যা দাবি করা হচ্ছে – বাংলাদেশের বিমানবন্দর থেকে হাজীদের লাগেজ খুলে বিমানবন্দরের দায়িত্বরত কর্মচারীরা জমজমের পানিসহ অন্যান্য মালামাল রেখে দিচ্ছে |
অনুসন্ধানে যা পাওয়া যাচ্ছে – এই ভিডিওটা বাংলাদেশের কোনো বিমানবন্দরের চিত্র নয়, বরং সৌদি আরবের তায়েফ বিমানবন্দরের চিত্র। যাত্রীদের লাগেজের ট্যাগ এবং অন্যান্য তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, সৌদি আরব এর তায়েফ থেকে ভারতের হায়দ্রাবাদগামী একটি ফ্লাইটের উড্ডয়নের পূর্বের ভিডিও এটা। সৌদি কর্তৃপক্ষের নিয়ম অনুযায়ী, ‘চেক ইন লাগেজ’এ কোনো যাত্রী পানি বহন করতে পারবে না। বিধি অনুযায়ী, এখানে বিমানবন্দরের কর্মচারীরা লাগেজ পরীক্ষা করে পানির বোতল পেলে সেগুলো বের করছে। সঙ্গত কারণে ফ্যাক্টওয়াচ এই দাবিকে বিভ্রান্তিকর সাব্যস্ত করছে।
গুজবের উৎস
জনৈক মাহমুদুল্লাহ খলিল ৩ মিনিট ১৭ সেকেন্ডের এই ভিডিও পোস্ট করে ক্যাপশনে লিখেছেন , এয়ারপোর্ট থেকে হাজীদের লাগেজ স্বযত্নে খুলে জমজমের পানি সহ অন্যান্য মালামাল রেখে দিচ্ছে | কোন দেশ হতে পারে?
এই পোস্টে তিনি হ্যাশট্যাগ দিয়ে বিমান বাংলাদেশ এর নাম লিখেছেন, যেটি বাংলাদেশের বিমান সংস্থা।
আশরাফুল হাবিব নামের আরেকজন ফেসবুক ব্যবহারকারী একই ভিডিও আপলোড করে লিখেছেন, হাজীদের লাগেজ থেকে এগুলো কি বের করা হচ্ছে??? জমজমের পানিও রেখে দিচ্ছে কারা এগুলো.???ছিঃ বাংলাদেশ।
মেহেদী হাঁসান নামের আরেক ফেসবুক ব্যবহারকারী এই ভিডিও শেয়ার করে লিখেছেন,
পৃথিবীর বুকে একটিই দেশ যেখানে চোরকে সমর্থন করা হয়,একবোতল পানিও চুরি করতে হয়👌 জমজমের পানি, হাজী সাহেবদের লাকেজ থেকে কেটে বের করা হচ্ছে
ছড়িয়ে পড়া এই ভিডিওতে লাল রঙের ইউনিফর্ম পরিহিত একদল কর্মীকে যাত্রীদের লাগেজ খুলে সেখান থেকে পানির বোতল বের করে আবার লাগেজগুলোকে আটকে রাখতে দেখা যাচ্ছে। কর্মীদের ইউনিফরমের বুকে এবং পিঠে Airgate নামক একটি কোম্পানির নাম এবং লোগো দেখা যাচ্ছে।
কয়েকটি লাগেজের সাথে লাগানো ট্যাগে HYD এবং SV3768 কথাটি দেখা যাচ্ছে। বিভিন্ন দেশের বিমানের ফ্লাইট পর্যবেক্ষক সংস্থা, ফ্লাইট এ্যাওয়ার এর ওয়েবসাইট থেকে জানা যাচ্ছে, SV3768 নামক সৌদিয়া এয়ারলাইন্স এর ফ্লাইটটি গত ৪ঠা জুলাই সকাল ৭টা ৪১ মিনিটে সৌদি আরবের তায়েফ থেকে যাত্রা শুরু করে বিকাল ৩টা ১৩ মিনিটে ভারতের হায়দারাবাদ এর রাজীব গান্দী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেছিল। এছাড়া HYD দ্বারা Hyderabad এর বিমানবন্দর বুঝানো হয়।
একজন যাত্রীর লাগেজে বড় অক্ষরে তাঁর নাম ,পাসপোর্ট নাম্বার, ফোন নাম্বার ছাড়াও ;হায়দারাবাদ’ কথাটি লেখা ছিল।
অর্থাৎ এটা নিশ্চিত যে এটা ঢাকা কিংবা বাংলাদেশের কোনো বিমানবন্দর নয় , বরং এটি সৌদি আরবের তায়েফ বিমানবন্দরের একটি দৃশ্য ।
Magistrates All Airports of Bangladesh নামক ফেসবুক পেজ থেকে এই ভিডিও’র একটি ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে । এখানে বলা হয়েছে,
ভিডিওটি বাংলাদেশের নয়। এটা সৌদি আরবের কোন বিমানবন্দরের ঘটনা। যাদের লাগেজ এভাবে খোলা হচ্ছে তারা ভারতের হজ যাত্রী। তারা সৌদি এয়ারলাইন্সের একটি বিশেষ ফ্লাইটে ভারতের হায়দারাবাদ যাওয়ার জন্য চেকইন করেছিলেন। তাদের লাগেজ স্ক্যান করার পর লাগেজের ভিতরে থাকা জমজমের পানির বোতলগুলি বের করে ফেলা হচ্ছে তাদের অনুপস্থিতিতেই। যারা লাগেজ খুলে বোতল বের করার কাজ করছেন তারা ভারত/পাকিস্তান/বাংলাদেশের নাগরিক হতে পারেন। খেয়াল করলে তাদের মধ্যে হিন্দী/উর্দু, বাংলা ও ইংরেজি ভাষার কথা শোনা যায়। লাল টিশার্ট পরে যারা এ কাজ করছেন তাদের পিছনে Airgate নামক প্রতিষ্ঠানের নাম লেখা আছে। অন্য একটি ভিডিও ক্লিপে দেখা যায় যে লাল টিশার্টের পিছনে ইংরেজির পাশাপাশি আরবিতে কিছু লেখা আছে।
বাংলাদেশের হজযাত্রীদের লাগেজে ভরে জমজমের পানি আনতে হয় না। প্রতি যাত্রীর জন্য পাচ লিটারের জমজমের পানির একটি প্যাকেট বরাদ্দ আছে। হাজী সাহেবরা হজ করে বাংলাদেশে ফেরার আগেই তাদেরকে বহনকারী ফ্লাইটগুলি ফিরতিপথে যাত্রীবিহীন অবস্থায় আসার সময় জমজমের পানি নিয়ে আসে। ফলে হজ শুরুর আগেই সব হাজীদের জমজমের পানি বাংলাদেশের বিমানবন্দরে চলে আসে। বাংলাদেশে পৌছানোর পর প্রত্যেক হাজী সাহেবকে একটি করে বাক্স দিয়ে দেওয়া হয়। প্রথম দিকে শুধু বিমান এভাবে জমজমের পানি আগাম নিয়ে আসতো।এখন সৌদি এবং ফ্লাইনাসের যাত্রীদের জমজমের পানিও এভাবে আগাম আনা হয়।
ভারতের হাজী সাহেবরা হয়ত বাংলাদেশিদের মত সৌভাগ্যবান নন। হয়ত পাচ লিটার বোতল আলাদাভাবে বুকিং দিতেও কোন সমস্যা আছে। তাই তারা বুকিং লাগেজের ভিতর জমজমের পানি আনার চেষ্টা করেন। কিন্তু সৌদি সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষের কঠোর নির্দেশনা আছে লাগেজের ভিতরে পানি না নেওয়ার। লাল টিশার্ট পরিহিত Airgate এর কর্মীরা সৌদি কর্তৃপক্ষের হুকুম তামিল করছেন মাত্র।
এ ভিডিও দেখে অনেকেই নিজের দেশকে গালি দেওয়ার উপলক্ষ পেয়ে গেছেন। একটি ভিডিওতে বাংলা ক্যাপশন এবং ব্যাকগ্রাউন্ডে করুন মিউজিক যোগ করা হয়েছে। আশা করি তাদের ভুল ভাঙবে এবার।
জমজম পানি বহন সংক্রান্ত এই আইনের কথার সত্যতা পাওয়া যাচ্ছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের পুরনো এই সংবাদবিজ্ঞপ্তিতে। এখানে বলা হয়েছে, সৌদি কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী হাজিগণ ব্যক্তিগতভাবে নিজেদের সঙ্গে জমজমের পানি পরিবহন করতে পারবেন না। এয়ারলাইন্স এর পক্ষ থেকে তা পরিবহন ও বিতরণ করা হবে। নিয়ম অনুযায়ী প্রতি হাজিকে ৫ লিটার করে জমজমের পানি সরবরাহ করা হচ্ছে।
একাধিক সংবাদমাধ্যমেও জমজম পানি বহনের বর্তমান এই নিয়ম সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে। যেমন কয়েকটি খবর দেখুন এখানে, এখানে, এখানে ।
ভারতের সবাদমাধ্যম ‘ফ্রি প্রেস জার্নাল’ এ গত ৫ই জুলাই প্রকাশিত এই খবর থেকে জানা যাচ্ছে, হজ্বফেরত অনেক যাত্রীর লাগেজ থেকেই সৌদি বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ কাটাছেড়া করে পানির বোতল বের করেছে। এর সাথে অন্য কিছু সামগ্রী খোয়া যাওয়ার অভিযোগও পাওয়া যাচ্ছে।
লাগেজে পানি বহন করার পরে সেই পানি বের করে ফেলে দেওয়ার অনুরূপ কিছু ভিডিও গত কয়েক বছর ধরেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে। (যেমন দেখুন এখানে , এখানে ) এসকল ভিডিওতে এই জমজম পানি রেখে দেওয়ার ঘটনাগুলো সৌদি আরবের বিমানবন্দরের ঘটনা হিসেবেই সবাই জানিয়েছেন।
এসকল দিক বিবেচনায়, ফেসবুকে যেসকল পোস্টে এই ভিডিওকে বাংলাদেশের ঘটনা হিসেবে দাবি করা হয়েছে, সেসকল পোস্টকে ফ্যাক্টওয়াচ ‘বিভ্রান্তিকর’ হিসেবে সাব্যস্ত করছে।
এই নিবন্ধটি ফেসবুকের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রামের নীতি মেনে লেখা হয়েছে।। এর উপর ভিত্তি করে ফেসবুক যে ধরণের বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এখানে। এছাড়া এই নিবন্ধ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন, সম্পাদনা কিংবা আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার জন্য আবেদন করতে এই লিঙ্কের সাহায্য নিন।