মহিলা ভলিবল খেলোয়াড় মেহজাবিনকে তালিবানরা হত্যা করে নি

Published on: October 25, 2021

মেহজাবিন হাকিমি নামক একজন আফগান মহিলা-ভলিবল-খেলোয়াড়কে শিরোশ্ছেদের মাধ্যমে হত্যা করেছে তালেবানরা – এমন একটি খবর  ফেসবুকে পাওয়া যাচ্ছে। ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, এই দাবি সত্য নয়।  তিনি নিহত হয়েছিলেন গত আগস্ট মাসে, যার মৃত্যুর সাথে তালেবানদের কোনো সম্পর্ক ছিল না।

বিভ্রান্তির উৎস

২১শে অক্টোবর থেকে বাংলাদেশের ফেসবুক অঙ্গনে এই সংক্রান্ত খবর দেখা যায় । এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে ,এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে

মূলত বেশকিছু অনলাইন সংবাদমাধ্যম এবং কয়েকটি মূলধারার গণমাধ্যমের মাধ্যমে এই খবরটা ভাইরাল হয়। এসব সংবাদমাধ্যমের মধ্যে রয়েছে দৈনিক সমকাল, বাংলা ট্রিবিউনএকুশে টিভি ,  আমাদের সময় , জি ২৪ ঘন্টা, বিডি জার্নাল , পূর্ব পশ্চিম বিডি , স্বাধীন নিউজ , বাংলাদেশ টুডে, ক্যারিয়ার বিডি, RTNBD , ভোরের পাতা , অনন্যা , বাংলাদেশের কথা , প্রাইম নিউজ বিডি , বাংলা হেলথ কেয়ার

আন্তর্জাতিক অঙনে এই খবরের উৎস খুজতে গিয়ে দেখা গেল,  গত ২০ অক্টোবর,২০২১ থেকে বিভিন্ন ভারতীয় গণমাধ্যমে তালেবান দ্বারা ভলিবল খেলোয়াড় মেহজাবিন হাকিমির শিরোশ্ছেদের সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে কয়েকটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও সংবাদটি প্রচারিত হয় (এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে)। এর মধ্যে  কয়েক জায়গায় Independent Persian-কে সোর্স হিসেবে উল্লেখ করা হয় যারা দাবি করেছে ভলিবল টিমের কোচ সুরাইয়া আফজালি বলেছেন মেহজাবিনকে অক্টোবর মাসের শুরুতে হত্যা করা হয়, কিন্তু তার পরিবার হুমকির সম্মুখীন হওয়ায় বিষয়টি চাপা দিয়ে রাখে।

 

টুইটারে গত ২০ অক্টোবর থেকে #MahjabinHakimi-এর মাধ্যমে তালেবানের হাতে মেহজাবিন হাকিমির নিহত হওয়ার সংবাদ বিভিন্ন একাউন্ট থেকে বহুবার টুইট ও রিটুইট করা হয়েছে।

কি বলা হচ্ছে এই খবরে ?

independentpersian.com ওয়েবসাইটে মূল খবরটাকে ট্রান্সলেটর এর সাহায্যে বাংলায় অনুবাদ করে যা পাওয়া গেল তা এখানে উদ্ধৃত করা হল-

আফগান মহিলা জাতীয় ভলিবল দলের প্রাক্তন সদস্য মাহজাবিন হাকিমিকে কাবুলে তালেবানরা জবাই করেছে (শিরশ্ছেদ করে)। ফার্সি ইনডিপেনডেন্টকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে, আফগান মহিলা জাতীয় ভলিবল দলের অন্যতম কোচ সুরায়া আফজালি (ছদ্মনাম), ক্রীড়াবিদকে হত্যা করার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন । কিন্তু বলেছেন যে মাহজাবিনের পরিবার ছাড়া অন্য কেউ হত্যাকান্ডের সঠিক সময় এবং বিবরণ জানেন না  ।  মাহজাবিন পূর্ববর্তী আফগান সরকারের পতনের আগে কাবুল মিউনিসিপ্যালিটি ভলিবল ক্লাবের হয়ে খেলেছিলেন এবং ক্লাবের অন্যতম সফল খেলোয়াড় ছিলেন।

সুরায়া আফজালি বলেছিলেন যে মাহজাবিন হাকিমির হত্যার ঘটনা সম্ভবত অক্টোবরের প্রথম দিকে ঘটেছিল, এবং বিষয়টি গোপন ছিল কারণ তার পরিবারকে এই বিষয়ে কারও সাথে কথা না বলার হুমকি দেওয়া হয়েছিল। আফজালির মতে, পূর্ববর্তী সরকারের পতনের পর, আফগানিস্তান জুড়ে মহিলা ক্রীড়াবিদরা একটি গুরুতর নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন হয় এবং তালেবানরা তাদের তাড়া করে এবং বিভিন্ন শহরে তাদের অনেকের বাড়িতে তল্লাশি চালায়। অনেক মহিলা ক্রীড়াবিদ, বিশেষ করে আফগান মহিলা ভলিবল দলের সদস্যরা যারা বিদেশী এবং ঘরোয়া প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছে এবং মিডিয়া প্রোগ্রামে উপস্থিত হয়েছে, তারা গুরুতর হুমকির মধ্যে রয়েছে।

আফগান মহিলা জাতীয় ভলিবল দলের কোচ বলেছেন যে দলের মাত্র দুজন খেলোয়াড় ব্যক্তিগত পদক্ষেপের মাধ্যমে আফগানিস্তান ত্যাগ করতে পেরেছেন এবং আফগানিস্তানের ভিতরে দলের বাকি সদস্যরা বিপদ ও আতঙ্কে রয়েছেন। “ভলিবল দলের সকল খেলোয়াড় এবং বাকি মহিলা ক্রীড়াবিদরা খারাপ পরিস্থিতি এবং হতাশা ও ভয়ের মধ্যে রয়েছে,” মিসেস আফজালি বলেন। “সবাই পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে অজানা জায়গায়।”

আফগানিস্তান মহিলা জাতীয় ভলিবল দলের সদস্যদের দ্বারা আফগানিস্তান ত্যাগ করার জন্য বিদেশী সংস্থা এবং দেশগুলির সমর্থন অর্জনের প্রচেষ্টা এখনও পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছে৷ মাহজাবিনের মৃত্যু তালেবান  দ্বারা লক্ষ্যবস্তু হওয়ার আশঙ্কা বাড়িয়েছে যারা দীর্ঘদিন ধরে মহিলাদের খেলাধুলা ব্যাহত করতে চেয়েছিল। তালেবান আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার সাথে সাথে, ক্রীড়া, রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে সমস্ত নারীর কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে এবং সামাজিক ক্ষেত্রে সক্রিয় নারীদের জীবন ও কর্ম এবং নিরাপত্তার উপর অব্যাহত বিধিনিষেধ নিয়ে এখনও উদ্বেগ রয়েছে।

 আফগান জাতীয় মহিলা ভলিবল দল প্রথম 1978 সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল । কিন্তু 1992 থেকে 2002 পর্যন্ত গৃহযুদ্ধ এবং তারপর তালেবান শাসনের কারণে কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। আফগান মহিলা জাতীয় ভলিবল দল দুটি বয়সের গ্রুপ, প্রাপ্তবয়স্ক এবং যুবদের মধ্যে খেলেছে এবং প্রতিটি বয়সের গ্রুপে 14 জন সদস্য ছিল। দলটি প্রতি বছর বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছে এবং এই অঞ্চলের কিছু প্রতিযোগিতায় পুরষ্কারও জিতেছিল। আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় দলের অংশগ্রহণ বরাবরই আফগানিস্তানের অভ্যন্তরে ব্যাপকভাবে সমর্থিত এবং আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় আফগান মেয়েদের উপস্থিতি ঐতিহ্যবাহী আফগান সমাজে নারীদের অবস্থানকে শক্তিশালী করার প্রচেষ্টার নিদর্শন হিসেবে ধরা হয়।

 বিচ্ছিন্ন ও রক্তাক্ত গলায় মেহজাবিন এর  প্রাণহীন ছবি আফগান সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে।

বাংলা ভাষায় বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম মূলত এই উৎস থেকে তথ্য নিয়েই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে , এবং ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এই কথাগুলোই বলেছে।

পরবর্তীতে এই খবরটা বাংলাদেশে বিভিন্ন ফেসবুক ব্যবহারকারী ভিন্ন ক্যাপশনে শেয়ার করতে থাকেন। যেমন-২২ অক্টোবর, ২০২১ তারিখ রাত ৯ঃ৫১ টায় Ali Akbar Tabi নামক একটি বাংলাদেশী ব্যক্তিগত ফেসবুক প্রোফাইল থেকে একটি ছবিসহ পোস্ট করা হয় – “গলা কেটে তালেবানরা নৃশংসভাবে হত্যা করলো আফগান মহিলা খেলোয়ারকে। নারী হয়ে খেলাধূলা করার অপরাধে ভলিবল দলের জুনিয়র খেলোয়াড় মাহজ়বিন হাকিমিকে আফগানিস্তানের তালেবানরা অমানুষিক নির্যাতনের পর গলা কেটে হত্যা করেছে।

সেদিন রাত ১১ঃ ৪২ টায় Rafiqul Islam Chowdhury নামক আরেকটি প্রোফাইল থেকে একই ছবিসহ পোস্ট করা হয় – “Mahjabeen Hakimi a women volleyball player of Afghanistan is beheaded by Taliban. This present situation of Afghanistan.”।

২৩ অক্টোবর Abdus Salam Neeru নামক প্রোফাইল থেকে পোস্ট করা হয় – “মেহজাবিন হাকিমি নামে এক মহিলা ভলিবল খেলোয়াড়ের শিরশ্ছেদ করেছে তালেবান সরকার। খেলাধুলা করাই মেয়েটির জীবনের কাল হলো। এই তালেবানের জন্য আমাদের কতজনের মন আনচান করে।”

 মেহজাবিন হাকিমির হত্যাকান্ডের খবর পেয়ে ইটালির একটি ভলিবল টিম তাদের খেলার আগে এক মিনিট নীরবতাও পালন করেছিল গত ২১শে অক্টোবর।

ফ্যাক্টওয়াচ অনুসন্ধান


বিভিন্ন বাংলা অনলাইন পোর্টালে সোনালী চুলের যে তরুনীর ছবিটি ব্যবহার করা হয়েছে , অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, সেটি মেহজাবিন হাকিমির ছবি নয়। এটি তানিয়া লেইডার নামে এক আমেরিকান টিকটক তারকার ছবি। উক্ত ছবিটি তিনি তার ইনস্টাগ্রাম একাউন্টে ২০২১ সালের ৭ই জানুয়ারি আপলোড করেছিলেন।

অন্যান্য বিভিন্ন উৎস থেকে পাওয়া মেহজাবিন হাকিমির ছবিতে দেখা যাচ্ছে, , মেহজাবিনের চুল কালো রঙের , এবং প্রকাশিত ছবির সাথে তার কোনো মিল নেই ।

Mahjabin Hakimi: Atleta de vôlei de 18 anos é assassinada pelo Talibã por jogar sem véu | Capricho

গত ২১ অক্টোবর ভারতীয় ফ্যাক্ট-চেকিং সাইট Alt News বিষয়টি অনুসন্ধান করে  “Media misreports Afghan women’s volleyball player beheaded by Taliban” শিরোনামে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে । রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, মেহজাবিন হত্যার সংবাদ প্রচার শুরু হওয়ার পর থেকে সোশাল মিডিয়া ব্যবহারকারীদের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে থাকে।

Tolo News-এর সাবেক প্রধান Miraqa Polpal, আফগান নারী অধিকারকর্মী Wazhma Frogh এবং Zaki Dariyabi টুইটারে লেখেন তালেবানের হাতে মেহজাবিন হাকিমির শিরোশ্ছেদের সংবাদ সত্য নয়, তিনি আত্মহত্যা করেছেন এবং সেটি তালেবানরা কাবুল দখলের ১০ দিন আগে।

Alt News মেহজাবিনের ভাই সিকান্দার হাকিমির ফেসবুক প্রোফাইল অনুসন্ধান করে দেখে, ৭ আগস্ট তিনি একটি কালো ব্যাকগ্রাউন্ডের প্রোফাইল পিকচার আপলোড করেন এবং কমেন্টে পারস্য ভাষায় সমবেদনা জানিয়ে ১০০-রও বেশি কমেন্ট করা হয়।

Alt News মেহজাবিনের পরিবারের একজন সদস্যের সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম হয় এবং তিনি সিকান্দার হাকিমিকে মেহজাবিন হাকিমির ভাই হিসেবে নিশ্চিত করেন। সদস্যটি জানান, মেহজাবিন ২০২০ সালে মজিদ খান নামক একজন ব্যক্তির সাথে বাগদান করেন , এবং কাবুলে মজিদ খানের যৌথ পরিবারের সাথে থাকতে শুরু করেন। মেহজাবিন আমেরিকা থেকে একটি স্কলারশিপ পান, যেটি মজিদ খানের পরিবারের সাথে তার ঝামেলার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। তিনি দাবি করেন, মেহজাবিনকে কাবুলে তার বাগদত্তার বাথরুমে গত ৬ আগস্ট মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। বাগদত্তার ভাষ্যমতে মেহজাবিন আত্মহত্যা করেছেন। কিন্তু মেহজাবিনের পরিবারের সন্দেহ এর পেছনে তার বাগদত্তার পরিবারের হাত রয়েছে। তিনি মেহজাবিনের কিছু ছবি শেয়ার করেন, এবং একটি সমাধিফলকের ছবি পাঠান যেখানে মেহজাবিনের নাম লেখা রয়েছে (ছবিতে নীল রঙ) এবং পারস্য ক্যালেন্ডারের হিসেবে মৃত্যুসাল লেখা রয়েছে ১৫-৫-১৪০০ (সবুজ রঙ), যাকে ইংরেজি ক্যালেন্ডারে রূপান্তরিত করলে তারিখটি পাওয়া যায় ৬ আগস্ট।

Alt News ২২ আগস্টে অনুষ্ঠিত মেহজাবিন হাকিমির স্মরণ অনুষ্ঠানের দাওয়াতপত্রের সন্ধান পায়। সেখানে ছাপা মেহজাবিনের ছবিটির সাথে মেহজাবিনের পরিবারের সদস্যের দেওয়া ছবির সাদৃশ্য পাওয়া যায়।

 

 

Alt News এই রিপোর্টটি করার পর দ্য সান পত্রিকা এই রিপোর্টকে উল্লেখ করে ‘দাবি প্রত্যাখ্যান’ শিরোনামে একটি রিপোর্ট করে। ভারতের দ্য ব্রিজ পত্রিকা পূর্বে তালেবান দ্বারা মেহজাবিন হত্যার খবর প্রকাশ করেছিলো। পত্রিকাটি Alt News-কে সোর্স উল্লেখ করে একটি সংশোধনীমূলক রিপোর্ট প্রকাশ করে।

পরবর্তীতে , ভারতের জি নিউজ , ডিএনএ ইন্ডিয়া , The bridge ,  toysmatrix সহ আরো কয়েকটি সংবাদমাধ্যম জানায়, মেহজাবিন হাকিমিকে তালেবান বাহিনী হত্যা করেনি।


ফ্যাক্টওয়াচের
সিদ্ধান্ত

অনুসন্ধানের পর ফ্যাক্টওয়াচের সিদ্ধান্ত হলো, ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া মেহজাবিন হাকিমিকে শিরোশ্ছেদের মাধ্যমে তালেবানরা হত্যা করেছে  – সংবাদটি মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর। মেহজাবিন হাকিমির মৃত্যু হয় আগস্ট মাসে, পরিবার থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী মৃত্যুর কারণ হলো আত্মহত্যা অথবা বাগদত্তার পরিবার দ্বারা হত্যা। আফগানিস্তানের স্থানীয় সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী এবং আন্তর্জাতিক ফ্যাক্টচেকাররা এই খবরটিকে ‘গুজব’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। সার্বিক বিবেচনায় ,ফ্যাক্টওয়াচ এই খবরটিকে ‘মিথ্যা’ সাব্যস্ত করছে।

আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন?
কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন?
নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?

এসবের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে জানান।
আমাদেরকে ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh

Leave a Reply