এনআইডি থাকলেই দু’হাজার টাকা আয়কর দিতে হবে?

Published on: June 3, 2023

সম্প্রতি জাতীয় সংসদে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এই বাজেটে অর্থমন্ত্রী একটি প্রস্তাব দিয়েছেন যে, যাদের আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে হয় কিন্তু আয় করমুক্ত সীমার নিচে রয়েছে তাদেরকে আগামী অর্থবছর থেকে সর্বনিম্ন দুই হাজার টাকা কর দিতে হবে। অর্থমন্ত্রীর এই প্রস্তাবটিকে কেন্দ্র করে সামাজিক মাধ্যমে একটি পোস্ট ভাইরাল হয়েছে যেখানে দাবি করা হচ্ছে যে, আয় না থাকলেও যাদের এনআইডি (NID) বা জাতীয় পরিচয়পত্র রয়েছে তাদেরকে দুই হাজার টাকা কর দিতে হবে। এটি সত্য নয়। প্রকৃতপক্ষে, এনআইডি নয় বরং, যাদের টিআইএন (TIN) বা ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার রয়েছে এবং যাদের কোন প্রয়োজনে আয়কর রিটার্ন বা বিবরণী দাখিল করতে হয়, তাদেরকে দুই হাজার টাকা আয়কর দিতে হতে পারে। উল্লেখ্য, বর্তমানে বাংলাদেশে করমুক্ত আয়সীমা হচ্ছে তিনলাখ টাকা এবং ৬৫ বছরের বেশি বয়সী নাগরিক এবং নারীর ক্ষেত্রে এই আয়সীমা হচ্ছে সাড়ে তিনলাখ টাকা। তবে, রিটার্ন দাখিলে দুই হাজার টাকা কর দেওয়ার প্রস্তাবটি জাতীয় সংসদে পাশ হলে যাদের আয়সীমা তিনলাখ বা সাড়ে তিনলাখ টাকার নিচে এবং যাদের টিআইএন (TIN) রয়েছে তাদেরকে ঐ দুই হাজার টাকা দিতে হবে। সঙ্গত কারণে ফ্যাক্টওয়াচ সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত “এনআইডি (NID) থাকলে দিতে হবে দুই হাজার টাকা কর” শীর্ষক পোস্টের দাবিটিকে “মিথ্যা” বলে সাব্যস্ত করছে।

এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এবং এখানে

Image: Example of a viral Facebook post

 

ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধান:

সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত পোস্টের দাবিটি সঠিক কিনা তা যাচাই করতে আমরা প্রাসঙ্গিক কিছু কিওয়ার্ড ব্যবহার করে গুগল সার্চ করি এবং মূলধারার সংবাদমাধ্যমের বেশকিছু সংবাদ খুঁজে পাই। ১লা জুন ২০২৩ বিবিসি নিউজ বাংলা থেকে প্রকাশিতবাজেটে আয়কর সম্পর্কে যা বলা হয়েছেশীর্ষক শিরোনামের সংবাদটিতে বলা হয়েছে, কোন টিআইএন (TIN) বা ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নাম্বারধারী ব্যক্তি যখন আয়কর রিটার্ন জমা দিতে যাবে তখন তাকে সর্বনিম্ন দুই হাজার টাকা কর দিতেই হবে এবং সেক্ষেত্রে তার আয়সীমা করমুক্ত থাকুক বা না থাকুক। বাজেট ঘোষণাকালে অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল বলেন, “করমুক্ত সীমার নিচে আয় রয়েছে অথচ সরকার হতে সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে আয়কর রিটার্ন দাখিলের বাধ্যবাধকতা রয়েছে এমন সকল করদাতার ন্যূনতম কর দুই হাজার টাকা করার প্রস্তাব করছি।অর্থাৎ, এখানে স্পষ্ট বলা আছে যারা টিআইএন-ধারী শুধু তারাই আয়কর রিটার্ন জমাকালে দুই হাজার টাকা কর দেবে।

Image: Excerpt from the BBC News Bangla’s article

 

আয়কর রিটার্ন জমাকালে দুই হাজার টাকা কর প্রস্তাব সম্পর্কিত আরও কিছু সংবাদ পড়ুন এখানে এবং এখানে

 

টিআইএন (TIN) এবং আয়কর রিটার্ন কি?

টিআইএন (TIN) বা ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার হচ্ছে একটি বিশেষ নাম্বার যার সাহায্যে একজন করদাতাকে শনাক্ত করা হয়। একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ আয়কারী ব্যক্তির জন্য টিআইএন থাকা বাধ্যতামূলক। নতুন ব্যবসা শুরু করতে ট্রেড লাইসেন্স নেওয়া, সঞ্চয়পত্র ক্রয় করা, ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া, ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করা, কোন সম্পদ ক্রয় করা, পণ্য আমদানির লাইসেন্স নেওয়া প্রভৃতি কাজে টিআইএন থাকা আবশ্যক। তাছাড়া, ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সরকারি প্রণোদনা পেতে একটি টিআইএন থাকলে তা অনেক সহজ হয়ে যায়। কেন টিআইএন প্রয়োজন পড়ুন এখানে

অন্যদিকে, আয়কর রিটার্ন হচ্ছে আয়কর কর্তৃপক্ষের নিকট বাৎসরিক আয়ের সংক্ষিপ্ত বিবরণ উপস্থাপন করার একটি মাধ্যম যার সাহায্যে আয়কর কর্তৃপক্ষ অবগত হতে পারে যে একজন ব্যক্তি আয়কর দেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছেন কিনা। তাছাড়া, সরকারি বিভিন্ন সেবা পেতে একজন ব্যক্তিকে আয়কর কর্তৃপক্ষ থেকে একটি আয়কর রিটার্ন সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে তা দাখিল করতে হয়। মূলত এই আয়কর রিটার্ন দাখিলকারীদের দুই হাজার টাকা কর প্রদানের প্রস্তাব দেওয়া হয় সর্বশেষ বাজেটে। 

অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল জানান, “বর্তমানে দেশে টিআইএনধারীর সংখ্যা প্রায় ৮৮ লাখ, যদিও বেশির ভাগই নিয়মিত রিটার্ন দাখিল করেন না। সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে ২০২১২২ অর্থবছরের তুলনায় বর্তমান অর্থবছরে (২০২২২৩) রিটার্ন দাখিলকারীর হার ২৫ শতাশ বেড়ে ৩২ লাখে উন্নীত হয়েছে।অর্থাৎ, তাঁর এই উদ্ধৃতিটি থেকে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে যে, যাদের ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার রয়েছে কেবল তারাই আয়কর রিটার্ন দাখিল করবে এবং নতুন বাজেটের প্রস্তাবনা অনুযায়ী প্রত্যেক আয়কর রিটার্ন দাখিলকারীকে আয়কর দিতে হবে। এখানে এনআইডি বা জাতীয় পরিচয়পত্রের কথা কোথাও উল্লেখ করা হয়নি। দেখুন এখানে 

Image: Excerpt from the bdnews24’s article

 

তবে, গত ২৭ মে ২০২৩ অর্থাৎ, ২০২৩২০২৪ বাজেট ঘোষণার পাঁচদিন আগে প্রথম আলোতে প্রকাশিতজাতীয় পরিচয়পত্র থাকলেই আয়কর রিটার্নের পক্ষে পররাষ্ট্রমন্ত্রীশীর্ষক শিরোনামের একটি সংবাদ মারফত জানা গেছে যে, করের আওতা বাড়াতে যাদের এনআইডি বা জাতীয় পরিচয়পত্র আছে তাদের আয়কর রিটার্ন দাখিল করা উচিত বলে মনে করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কে আব্দুল মোমেন। তিনি আরও বলেন, “যাঁদের এনআইডি আছে, সবাইকে করের আওতায় আনতে পারলে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় কর সংগ্রহের হার বাড়বে। আমি মুহিত ভাইকে (সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত) বলেছিলাম যুক্তরাষ্ট্রে যাঁদের সোশ্যাল সিকিউরিটি কার্ড আছে, তাঁদের কর দিতে হয়। তবে যাঁদের আয় সাড়ে তিন হাজার ডলারের নিচে, তাঁদের কিছু দিতে হয় না। অথচ আমাদের দেশে করদাতারা কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) নেওয়া পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। এখন এটা আমার দাবি। যাঁরই এনআইডি থাকবে, তাঁকেই রিটার্ন দাখিল করতে হবে।পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বক্তব্য থেকে মনে হতে পারে যে যাদের এনআইডি আছে তাদেরকে আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে হবে। তবে, এখানে তিনি শুধু তাঁর মতামত দিয়েছেন মাত্র। তাছাড়া, আয়কর সম্পর্কিত কোন ঘোষণা আসলে তা সম্পর্কিত মন্ত্রণালয়ের কোন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা অর্থাৎ, অর্থমন্ত্রী মারফত আসবে।

Image: Excerpt from the Daily Prothom Alo

 

২০২৩২০২৪ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণাকালে আয়কর রিটার্ন দাখিলকারীদের দুই হাজার টাকা কর প্রদানের প্রস্তাব পেশকালে অর্থমন্ত্রী এমন কিছু বলেননি যে এনআইডি থাকলেই আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে হবে।

উল্লেখ্য, সর্বশেষ বাজেট ঘোষণার প্রায় দশদিন আগে অর্থাৎ, ২২ মে ২০২৩ দি ডেইলি স্টার বাংলায় প্রকাশিতসরকারি ৪০ সেবা পেতে রিটার্ন দাখিলের সঙ্গে দিতে হতে পারে ন্যূনতম আয়কর”  শীর্ষক শিরোনামের একটি সংবাদে বলা হয়েছে যে, সরকারি কোন সেবা পেতে হলে আয়কর রিটার্ন দাখিলের পাশাপাশি করদাতাকে ন্যূনতম কর দেওয়ার আইন করতে পারে সরকার অর্থাৎ, কর পরিশোধ ছাড়া আয়কর রিটার্ন দাখিলের সুযোগ আর নাও থাকতে পারে। সংবাদটিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে যে, “নাগরিকের আয় না থাকলেও, রিটার্ন দাখিল করে ওইসব সরকারি সেবা পেতে আগামী অর্থবছর থেকে করদাতাদের ন্যূনতম হাজার টাকা আয়কর দিতে হবে।অর্থাৎ, ২০২৩২০২৪ অর্থবছরের বাজেটে এরকম একটি প্রস্তাব আসতে পারে তা আগেই ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছিলো।

Image: Excerpt from the Daily Star Bangla’s article

 

অতএব, সামাজিক মাধ্যমেএনআইডি বা জাতীয় পরিচয়পত্র থাকলেই দিতে হবে আয়করশীর্ষক যে দাবিটি ভাইরাল হচ্ছে তার কোন সত্যতা নেই।

সুতরাং, সবকিছু বিবেচনা করে ফ্যাক্টওয়াচ সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত পোস্টের দাবিকেমিথ্যাবলে সাব্যস্ত করছে।

আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন?
কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন?
নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?

এসবের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে জানান।
আমাদেরকে ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh