চীনে “কেঁচো বৃষ্টি” হওয়ার মিথ্যা দাবি 

Published on: March 16, 2023

সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমে “বৃষ্টির সঙ্গে আকাশ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে পড়েছে কেঁচো” শিরোনামে একটি ভিডিও সংবলিত পোস্ট শেয়ার হতে দেখা গেছে, যেখানে দাবি করা হচ্ছে চীনের বেইজিং শহরে বৃষ্টির সাথে কেঁচো ঝরে পড়েছে। তবে, সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত ভিডিওটি এবং ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে পাওয়া বেশকিছু টুইটার পোস্ট বিশ্লেষণ করে জানা গেছে যে উক্ত ভিডিওতে গাড়ির উপর দেখতে পাওয়া পোকাসদৃশ বস্তুগুলো কেঁচো নয় বরং পপলার গাছের পুষ্পমঞ্জরী বা পুষ্পগুচ্ছ (catkins/flower cluster), যা চীনে বসন্তকালের একটি সাধারণ দৃশ্য। তাছাড়া, টুইটারে প্রাসঙ্গিক কিছু পোস্টের কমেন্ট বক্সে চীনের নাগরিক এবং সাংবাদিকদের মন্তব্য থেকে জানা গেছে, বেইজিংয়ে গত কয়েকদিনে কোন বৃষ্টি হয় নি এবং বৃষ্টির সাথে কেঁচো ঝরে পড়ার দাবিটি সত্য নয়। সঙ্গত কারণে ফ্যাক্টওয়াচ সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত পোস্টের দাবিটিকে “মিথ্যা” বলে সাব্যস্ত করছে।

সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত এমন কিছু পোস্টের নমুনা দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এবং এখানে

 

চীনে বৃষ্টির সাথে কেঁচো ঝরে পড়ছে – এরকম শিরোনামে কিছু বাংলা এবং ইংরেজি সংবাদমাধ্যমের সংবাদগুলো দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এবং এখানে

 

ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধান:

সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত “বৃষ্টির সঙ্গে আকাশ থেকে পড়লো লাখ লাখ কেঁচো” শিরোনাম সংবলিত একটি ভিডিও যাচাই করে দেখা গেছে, ভিডিওতে দৃশ্যমান চারটি গাড়ির মাঝে একটি কালো গাড়ির উপর কোন কিছু পড়ে নেই। একটু লক্ষ্য করলে দেখতে পাওয়া যাবে কালো গাড়িটি যে পাশে অবস্থিত ঐ একই পাশে একটি বাইক কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে পার্ক করে রাখা হয়েছে এবং ঐ বাইকের ঢাকনার উপরও কোন কিছু পড়ে থাকতে দেখা যায়নি। গাড়ি এবং বাইক দুটোই ফুটপাতের কাছে পার্ক করে রাখা হয়েছে এবং লক্ষ্য করে দেখা গিয়েছে যে ঐ ফুটপাতটিও সম্পূর্ণ পরিষ্কার। তাহলে এখন প্রশ্ন উঠতে পারে এতে কি প্রমাণ হয়? উক্ত ভিডিওটিতে দৃশ্যমান প্রথম এবং দ্বিতীয় গাড়িটির জানালার গ্লাসের উপর খেয়াল করলে গাছ এবং গাছের শাখা-প্রশাখা দেখতে পাওয়া যায়। ধরে নেওয়া যাক, গাড়িগুলোর বিপরীত পাশে অবস্থিত গাছগুলো থেকেই পাতা বা ফুল ঝরে গাড়িগুলোকে ঢেকে দিয়েছে এবং গাছগুলো থেকে দূরে থাকায় ফুটপাতের কাছে যে কালো গাড়ি এবং বাইকটি পার্ক করা আছে সেগুলোর উপর কোন পাতা বা ফুল ঝরে পড়েনি। উক্ত ধারণাটিকে সমর্থন করে এমন কিছু তথ্য-প্রমাণ আমরা খুঁজে পেয়েছি।

 

আমাদের অনুসন্ধানে JournoTurk নামক তুরস্কের ইন্ডিপেন্ডেন্ট জার্নালিস্টদের একটি টুইটার পেইজে একটি ভিডিও সংবলিত পোস্ট খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। উক্ত ভিডিওটি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখা গিয়েছে যে আমাদের পূর্ববর্তী ভাইরাল ভিডিওটির সাথে এর স্থান এবং একটি গাড়ির নাম্বার প্লেট হুবহু মিলে যায়। তবে, টুইটার পেইজে খুঁজে পাওয়া ভিডিওটি অন্য অবস্থান থেকে রেকর্ড করা হয়েছে এবং তখনই আমরা দেখতে পেয়েছি যে গাড়িগুলোর বিপরীতে কিছু গাছ রয়েছে। তাছাড়া, JournoTurk এর ঐ পোস্টে চীনে কেঁচো বৃষ্টি হয়েছে – এই তথ্যকে ভুয়া বলা হয়েছে।

 

এখন দেখা যাক, ভাইরাল হওয়া ভিডিও এবং টুইটার পোস্টের ভিডিওতে গাড়িকে ঢেকে রাখা বস্তুগুলো আসলেই কেঁচো ছিলো নাকি গাছ থেকে ঝরে পড়া ফুল বা পাতা। Insider Paper নামক একটি টুইটার পেইজের একটি পোস্টে ভাইরাল হওয়া ভিডিওটির অনুরূপ একটি ভিডিও দেখতে পাওয়া গেছে এবং ঐ পোস্টের কমেন্টে “Vxujianing” নামক একজন টুইটার ব্যবহারকারী জবাব দিয়েছেন যে, তথ্যটি ভুয়া এবং গাড়িগুলোর উপর যে বস্তুগুলো পড়েছে সেগুলো শুঁয়োপোকা (catetpillar) নয় বরং বসন্তকালে পপলার গাছ থেকে ঝরে পড়া পুষ্পমঞ্জরী বা পুষ্পগুচ্ছ (inflorescences)। এছাড়াও, New York Post নামক টুইটার পেইজের একটি পোস্টের কমেন্টে  “qq2103bb” নামক একজন টুইটার ব্যবহারকারী রিপ্লাই দিয়েছেন যে, ভিডিওতে দেখতে পাওয়া বস্তুগুলো চীনের খুব পরিচিত একটি গাছের পুষ্পগুচ্ছ যা দেখতে অনেকটা পোকার মতন।

 

পপলার গাছের পুষ্পমঞ্জরী বা পুষ্পগুচ্ছ দেখতে কেমন তার আগে জেনে নেওয়া যাক পুষ্পগুচ্ছ বা Catkin কি জিনিস। ব্রিটানিকা এর মতে, পুষ্পগুচ্ছ বা Catkin হচ্ছে অনেকগুলো ফুলের একটি গুচ্ছ যা গাছের কান্ড বা ডাঁট থেকে দুলের মতো ঝুলে থাকে এবং সাধারণত যার কোন পাপড়ি থাকে না। উইলো, বার্চ, বা ওক গাছে পুষ্পগুচ্ছ বা Catkin দেখতে পাওয়া যায়। পুষ্পগুচ্ছ বা পপলার গাছের পুষ্পগুচ্ছ দেখতে কেমন তা দেখুন এখানে, এখানে, এবং এখানে

 

তাছাড়া, ইউ টার্ন, ফ্যাক্টলি, এবং মিসবার এর মতন জনপ্রিয় ফ্যাক্ট-চেকিং ওয়েবসাইটগুলো চীনে বৃষ্টির সাথে কেঁচো বা পোকা পড়ার দাবিকে নাকচ করে দিয়েছে এবং রায় দিয়েছে যে এগুলো পপলার গাছের ঝরে পড়া পুষ্পগুচ্ছ।

উল্লেখ্য, সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত বেশকিছু পোস্ট এবং বাংলা ও ইংরেজি সংবাদমাধ্যমের কিছু সংবাদে বলা হয়েছে যে চীনের বেইজিংয়ে এই কেঁচো বৃষ্টি হয়েছে। তবে, The Rio Times নামক টুইটার পেইজের একটি পোস্টের কমেন্টে “Shen Shiwei” নামক একজন সাংবাদিক রিপ্লাই দিয়েছেন যে, “আমি এখন বেইজিংয়ে আছি এবং এই ভিডিওটি ভুয়া। বেইজিংয়ে এই সময়ে কোন বৃষ্টি হয়নি।”

 

তাছাড়া, সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত ভিডিও এবং টুইটারে প্রাপ্ত ভিডিওতে দৃশ্যমান একটি গাড়ির নাম্বার প্লেট এর সাথে চীনের লিয়াওনিং (Liaoning) প্রদেশের শেনইয়াং (Shenyang) শহরের নাম্বারপ্লেটের সাদৃশ্য রয়েছে যা আমরা ebay নামক ই-কমার্স ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি বিজ্ঞাপন থেকে জানতে পেরেছি।

 

অতএব, এই বিষয়টি স্পষ্ট যে চীনের বেইজিংয়ে বৃষ্টির সাথে কেঁচো ঝরে পড়েনি। বরং ভিডিওতে দেখতে পাওয়া বস্তুগুলো পপলার গাছের ঝরে পড়া পুষ্পমঞ্জরী বা পুষ্পগুচ্ছ।

সুতরাং, সবকিছু বিবেচনা করে ফ্যাক্টওয়াচ সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত পোস্টের দাবিকে “মিথ্যা” বলে সাব্যস্ত করছে।

আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন?
কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন?
নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?

এসবের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে জানান।
আমাদেরকে ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh