নির্বাচন, আন্দোলন, সরকার পতন: গুজব-অপতথ্যে ২০২৪

74
নির্বাচন, আন্দোলন, সরকার পতন: গুজব-অপতথ্যে ২০২৪
নির্বাচন, আন্দোলন, সরকার পতন: গুজব-অপতথ্যে ২০২৪

সদ্য সমাপ্ত ২০২৪ সাল ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচিত এক বছর। এ বছর শুরু হয়েছিল দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন দিয়ে। এর মধ্য দিয়ে টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। আবার সরকার গঠনের ছয় মাসের মাথায় অভ্যুত্থানের মুখে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। 

রাজনৈতিক এই উত্থান-পতনে সৃষ্ট হয়েছে অনেক গুজব, ছড়িয়েছে অপতথ্য। এ বছর দেশের সংবাদমাধ্যমসহ সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচনায় ছিল কোকাকোলা, ভারত বয়কট আন্দোলন, বিসিএস প্রশ্ন ফাঁস, রাসেল’স ভাইপার সাপের প্রাদুর্ভাবসহ বিভিন্ন ইস্যু। রাজনৈতিক পালাবদলে যোগ হয়েছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের নামও। ফলে বেড়েছে গুজব, ভুল তথ্য এবং অপতথ্য ছড়ানোর প্রবণতাও। যার প্রমাণ পাওয়া যায় বিগত বছরগুলোর পরিসংখ্যান থেকে। 

ফ্যাক্টওয়াচের ২০২১ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত যাচাইকৃত অপতথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এই সময়ের মধ্যে সদ্য সমাপ্ত ২০২৪ সালেই সর্বোচ্চ সংখ্যক অপতথ্য যাচাই করেছে ফ্যাক্টওয়াচ। ২০২১ সালে সংখ্যাটি ছিল ৩৬৩টি এবং ২০২৪ সালে ৬৩৮টি। ২০২৩ সালের তুলনায় এই সংখ্যা বেড়েছে ১২১টি। 

কেমন ছিল ২০২৪?

২০২৪ সালে ফ্যাক্টওয়াচের যাচাইকৃত অপতথ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিল জাতীয় ও রাজনৈতিক ইস্যু, এরপরই আছে ধর্মসংশ্লিষ্ট অপতথ্য, এই ধরনের অপতথ্যের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, ভারতে বাবরি মসজিদের জায়গায় নির্মিত রামমন্দির উদ্বোধন ঘিরে গুজব, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে দেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের দাবিতে প্রচারিত অপতথ্য। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ঘটনা যেমন, ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির মৃত্যু, ইসরায়েলে ইরানের হামলা, ফিলিস্তিন-ইসরায়েল যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য। 

২০২৪ সালের মাঝামাঝিতে হঠাৎ করেই দেশে ছড়িয়ে পড়ে রাসেল’স ভাইপার সাপ আতংক। এই আতংকের ফলে সাপটি নিয়ে সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন ভুলতথ্য, আবার আগস্টে দেশের পূর্বাঞ্চলে হওয়া বন্যা ঘিরেও পরিবেশ বিপর্যয়কেন্দ্রিক অপতথ্য ছড়িয়েছে। এর বাইরে স্বাস্থ্য, আর্থিক প্রতারণা, বিনোদন, শিক্ষা, প্রযুক্তি বিষয়েও ছিল অপতথ্যের ছড়াছড়ি। 

ফ্যাক্টওয়াচ ২০২৪ সালে সবচেয়ে বেশি অপতথ্য শনাক্ত করেছে আগস্ট মাসে (৯১ টি)। বলাবাহুল্য, এই মাসের শুরুতেই ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতা ছেড়ে দেশ ত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আগস্ট পরবর্তী মাসগুলোতেও ফ্যাক্টওয়াচ মেটার প্ল্যাটফর্মগুলো (ফেসবুক, থ্রেডস, ইনস্টাগ্রাম) থেকে প্রতি মাসে অর্ধশতাধিক অপতথ্য শনাক্ত করেছে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যক অপতথ্য শনাক্ত হয়েছে জানুয়ারি মাসে (৬২ টি)। এই মাসের শুরুতেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। 

২০২৪-এ অপতথ্য সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী 

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন

বছরের শুরুতেই ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এতে নিরঙ্কুশ জয় পায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। ফলে টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করে দলটি। আওয়ামী লীগসহ ২৯টি দল অংশগ্রহণ করলেও এ নির্বাচন বর্জন করে দেশের বৃহত্তম আরেক রাজনৈতিক দল বিএনপি। বিএনপির এ বর্জনের ফলে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়ে পড়ে অংশগ্রহণহীন। যার প্রভাব পড়ে নির্বাচনী সময়ে বিদ্যমান বিভ্রান্তিমূলক তথ্যের পরিবেশে। 

এ নিয়ে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে ফ্যাক্টওয়াচের ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ক্রিটিক্যাল অ্যান্ড কোয়ালিটিটিভ স্টাজিস বিনোদনমূলক ওয়েবসাইট ইয়ার্কির সঙ্গে যৌথভাবে একটি গবেষণা করে। দেশের চারটি পেশাদার ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠানের প্রকাশিত ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনগুলো বিশ্লেষণ করে গবেষনায় দেখা যায়, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নির্বাচনী সময়ে বিদ্যমান বিভ্রান্তিমূলক তথ্যের যে পরিবেশ থাকে, তাতে কেবল কয়েকটি অপেশাদার ডিপফেক ভিডিও ছাড়া কোনো নতুন মাত্রা যোগ করেনি। 

নির্বাচনের মাস জানুয়ারিতে ৬২ টি অপতথ্য শনাক্ত করে ফ্যাক্টওয়াচ। এরমধ্যে কেবল নির্বাচনকেন্দ্রিক ছিল ৪১টি। এসব অপতথ্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল হাইকোর্ট কর্তৃক নির্বাচনের ফলাফল স্থগিতের দাবি। জাতিসংঘ এবং যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের মতো দেশের নির্বাচন প্রত্যাখ্যানের দাবি, নির্বাচন ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞার দাবি, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ দেশের গণ্যমান্য ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নামে নির্বাচন নিয়ে ভুয়া উক্তি ও বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের নাম ও লোগো ব্যবহার করে তৈরি ভুয়া ফটোকার্ড, নির্বাচনকেন্দ্রিক পুরোনো ছবি, ভিডিও ইত্যাদি। 

 

পরিবেশ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ (রাসেল’স ভাইপার সাপ, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়)

  • রাসেল’স ভাইপার আতঙ্ক

বন্যাসহ নানা পরিবেশ ও প্রাকৃতিক বিপর্যয় এ দেশে নতুন নয়। এসব ঘটনা নিয়ে অপতথ্যও ছড়ায় কম-বেশি। কিন্তু এ বছর অপতথ্যের এ ধারায় সম্পূর্ণ নতুন মাত্রা যোগ করে রাসেল’স ভাইপার নামে এক সাপ। ২০২৪ সালের জুনে হঠাৎ করেই দেশীয় সংবাদমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচনায় আসে সাপটি। সেই সঙ্গে বাড়তে থাকে অপতথ্যও। জুন মাসে ফ্যাক্টওয়াচ মেটার সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোতে (ফেসবুক, থ্রেডস, ইন্সটাগ্রাম) ৪৪টি অপতথ্য শনাক্ত করে। এর মধ্যে রাসেল’স ভাইপার সাপ সংক্রান্তই ছিল ১৬টি। সাপটি নিয়ে ছড়ানো এসব অপতথ্যের মধ্যে ছিল ভিন্ন প্রজাতির সাপকে রাসেল’স ভাইপার নামে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারণা। 

এসব প্রচারণার কারণে মানুষ আতঙ্কে অনেক নির্বিষ সাপকেও রাসেল’স ভাইপার ভেবে মারতে শুরু করে। ফলে এক পর্যায়ে বন ও পরিবেশ নিয়ে কাজ করা সরকারি-বেসরকারী সংস্থা ও বিশেষজ্ঞরা পরিবেশ বিপর্যয়ের আশংকাও করেন। যদিও এক পর্যায়ে জুনের শেষদিকে গিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে  ”রাসেল’স ভাইপার” আতঙ্ক হুট করেই ”গায়েব” হয়ে যায়।

  • দেশের পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে ভয়াবহ বন্যা

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ওই মাসের শেষদিকে ভয়াবহ বন্যার মুখোমুখি হয় দেশের পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলো। ২১ আগস্ট থেকে শুরু হওয়া এই বন্যায় আক্রান্ত মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, ফেনী, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুর জেলা। এর মধ্যে ফেনী ও কুমিল্লার বন্যা ৩০-৩৬ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ বলে জানা যায় সংবাদমাধ্যম সূত্রে। হঠাৎ সৃষ্ট এই বন্যা পরিস্থিতির প্রভাব পড়ে সোশ্যাল মিডিয়াতেও। বন্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে গুজব এবং অপতথ্যের ডালপালাও। 

আবার সেপ্টেম্বরের শেষদিকে ভারী বৃষ্টি এবং ভারতের জলপাইগুড়ির গজলডোবা বাধ দিয়ে পানি ছাড়ার ফলে উত্তরবঙ্গের পাঁচ জেলায় বন্যা দেখা দেয়। এ বন্যা ঘিরেও ছড়িয়েছে গুজব। এই দুই বন্যার ঘটনায় সব মিলিয়ে ফ্যাক্টওয়াচ ১২ টি অপতথ্য শনাক্ত করেছে। এসব অপতথ্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য দেশ-বিদেশের বন্যা সম্পর্কিত পুরোনো ভিডিও, ছবি, বিভিন্ন দেশের বাঁধের ভিডিওকে ভারতীয় বাঁধ দাবিতে প্রচার। 

বন্যা ছাড়াও মে মাসের শেষদিকে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় রিমেল। এই ঘূর্ণিঝড় ঘিরেও বেশ কিছু অপতথ্য শনাক্ত করেছে ফ্যাক্টওয়াচ। এসব অপতথ্যের মধ্যে ছিল ঘূর্ণিঝড় রিমেলের ছবি দাবিতে এআই নির্মিত ছবি প্রচার, রিমেলের প্রভাবে দেয়াল ছিদ্র হয়ে যাওয়ায় কর্ণফুলী নদীর তলদেশে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু টানেলের বন্ধ রাখার বিভ্রান্তিকর দাবি।  

জুলাই আন্দোলন ও পরবর্তী সময়ে অপতথ্যের প্রবাহ

২০২৪ সালের শেষ ছয় মাস ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই ছয় মাসে দেশের মানুষ দেখেছে কিভাবে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারকে ঘিরে গড়ে ওঠা আন্দোলন রূপ নেয় সরকার পতনের আন্দোলনে এবং ঘটনার ধারাবাহিকতায় পতন হয় টানা চারবার সরকার গঠন করা ‘অপ্রতিরোধ্য’ আওয়ামী লীগের। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নোবেল জয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। আন্দোলন ও এর ফলে ক্ষমতার পালাবদলের এই সময়ে সোশ্যাল মিডিয়াতেও ছড়িয়েছে গুজব। গুজব, অপতথ্যের এই প্রচারণায় যোগ দিয়েছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমও। 

জুলাই আন্দোলন ও সরকারের পতন

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে ২০১৮ সালের পর এবারের আন্দোলন শুরু হয় গত ৫ জুন। মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের পক্ষ থেকে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে, হাইকোর্ট সরকারি দপ্তর, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন করপোরেশনের চাকরিতে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে (নবম থেকে ১৩তম গ্রেড) মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। 

হাইকোর্টের এ রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’র ব্যানারে ২ থেকে ৬ জুলাইয়ের মধ্যে সংগঠিত হয় এবং সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিল করে ২০১৮ সালের সরকারি বিজ্ঞপ্তি পুনঃবহালের দাবিতে টিএসসি এলাকায় বিক্ষোভ সমাবেশ করে। ধীরে ধীরে এ দাবি ঢাকার বাইরের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। আন্দোলন সহিংস হয়ে ওঠে ১৫ জুলাই। 

সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা আন্দোলনে ছাত্রলীগ ও ক্ষমতাসীন অন্যান্য দলের কর্মীরা শিক্ষার্থীদের ওপর নির্বিচারে হামলা চালায়। তারা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভেতরে ও বাইরে আহত বিক্ষোভকারীদের ওপরও হামলা চালায়। সেদিন উভয়পক্ষের তিন শতাধিক মানুষ আহত হয়। ঢাকার বাইরেও বিভিন্ন জেলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ হয় আন্দোলনকারীদের। এসব হামলা, সংঘর্ষে মৃত্যুর ঘটনা যেমন ঘটেছে, তেমনি সোশ্যাল মিডিয়ায় আসতে থাকে আন্দোলনকারীদের মৃত্যুর গুজবও। ১৬ থেকে ১৭ জুলাই এমন তিনটি মৃত্যুর ভুয়া দাবি শনাক্ত করে ফ্যাক্টওয়াচ।

প্রসঙ্গত, কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভ ও সংঘাতের মধ্যে ১৭ জুলাই মধ্যরাত থেকে ফোর-জি নেটওয়ার্ক বন্ধ করায় দেশের মোবাইল ইন্টারনেট-সেবা বন্ধ হয়ে যায়। এর পরদিন ১৮ জুলাই রাত পৌনে নয়টা থেকে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগও বন্ধ হয়ে যায়। এ কারণে পুরো দেশই ইন্টারনেট-বিচ্ছিন্ন ছিল। ২৩ জুলাই থেকে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট-সেবা পাওয়া গেলেও মোবাইল ইন্টারনেট, ফেসবুক, টিকটক বন্ধ ছিল। মোবাইল ইন্টারনেট চালু হয় ২৮ জুলাইয়ে। ইন্টারনেট সেবার এমন বিঘ্নের মধ্যেই জুলাই মাসে ফ্যাক্টওয়াচ মেটার প্ল্যাটফর্মগুলোতে মোট ৪৯টি অপতথ্য শনাক্ত করে। এর মধ্যে ২৫টিই ছিল কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে। 

এসব গুজবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়কদের কাছ থেকে অস্ত্র উদ্ধারের ভুয়া দাবি, আন্দোলনে আহত শিক্ষার্থীদের নিহতের দাবিতে সংবাদমাধ্যমের ভুয়া ফটোকার্ড, পুরোনো ছবি ও ভিডিও প্রচার, সংবাদমাধ্যম সূত্রে নিহতের সংখ্যা নিয়ে গুজব। 

সোশ্যাল মিডিয়ায় অপতথ্য প্রচারের এই ধারা অব্যাহত থাকে আগস্টেও। সব মিলিয়ে ফ্যাক্টওয়াচ আগস্ট মাসে মেটার প্ল্যাটফর্মগুলোতে মোট ৯১টি অপতথ্য শনাক্ত করে। এসব অপতথ্যের শিকার হয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা, অপতথ্য ছড়িয়ে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়েছে আন্দোলনকে। যেমন, আগস্টের শুরুতেই ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে যে, কোটাসংস্কার আন্দোলনের তিনজন সমন্বয়ক পাকিস্তান দূতাবাসের কাছে সাহায্য চেয়েছেন এবং দূতাবাস তাদেরকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়েছে। ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে দেখা যায়, দাবিটি গুজব ছিল। 

আবার তখন  ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের নেতাদের জড়িয়েও ছড়িয়েছে অপতথ্য। যেমন, ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মৃত্যুর গুজব, সাবেক প্রতিমন্ত্রী পলকের ছবি বিকৃত করে প্রচার করা হয়েছে। এ সময়ে গুজবের শিকার হয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীও। সেনাবাহিনীকে জড়িয়ে গুজবের মধ্যে ছিল তৎকালীন সরকারের প্রতি অনাস্থা জানিয়ে বাহিনীটির সদস্যদের পদত্যাগের দাবি। 

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অপতথ্য প্রচারের ধারায় নতুন নতুন ইস্যু যুক্ত হয়। এসব ইস্যুর মধ্যে সংখ্যালঘু নির্যাতন, ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের বসতবাড়ী-ধর্মীয় উপাসনালয়ে হামলা, ভাঙচুর, কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে নিহত পুলিশের সংখ্যা নিয়ে গুজব (যুক্তরাষ্ট্রের টাইম ম্যাগাজিনের বরাত দিয়ে ৩ হাজার পুলিশ নিহতের ভুয়া দাবি, সিরাজগঞ্জে আন্দোলনের সময় থানায় নিহত পুলিশ সদস্যদের মধ্যে গর্ভবতী নারী পুলিশ সদস্য থাকার ভুয়া দাবি), অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপতথ্য, বিভিন্ন উপদেষ্টার নামে ছড়ানো ভুয়া মন্তব্য ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। 

সর্বোপরি, ২০২৪ সালের শেষ ছয় মাসে আন্দোলন, সরকার পতন ও  অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে প্রায় আড়াই শতাধিক অপতথ্য শনাক্ত করেছে ফ্যাক্টওয়াচ।

  • জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদদের নিয়ে গুজব  

৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অপতথ্য প্রচারের ধরনে পরিবর্তন আসে। বদলে যায় অপতথ্য ছড়ানোর চ্যানেলও। এরই ধারাবাহিকতায় জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ হওয়া বেশ কয়েকজন ”ফিরে এসেছে” দাবিতে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়ানো হয় গুজব। ফ্যাক্টওয়াচ ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে এমন ৪টি ভুয়া তথ্য শনাক্ত করে ফ্যাক্টওয়াচ। এর মধ্যে আছে মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ, ভোলার শহীদ নয়ন, কুমিল্লায় দুই শহীদের ফিরে আসার গুজব। এ ছাড়া বেরোবি শিক্ষার্থী আবু সাঈদের মৃত্যু নিয়েও ছড়িয়েছে গুজব। 

  • আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে বাংলাদেশ নিয়ে অপতথ্য

বাংলাদেশে যখন কোটা সংস্কার আন্দোলন তুঙ্গে, সে সময়ে ১৮ জুলাই এ আন্দোলন সম্পর্কে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের উপস্থাপন নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিবিসি বাংলা। প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়,  তখনো এ আন্দোলনের খবর সামান্যই গুরুত্ব পেয়েছে প্রতিবেশী ভারতের গণমাধ্যমে। ভারতের গণমাধ্যম বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করেন, বাংলাদেশের সরকার ভারতের ‘বন্ধু-সরকার’। আর ভারতীয় গণমাধ্যমে সাধারণত দেশটির বিদেশ নীতির পরিপন্থী কিছু ছাপা হয় না। ওই সময় ভারতীয় বাংলা টিভি চ্যানেলগুলোতেও  গুরুত্ব পায়নি বাংলাদেশের এই আন্দোলনের খবর।

কিন্তু ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে বাংলাদেশ। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলোতে নিত্যদিন বাংলাদেশ নিয়ে কিছু না কিছু সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছেই। এসব সংবাদে সত্য যেমন থাকছে তেমনি প্রচার হচ্ছে বিভিন্ন অপতথ্য। ফ্যাক্টওয়াচ মেটার প্ল্যাটফর্মগুলোতে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের এমন ১৫টি অপপ্রচার শনাক্ত করেছে। কেবল ভারতীয় সংবাদমাধ্যমই নয়, এ তালিকায় যুক্ত হয়েছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম রয়টার্সের নামও

এসব অপপ্রচারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, ভারতে দেবী কালীর মূর্তি বিসর্জনকে বাংলাদেশে কালী মন্দিরে হামলা বলে প্রচার, রমেন রায় নামে ঢাকার এক আইনজীবীর ওপর হামলার পুরোনো ঘটনাকে সাবেক ইস্কন নেতা চিন্ময়ের আইনজীবীর ওপর হামলার দাবিতে প্রচার, ভারত থেকে আসা দুর্ঘটনায় পড়া শ্যামলী পরিবহনের বাসকে ভারতে পরিকল্পিত হামলা দাবিতে প্রচার, বাংলাদেশে ভারতীয় স্যাটেলাইট চ্যানেল সম্প্রচার বন্ধের ভুয়া দাবি, চট্টগ্রামে নিহত আইনজীবী সাইফুল ইসলামকে নিয়ে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের আইনজীবী দাবি, পাকিস্তান থেকে চট্টগ্রাম আসা জাহাজে করে অস্ত্র আসার ভুয়া দাবি। 

আলোচিত অন্যান্য ঘটনা নিয়ে গুজব

এসব ঘটনার বাইরে সোশ্যাল মিডিয়ায় দেশ-বিদেশে আলোচিত যেসব ঘটনা নিয়ে অপতথ্য ছড়িয়েছে, সেসব ঘটনার মধ্যে রয়েছে-

  • ভারতে রামমন্দির উদ্বোধনঃ ২০২৪ সালের শুরুতেই ভারতের অযোধ্যায় রামমন্দিরে বিগ্রহের ‘প্রাণ প্রতিষ্ঠা’ করেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। মন্দিরটি যেখানে তৈরি হয়েছে, ওখানেই একসময়ে ছিল ষোড়শ শতাব্দীতে তৈরি বাবরি মসজিদ। ধর্মীয় এই স্থাপনার গুরুত্বের কারণে জানুয়ারিতে এই ঘটনা নিয়ে ৬টি ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করে ফ্যাক্টওয়াচ।
  • ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির মৃত্যুঃ ২০২৪ সালের ১৯ মে হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় মারা যান ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি। তাঁর এ মৃত্যু ঘিরে বাংলাদেশের নেটিজেনদেরও কৌতূহল ছিল। এ কৌতূহল থেকে ছড়িয়েছে অপতথ্য। মে মাসে ফ্যাক্টওয়াচের প্রকাশিত ৪৪টি ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনের মধ্যে ৫টিই ছিল ইব্রাহিম রাইসির মৃত্যু নিয়ে।  
  • সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাতে বাংলাদেশি জাহাজ জিম্মিঃ ২০২৪ সালের ১২ মার্চ সোমালিয়ার জলদস্যুরা ভারত মহাসাগর থেকে বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহকে জিম্মি করে। জাহাজটিতে ছিলেন বাংলাদেশি ২৩ জন নাবিক। মুক্তিপণ দিয়ে জাহাজটি ছাড়া পায় ১৪ এপ্রিল রাতে। এ সময়ের মধ্যে এ জাহাজ উদ্ধার সম্পর্কিত তিনটি অপতথ্য শনাক্ত করে ফ্যাক্টওয়াচ। 
  • বিসিএস প্রশ্ন ফাঁস কাণ্ডঃ জুলাইয়ে বিসিএস প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশের পর এ নিয়ে বেশ কিছু অপতথ্যও  ছড়িয়ে পড়ে সোশ্যাল মিডিয়ায়। এ ঘটনায় এক মাসেই ছয়টি অপতথ্য শনাক্ত করে ফ্যাক্টওয়াচ। এসব অপতথ্যের মধ্যে ছিল অভিনেতা ও সঙ্গীত শিল্পী তাহসান খানের ২৪তম বিসিএস পরীক্ষায় পররাষ্ট্র ক্যাডারে প্রথম হওয়ার গুজব, প্রশ্নফাঁসকাণ্ডে জনপ্রিয় মোটিভেশনাল স্পিকার সুশান্ত পাল ফেঁসে যাওয়ার দাবিতে দৈনিক কালবেলার ভুয়া ফটোকার্ড, প্রশ্নফাঁসকাণ্ডে জড়িত আবেদ আলীর নামে ছড়ানো গুজব।

২০২৪ সালে বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন, নির্বাচনী প্রক্রিয়া, সরকার পরিবর্তন ও রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ে সামাজিক মাধ্যম এবং প্রচারমাধ্যমে নানা ধরনের অপতথ্য ছড়িয়েছে। এসব গুজব এবং অপতথ্যের বিস্তার রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে। সঠিক তথ্য যাচাইয়ের অভাব এবং প্রোপাগান্ডা চালানোর জন্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের অপব্যবহার এই সমস্যাকে আরও জটিল করে তুলেছে। ফলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে, গুজব মোকাবিলায় যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ এবং তথ্যের সঠিকতা নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তা বিশেষভাবে অনুভূত হচ্ছে। 

No Factcheck schema data available.