Published on: May 20, 2022
সম্প্রতি “বাজ পাখির এই নীতি মেনে চললে কোনোদিনই আপনি হারবেন না”। ক্যাপশনে একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। ভাইরাল ভিডিওটিতে বলা হয়েছে, “একটি বাজ পাখি প্রায় সত্তর বছর পর্যন্ত জীবিত থাকে। কিন্ত চল্লিশ বছর বয়স আসতেই তাকে নিজের জীবন নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হয়। ওই বয়সে এসে তার শরীরের প্রধান তিনটি অঙ্গ দূর্বল হয়ে পড়ে। থাবা কিংবা পায়ের নখ বেশ লম্বা ও নরম হয়ে যায়, আর তাই শিকার করা তার জন্য প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। ঠোঁট সামনের দিকে মুড়ে যায় বা অনেকখানি ভেঙে যায় যার ফলে খাবার খুটে বা ছিড়ে খাওয়া প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। ডানা ভারি হয়ে যায় যে কারণে বুকের কাছে আটকে যাওয়ার দরুণ উড়তে আগের তুলনায় বেশ কষ্ট হয়। ফলস্বরূপ শিকার খোজা, ধরা ও ধাওয়া এই তিনটেই ধীরেধীরে বেশ মুশকিল হয়ে পড়ে। সে কারণে এই কঠিন সময়ে বাজপাখি উঁচু একটি পাহাড়ে আশ্রয় নিয়ে থাকে। সে প্রথমে তার ঠোঁটটা পাথরে আঘাত করে ভেঙে ফেলে, একইভাবে নখগুলো ভেঙে ফেলে। কিছুদিন অপেক্ষা করার পরে নতুন করে গজানো ঠোঁট ও নখ দিয়ে এ পর্যায়ে সে তার ডানা ও বুকের পালকগুলো ছিড়ে ফেলে। ১৫৫ দিনের অপেক্ষার পরে সে তার বেঁচে থাকার সব শক্তি নতুন করে ফিরে পায়। এরপর প্রায় ৪০ বছর সে আবার বীরত্বের সাথে বেঁচে থাকে।“ |
“দূরবীন” নামক পেজ থেকে প্রকাশিত ভিডিওটি দেখুন এখানে।
আদতেই কি বাজপাখি কি ৭০ বছর বাঁচে? ৪০ বছর বয়সের পরে কি বাজপাখি জীবনের কঠিন একটি সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়? এ বিষয়ে ফ্যাক্টওয়াচ নানান বৈজ্ঞানিক তথ্য জোগাড় করে দেখেছে।
এক নজরে বাজপাখির বৈজ্ঞানিক পরিচয়:
Kingdom = Animalia
Phylum = Chordata
Class = Aves
Order = Falconiformes
Family = Falconidae
Genus = Falco
বাজপাখি কি ৭০ বছর বাঁচে?
“The university Of Toledo” প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, “বাজপাখি ১২ থেকে ১৫ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে। এছাড়াও প্রায় ৬০ শতাংশ বাজপাখি অল্প বয়সেই মারা যায়। প্রতি ১০ টি বাজপাখির মধ্যে ৬টি পাখি জন্ম নেবার প্রথম বছরেই মারা যায়”।
AZ Animals নামক প্রাণিবিষয়ক ওয়েবসাইটে প্রকাশিত অন্য একটি নিবন্ধে দেখা যায়, “একটি বাজপাখির গড় আয়ু ১৩ বছর এবং সর্বোচ্চ ১৬ থেকে ২০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে”।
বাজপাখি ৭০ বছর বাঁচে, ৪০ বছর বয়সের পরে বাজপাখি জীবনের কঠিন একটি সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয় এই ধারণাটি তবে কিভাবে এসেছে?
অনুসন্ধানে দেখা যায়, বাজপাখি নিয়ে বাংলাদেশে চলমান মিথটি মূলত বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে ঈগলের গল্প হিসবে প্রচারিত হয়েছে। “দূরবীন” পেজটিতে যে তথ্য বাজপাখিকে নিয়ে দেওয়া হয়েছে এই একই তথ্য নানা সময়ে বিভিন্ন সাইট থেকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ঈগলের উপরে দেয়া হয়েছে।
তবে কি বাজপাখি ও ঈগল একই? বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রবন্ধে বাজপাখি এবং ঈগলের নানা অমিল তুলে ধরা হয়েছে। বাজ ও ঈগলের দৃশ্যমান কিছু পার্থক্য হল বাজ একটি ছোটো ডানার শিকারী পাখি, তবে ঈগল বিশাল ডানার শিকারী পাখি। দৈহিক গঠনে বাজ এবং ঈগলের মধ্যে অনেক অমিল রয়েছে। বাজ এবং ঈগলের বৈসাদৃশ্য নিয়ে লেখা আন্তর্জাতিক একটি প্রবন্ধ পড়ুন এখানে।
ছবিতে বাজপাখি ও ঈগলের প্রধান পার্থক্যগুলো দেখে নেওয়া যাক:
এ বিষয়ে একমাত্র বাংলাদেশী বাজপাখি গবেষকের মন্তব্য: Falcon গবেষক মোহাম্মদ ফয়সাল এর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, কোনো পাখির আয়ুকাল সম্পর্কে ধারণা পেতে সুদূরপ্রসারী গবেষণা করতে হয়। দুটি উপায়ে কোনো পাখির আয়ুকাল জানা যায়: খাঁচায় আবদ্ধ করা কোনো পাখির ডিম ফোটানো থেকে শুরু করে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পুরো প্রসেস লক্ষ করা ও মুক্ত কোনো পাখির পায়ে রিং পরিয়ে সেটার গতিবিধি বছরের পর বছর নিরীক্ষণ করে যাওয়া। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এ ধরনের গবেষণা থাকলেও বাংলাদেশে এর উপরে এখনো গবেষণা হয়নি বলেই চলে। উল্লেখিত গল্পটি সম্পর্কে তিনি আরও বলেন এ ধরণের পৌরাণিক গল্প আমাদের সমাজে দীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত আছে। কোনো জার্নালে এমন গল্প প্রকাশিত হয়নি।
ঈগল পাখির আয়ুকাল দেখে নেওয়া যাক:
“Wabasha” থেকে পরিচালিত ঈগলের উপরে গবেষণা প্রতিষ্ঠান The National Eagle Center এর একটি প্রবন্ধে দেখা যায় প্রাপ্তবয়স্ক একটি ঈগল ২০-২৫ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে।
পৃথিবীর অন্যতম ঈগল গবেষণা সংস্থা The Philippine Eagle Foundation তাদের একটি প্রতিবেদনে জানাচ্ছে, একটি বন্দি ঈগল সর্বোচ্চ ৪০ বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারে তবে বন্য ঈগল আরও আগে মারা যায়।
AZ Animals website এর অন্য একটি প্রবন্ধে বলা হয়েছে প্রজাতিভেদে ঈগলের গড় আয়ু ১৫-৩০ বছর পর্যন্ত।
পৌরাণিক এই গল্পগুলো নিয়ে আন্তর্জাতিক তথ্য যাচাইকারি সংস্থাগুলো কি বলছে?
ভাইরাল গল্পটি নিয়ে ২৭ ডিসেম্বর ২০২১ তারিখে আন্তর্জাতিক তথ্য যাচাইকারি সংস্থা এএফপির করা একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া গেছে। সেখানে বলা হচ্ছে:
“ফেসবুক পোস্টে দাবি করা হয়েছে ৪০ বছরের পরে ঈগল নিজে অঙ্গহানি করে আরও ৩০ বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারে। এই দাবিটি মিথ্যা; নথিমতে আমেরিকাতে পাওয়া ৩৮ বছর বয়সী একটি বন্য ঈগলকেই সবচেয়ে বয়স্ক ঈগল বলা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন শিকারি পাখিরা নিজে অঙ্গহানি করে বাঁচতে পারে না।” প্রতিবেদনটি দেখুন এখানে।
সুতরাং বাংলাদেশে যা বাজপাখির প্রবণতার নামে গুজব হিসেবে প্রচার হচ্ছে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তাই ঈগল বিষয়ক গুজব হিসেবে দেখা গেছে। ফ্যাক্টওয়াচের গবেষণা বলছে, ঈগল কিংবা বাজপাখি কারো আয়ুকালই ৭০ বছর নয় এবং নিজ অঙ্গহানি করে তারা তাদের আয়ুকাল বৃদ্ধি করে না।
সঙ্গত কারণে “বাজ পাখির এই নীতি মেনে চললে কোনোদিনই আপনি হারবেন না” ক্যাপশনে প্রচারিত ভিডিওটিকে ফ্যাক্টওয়াচ “মিথ্যা” চিহ্নিত করছে।
আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন? এসবের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে জানান। |