি পড়ুন এখানে-

“কয়দিন এখানে এসে সুস্থ বোধ করছিলুম। মনে করছিলুম সেদিন যে ধাক্কাটা খেয়েছিলুম সেটা কিছুই নয়। সুস্থ হয়ে উঠলেই অসুখটাকে মিথ্যে বলে মনে হয়। আবার আজ দেখি সকাল বেলা মাথাটা রীতিমত টলমল করচে। কাল বুধবার ছিল বলে, কাল সন্ধ্যাবেলায় মেয়েদের নিয়ে একটু আলোচনা করছিলুম- এটুকুতেই আমার মাথা যখন কাবু হয়ে পড়ল তখন বুঝতে পারচি নিতান্ত উড়িয়ে দিলে চলবে না।”

 

চিঠিটির স্ক্রিনশট দেখুন এখানে-

এই চিঠিটি পাঠানোর পরপরই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আবার তার লেখার জগতে ঢুকে পড়লেন। শিলাইদহে বসে রবীন্দ্রনাথ ১৫ দিনে ১৭টি গান বা কবিতা রচনা করেছিলেন। সেগুলোর তারিখও পাশে লেখা আছে। সেসবের স্ক্রিনশট দেখুন নিচে –

 

কবি শান্তিনিকেতনে নতুন বাংলা বছর শুরু করতে চেয়েছিলেন। এ কারণে ১২ই এপ্রিল শিলাইদহ ছেড়ে কলকাতার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। তিনি ১৩ই এপ্রিল শান্তিনিকেতনে পৌঁছান।

উপরের তথ্যটির স্ক্রিনশট দেখুন এখানে-

এই আলোচনা থেকে বলা যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ২৪ মার্চ থেকে ১২ এপ্রিল শিলাইদহে ছিলেন। তাই তাঁর পক্ষে ২৮ মার্চ কলকাতার গড়ের মাঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাবিরোধী প্রতিবাদে অংশগ্রহণ করা সম্ভব ছিল না।

তাছাড়া পূর্বে ভাইরাল হওয়া পোস্টগুলোতে রবীন্দ্রনাথ গড়ের মাঠে উপস্থিত ছিলেন এই দাবির পক্ষে নীরদ চন্দ্র চৌধুরী তার অটোবায়োগ্রাফি অব এন আননোন ইন্ডিয়ান গ্রন্থের উল্লেখ করা হয়।কিন্তু সারা বাংলার রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে নীরদ চন্দ্র চৌধুরীর সারা বই খুঁজে এই দাবির স্বপক্ষে কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন এই দাবীর বিপক্ষে যুক্তি দিয়ে বিভিন্ন সময় বাংলাদেশের মূল গণমাধ্যমগুলো বেশ কিছু অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রচার করেছে। এমনই কিছু প্রতিবেদন দেখুন এখানে, এখানে, এখানে,এখানে

 


তাছাড়া ১৯১২ বা কাছাকাছি সময়ে  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন, এমন কোন সংবাদ তৎকালীন গণমাধ্যমে পাওয়ার প্রমাণ মেলেনি।

প্রসঙ্গ : ড. শ্রী রমেশচন্দ্র মজুমদার 

আলোচ্য গুজব পোস্টে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেন ভিসি এবং ইতিহাসের অধ্যাপক শ্রী রমেশচন্দ্র মজুমদার এর আত্মজীবনী ‘জীবনীর স্মৃতিদ্বীপে’ বইটিকে রেফারেন্স হিসেবে দেখানো হয়েছে। এখানে দাবি করা হয়েছে, রবীন্দ্রনাথ সহ সকল বাঙ্গালী হিন্দু নেতা ও বুদ্ধিজীবি ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার চরম বিরোধীতা করেন। — কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি স্যার আশুতোষ মুখার্জীর (রবীন্দ্রনাথের ভাইঝি জামাতা) নেতৃত্বে সেই সময়কার ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জকে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন না করার জন্য ১৮ বার স্মারকলিপি দিয়ে চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল। নীচতা এত নীচে নেমেছিল যে, তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বিদ্রুপ করে বলতেন মক্কা বিশ্ববিদ্যালয়।


২৫৮ পৃষ্ঠার ‘জীবনের স্মৃতিদ্বীপে’ বইটা পড়তে গিয়ে এর কোথাও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কে মক্কা বিশ্ববিদ্যালয় সম্বোধন এর প্রমাণ পাওয়া গেল না।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভিসি স্যার আশুতোষ মুখার্জী প্রাথমিকভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধীতা করেছিলেন ঠিকই , তবে বইয়ের বর্নণা থেকে জানা যায়, এই প্রতিবাদ ছিল অনানুষ্ঠানিক। স্মারকলিপি প্রদান এর কোনো উল্লেখ এই বইয়ে নেই। বরং বইয়ের ৪৪-৪৫ পৃষ্ঠা থেকে জানা যাচ্ছে , বড়লাট এর সাথে এক সাক্ষাতে স্যার আশুতোষ মুখার্জী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় সম্মত হয়েছিলেন। লেখক (শ্রী রমেশচন্দ্র মজুমদার) সহ বেশ কয়েকজন শিক্ষককে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরির অনুমতি দিয়েছিলেন।

‘জীবনের স্মৃতিদ্বীপে’ বইটি হেকে জানা যাচ্ছে, যে তৎকালীন অনেক বাঙালী হিন্দু নেতা ও বুদ্ধিজীবি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধীতা করেছিলেন , এটা ঠিক। এদের মধ্যে রাসবিহারী ঘোষ এবং গুরুদাস বন্দোপাধ্যায় বিশেষ উল্লকেহযোগ্য ছিলেন বলে লেখক উল্লেখ করেছেন। তবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামে এমন কোনো অভিযোগ করেন নি।

লেখকের আমন্ত্রণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সফরে আসেন ১৯২৬ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কবিকে বিপুল সম্বর্ধনা দেওয়া হয়। এখানে তিনি একাধিক ভাষণ দেন। এসব সফরের বিস্তারিত বিবরণ ও রমেশচন্দ্র মজুমদার বইয়ে অন্তর্ভুক্ত করেছেন (পৃষ্ঠা ২০৯-২২০)। তবে রবীন্দ্রনাথ এর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিরোধীতার কোনো প্রমাণ এই বইয়ে নাই।

অন্যান্য দাবি

ভাইরাল হওয়া পোস্টে আরও দাবি করা হয়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক অনুষ্ঠানে এদেশের মানুষকে তীব্রভাবে কটাক্ষ করে বলেছিলেন “সাত কোটি সন্তানের হে মুগ্ধ জননী, রেখেছো বাঙালী করে মানুষ কর নি”। এটি বঙ্গমাতা কবিতার শেষ দুই লাইন। উইকিপিডিয়া থেকে জানা যাচ্ছে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই কবিতাটা অসন্তুষ্ট হয়ে এই কামনা করে লিখেছিলেন যেন বাঙালিরা বঙ্গদেশের প্রতি কর্তব্য ঠিকভাবে পালন করে। কবিতাটি চৈতালি কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত যেটি ১৮৯৬ সালে লেখা হয়। সেময় বাংলাদেশ নামে আলাদা কোন রাষ্ট ছিলো না। তখন বাংলাদেশ, কলকাতা এবং আসাম একসাথে বাংলা বা বঙ্গদেশ নামে পরিচিত ছিলো। তাই এটি আলাদাভাবে বাংলাদেশের মানুষদের কটাক্ষ করে লেখা হয়নি।

 

তাছাড়া পূর্বে ভাইরাল হওয়া পোস্টে দাবি করা আশুতোষ মুখোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাইজির জামাতা। কিন্তু ফ্যাক্টওয়াচের এক অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রীর নাম যোগমায়া দেবী। তার নামে যোগমায়া দেবী কলেজ নামে একটি কলেজও আছে। কিন্তু যোগমায়া দেবী নামে রবীন্দ্রনাথের কোন ভাইঝি থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ফ্যামিলি ট্রি  দেখুন এখানে

 

সার্বিক বিবেচনায় ভুল তথ্যসম্বলিত এসব ফেসবুক পোস্টকে ফ্যাক্টওয়াচ ‘মিথ্যা’ সাব্যস্ত করছে ।

 

আরো পড়তে পারেন-

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে ভাইরাল হওয়া এই  গুজব গুলো

রবীন্দ্রনাথ কি নজরুলের লেখা চুরি করে নোবেল পেয়েছেন?

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কি আসলেই নাইটহুড বর্জন করেছিলেন?

 

আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন?
কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন?
নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?

এসবের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে জানান।
আমাদেরকে ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh

Leave a Reply