মহাবিশ্বের উষ্ণতা আর বিশ্বের উষ্ণতা এক জিনিস নয়

Published on: October 8, 2021

‘’হাতে আছে অল্প কিছুদিন, ধেয়ে আসছে মহাপ্লাবন ,ধ্বংসের মুখে পৃথিবী, দাবি গবেষকদের’’ –শিরোনামে একটি খবর ভাইরাল হয়েছে। এই খবরে বলা হচ্ছে , মহাবিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের বরফ গলে যাবে দ্রুত, এবং পৃথিবীতে মহাপ্লাবন এর মত ঘটনা ঘটবে ।  তবে ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে এসব দাবির সত্যতা পাওয়া যায় নি। প্রকৃতপক্ষে, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের বাইরে, মহাশূন্যের উষ্ণতা বৃদ্ধি নিয়ে একটি গবেষণার খবর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ছাপা হয়েছিল গতবছর। সেই খবরের সাথে পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধির কোনো সম্পর্ক নেই।

গুজবের উৎস

সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিকে বিভিন্ন পেজ থেকে এই সংক্রান্ত খবরের লিঙ্ক শেয়ার করতে দেখা যায়। তবে গত বছরের নভেম্বর মাস থেকেই বিভিন্ন সময়ে এই খবরটা অনলাইনে দেখা গিয়েছে। এমন কয়েকটি পোস্ট দেখুন এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে


মূলত কয়েকটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল ( যেমন- Dhaka post online , Dhaka songbad , bd update report , public report24 , free tips 24 ,rajshahi24 )  এ এই শিরোনামের নিবন্ধটি শেয়ারের মাধ্যমে খবরটি ভাইরাল হয়েছে। তবে বাংলা ভাষায় মূলধারার কোনো সংবাদমাধ্যমে এমন শিরোনামে কোনো খবর খুজে পাওয়া যায়নি।

এই খবরে বলা হয়েছে, পৃথিবীর তাপমাত্রা ক্রমশ বেড়ে যাওয়ার ফলে বেশ কিছু প্রাণীরা চিরতরে লোপ পেতে পারে। বরফ গলে গিয়ে বাড়তে পারে সমুদ্রের জলস্তর, দেখা দিতে পারে মহাপ্লাবন, পুরোপুরি ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যেতে পারে পৃথিবী।

ওহিও স্টেট ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর কসমোলজি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোপার্টিকল ফিজিক্সের গবেষক জ্যোতির্বিদ য়ি-কুয়ান চিয়াং তাঁর সম্প্রতি প্রকাশিত গবেষণাপত্রে  সাফ জানাচ্ছেন, পৃথিবী আর ব্রহ্মাণ্ডের উষ্ণতা একই সময়ে কাকতালীয় ভাবে বেড়ে চলেছে ঠিকই, কিন্তু এর একটির সঙ্গে অন্যটির কোনও যোগসূত্র নেই। অর্থাৎ বিশ্ব উষ্ণায়ণের জন্য মানুষই দায়ী, মহাজাগতিক কোনও ঘটনা নয়!

চিয়াং বলছেন যে গ্রহ-নক্ষত্র তৈরি হওয়ার সময়ে মহাশূন্যে জন্ম নেয় এক প্রবল অভিকর্ষজ টান। সেই টানে মহাশূন্যের যাবতীয় ডার্ক ম্যাটার আর গ্যাস গিয়ে জমা ‘হতে থাকে এক কেন্দ্রবিন্দুতে, পরিমাণে বাড়তে থাকে ব্রহ্মাণ্ডের উষ্ণতা। যে হেতু এই সৃষ্টিপ্রক্রিয়া এখনও চলছে, তাই উত্তাপও বেড়ে চলেছে।

চিয়াংয়ের গবেষণা বলছে যে বিগত ১০ বিলিয়ন অর্থাৎ ১০০ কোটি বছর সময়ের পরিমাপে ব্রহ্মাণ্ডের উষ্ণ তা বেড়েছে আগের তুলনায় অন্তত ১০ গুণ বেশি।

গবেষণায় দেখা গিয়েছে, বর্তমান সময়ের নিরিখে ব্রহ্মাণ্ডের উষ্ণতার পরিমাণ ৪ মিলিয়ন ডিগ্রি ফারেনহাইট! প্ল্যাঙ্ক আর স্লোয়ান ডিজিটাল স্কাই সার্ভের মাধ্যমে পাওয়া এই তথ্য তুলে ধরে চিয়াং দাবি করেছেন- এই উষ্ণতা যত দিন যাবে বাড়তেই থাকবে, তা কমার কোনও আশা নেই!

এই খবরটি ভাইরাল হওয়ার কারণে বছর জুড়েই বিভিন্ন ওয়েব পোর্টালকে  একই খবর বার বার শেয়ার করতে দেখা যায়।  এমনকি কেউ কেউ তাদের ওয়েব সাইটেই এই খবর একাধিকবার প্রকাশ করেন।

যেমন- publicreport2r তাদের ওয়েবসাইটে ২০২১ সালের ১৮ই মার্চ প্রথমবারের মত প্রকাশ করেছিল। একই খবর একটু ভিন্ন শিরোনামে ২০শে মে ২০২১ তারিখেও প্রকাশিত হয়। দ্বিতীয়বার প্রকাশের সময় নিচের এই অনুচ্ছেদটি মূল খবরে যুক্ত করা হয়ে-

 যার ফলে উচু এলাকা থেকে বরফ গলে নিম্ন দেশগুলোতে হতে প্রাবন  [প্লাবন] । গবেশনায় [গবেষণায়] জানানো সবচেয়ে বেশি হুমকির পথে ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল ও পাকিস্তানসহ আর কয়েকটি দেশ । এসবয়ের আমরা মানবজাতিই দায়ী । সুতরাং এখন থেকে সতর্ক না হলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে ।

ফ্যাক্টচেক

এখানে ,যে গবেষণাপত্রের উল্লেখ করা হয়েছিল, সেটি প্রকাশিত হয়েছিল ২০২০ সালের ১২ই অক্টোবর , দি এ্যাস্ট্রোফিজিকাল জার্নালে। মূল গবেষণাপত্রটি দেখতে পাবেন এখানে

এখানে মহাবিশ্বের গড় তাপমাত্রার তুলনা দেখানো হয়েছে। টেলিস্কোপের সাহায্যে বিভিন্ন সময়ের এবং বিভিন্ন স্থানের মহাশূন্যের তাপমাত্রা পর্যালোচনা করা হয়েছে। দেখানো হয়েছে, ১০০০ কোটি বছর পূর্বের মহাশূন্যের চেয়ে বর্তমান মহাশূন্য ১০ গুণ বেশি উষ্ণ।

এই গবেষণার ফলাফল সেই সময়ে বেশ কিছু পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল । বাংলা ভাষায় ‘প্রহর’ ওয়েব পোর্টালে এই খবর ছাপা হয়েছিল ২০২০ সালের ১৪ই নভেম্বর তারিখে,  শুধুই পৃথিবীই নয়, উষ্ণতা বাড়ছে মহাবিশ্বেরও – জানাচ্ছে গবেষণা  শিরোনামে ।

এছাড়া ইংরেজিতে Science Daily, Science News for Students , Sci news ইত্যাদি বিজ্ঞান বিষয়ক ওয়েব পোর্টালে এই খবরটা পাওয়া যাচ্ছে।

এসব খবরে বলা হয়েছে, বিজ্ঞানী ই-কুয়ান চিয়াং ‘অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নাল’-এ প্রকাশিত গবেষণাপত্রে তিনি দেখিয়েছেন বিগত ১০০০ কোটি ( ১০ বিলিয়ন) বছরে মহাকাশের গড় তাপমাত্রা বেড়েছে প্রায় ১০ গুণ।  এখন তাপমাত্রা মোটামুটি ২০ লাখ ডিগ্রি সেলসিয়াস (২ মিলিয়ন) এর আশেপাশে। ১০ বিলিয়ন বছর আগে এই তাপমাত্রা ছিল ২ লাখ (অর্থাৎ ২০০ হাজার)  ডিগ্রি সেলসিয়াস ।

.কিভাবে বর্তমান সময়ের এবং সুদূর অতীতের তাপমাত্রা পরিমাপ করা হল, সে বিষয়ে কারিগরি বর্ণনা রয়েছে এসব রিপোর্টে।  তবে মহাশূন্যের তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে পৃথিবীতে প্রভাব পড়বে, মেরু অঞ্চলের সব বরফ গলে যাবে, মহাপ্লাবন আসবে – এমন কোনো তথ্য এসব প্রতিবেদনে বলা হয়নি।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বিজ্ঞানীরা বলছেন, মহাশূন্যের জন্ম্য ১৩৮০ কোটি বছর পূর্বে , পৃথিবীর জন্ম ৪৬০ কোটি বছর পূর্বে , পৃথিবীতে মানুষের আগমন ৩ লক্ষ বছর পূর্বে এবং গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর সূচনা ইউরোপে শিল্প বিপ্লব অর্থাৎ ১৭৬০-১৭৮০ সালের পর থেকে। এসবের বহু আগে থেকেই (অর্থাৎ ১০০০ কোটি বছর ধরেই) মহাবিশ্বের উষ্ণতা বেড়ে চলছে।  কাজেই পৃথিবীর সাম্প্রতিক গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর সাথে মহাশূন্যের উষ্ণতা বৃদ্ধির কোনো সম্পর্ক নেই । বিজ্ঞানী ই-কুয়ান চিয়াং (Yi-Kuan Chiang) ও সেকথাই বলেছেন , যে মহাশূন্যের গড় উষ্ণতা বৃদ্ধির সাথে পৃথিবীর গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর কোনো সম্পর্ক নেই।

বাংলা ওয়েব পোর্টালগুলো এই বিষয়ে সংবাদ প্রকাশের সময়ে অতিরঞ্জিতভাবে পৃথিবীর গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর সাথে এই খবরটি  জুড়ে দিয়ে ‘ধেয়ে আসছে মহাপ্লাবন’, হাতে মাত্র ক’টা দিন’ ইত্যাদি শিরোনাম সহযোগে পরিবেশন করছে, যেখান থেকে বিভ্রান্তি ছড়াতে পারে।

এছাড়া, আলোচ্য প্রতিবেদনে আরেকটি অসঙ্গতি লক্ষ্যণীয়। দ্বিতীয় অনুচ্ছেদের শেষ দিকে বলা হয়েছে, বিশ্ব উষ্ণায়ণের জন্য মানুষই দায়ী, মহাজাগতিক কোনও ঘটনা নয়!

কিন্তু তৃতীয় অনুচ্ছেদেই আবার বলা হয়েছে, চিয়াং বলছেন যে গ্রহ-নক্ষত্র তৈরি হওয়ার সময়ে মহাশূন্যে জন্ম নেয় এক প্রবল অভিকর্ষজ টান। সেই টানে মহাশূন্যের যাবতীয় ডার্ক ম্যাটার আর গ্যাস গিয়ে জমা ‘হতে থাকে এক কেন্দ্রবিন্দুতে, পরিমাণে বাড়তে থাকে ব্রহ্মাণ্ডের উষ্ণতা।

অর্থাৎ, আগের অনুচ্ছেদের তথ্যটা এখানে এসে নাকচ হয়ে যাচ্ছে। বিজ্ঞানী চিয়াং বুঝিয়ে দিচ্ছেন, বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্য গ্রহ নক্ষত্র তৈরি  হওয়া (অর্থাৎ মহাজাগতিক ঘটনা) দায়ী। মানুষ বা মানুষের কোনো কর্মকান্ড দায়ী নয়।

প্রসঙ্গ- গ্লোবাল ওয়ার্মিং

গ্লোবাল ওয়ার্মিং কিংবা বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বর্তমান সময়ের বহুল আলোচিত বিষয়। গবেষণায় দেখা গেছে, ১৮৫০-১৯০০ সালের গড় তাপমাত্রার তুলনায় বর্তমান সময়ের গড় তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি বেশি। এই তাপমাত্রা প্রতি দশকে ০.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস করে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে সবচেয়ে বড় যে ক্ষতি হচ্ছে, সেটা হল সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি। আমেরিকা সরকারের claimate.gov ওয়েবসাইট থেকে জানা যাচ্ছে, ১৮৮০ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়েছে ৮ ইঞ্চি। বর্তমান সময়ের কার্যক্রম অব্যাহত থাকলে, ২১০০ সালে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা আরো ১২ ইঞ্চি বেড়ে যাবে। এর ফলে বাংলাদেশ এবং ভারতের সমুদ্র তীরবর্তী নিচু এলাকা পানিতে প্লাবিতে হবে কিংবা জোয়ারের পানি উপকূলের বেশি এলাকায় চলে আসবে।

বাংলাদেশ সরকারের বন ও পরিবেশ মন্ত্রনালয়ের অধীনে ২০১৬ সালে পরিচালিত এই গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, বিগত ৩০ বছর ধরে উপকূলীয় এলাকায় প্রতিবছর ৬-২১ মিলিমিটার করে জোয়ারের পানির উচ্চতা বাড়ছে।

সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ঢাকা শহরের গড় উচ্চতা ১৩.১২ ফুট অথবা ৪ মিটার। বর্তমান গতিতে (অর্থাৎ বছরে ৬ থেকে ২১ মিলিমিটার) করে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পেলে কত বছর পরে ঢাকা শহর জোয়ারের পানির নিচে তলিয়ে যাবে, সেটা পাঠক সহজেই হিসাব করে নিতে পারেন।

World Economic Forum (WEF) এর অপর এক রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে, ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের ১৭% ভূমি পানির নিচে তলিয়ে যাবে।

নিঃসন্দেহে, অদূর ভবিষ্যতে  জলবায়ু পরিবর্তন এর চরম দুর্যোগ এবং এর বিভিন্ন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া অপেক্ষা করছে বাংলাদেশবাসীর জন্য। কিন্তু  আমাদের আলোচ্য প্রতিবেদনে যেভাবে শিরোনাম করা হয়েছে, ‘’হাতে আছে অল্প কিছুদিন, ধেয়ে আসছে মহাপ্লাবন ‘’ সেই শিরোনাম দেখে যেকোনো পাঠক বিভ্রান্ত হতে পারেন।

এছাড়া খবরের মূল অংশে বিজ্ঞানী ই-কুয়ান চিয়াং এর মহাবিশ্বের উষ্ণতা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, যার সাথে পৃথিবীর গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর কোনো সম্পর্ক নেই। শিরোনামে কিংবা খবরের মাঝে পৃথিবীর প্রসঙ্গ যোগ করে বিভ্রান্তি তৈরি করা হয়েছে।

ফ্যাক্টওয়াচের সিদ্ধান্ত

মহাবিশ্বের ঊষ্ণতা সম্পর্কিত ২০২০ সালের অক্টোবরের পুরনো একটি খবর এখন নতুন করে ভাইরাল হয়েছে। সেখানে পৃথিবীর উষ্ণতা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কোনো কথা বিজ্ঞানী ই-কুয়ান চিয়াং না বললেও, এই খবরে সেটা যোগ করা হয়েছে। ‘হাতে আছে অল্প কিছুদিন,ধেয়ে আসছে মহাপ্লাবন’ -এই ধরনের আতঙ্ক সৃষ্টিকারী বাক্য ব্যবহার করা হয়েছে এই খবরে, যা থেকে জনমনে বিভ্রান্তি ছড়াতে পারে।

সার্বিক বিবেচনায় ফ্যাক্টওয়াচ এই খবরকে “বিভ্রান্তিকর” সাব্যস্ত করছে।

 

আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন?
কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন?
নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?

এসবের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে জানান।
আমাদেরকে ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh

 

Leave a Reply