জাপানি বিজ্ঞানী কি মাহে রমজান নিয়ে গবেষণা করেছেন?

Published on: April 6, 2022

“মাহে রমজানের উপর গবেষণা করে নোবেল জিতেন ইয়োশিনোরি ওহশোমি”- সম্প্রতি এমন একটি দাবি ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, জাপানি বিজ্ঞানী ইয়োশিনোরি ওহশোমি ২০১৬ সালে নোবেল পেয়েছেন ঠিকই তবে তা অটোফেজি নিয়ে তার নতুন আবিষ্কারের জন্য। অটোফেজি আর রোজা এক জিনিস নয়। অটোফেজি সাধারন শারীরবৃত্তীয় একটা প্রক্রিয়ার নাম। রোজা বা উপবাস যেটা ত্বরান্বিত করতে পারে । ওহশোমি রোজা বা রমজান নিয়ে গবেষণা করেন নি, করেছেন কেবলমাত্র অটোফেজি নিয়ে।  তাই ফ্যাক্টওয়াচ এমন দাবিকে “বিভ্রান্তিকর” চিহ্নিত করছে।

এমন কিছু ফেসবুক পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে এবং এখানে

কি আছে এই পোস্টে

ভাইরাল ফেসবুক পোস্টটি হুবুহু তুলে ধরা হলোঃ

এই সেই জাপানি বিজ্ঞানী নাম ইয়োশিনোরি ওহশোমি তিনি মাহে রমজানের উপর গবেষণা করে নোবেল পুরষ্কার পান ২০১৬ সালে।

তিনি আবিষ্কার করেন যে ১২ থেকে ২৪ ঘন্টা রোজা রাখলে মানুষের দেহে অটোফেজি চালু হয়। তিনি প্রমাণ করেন যে রোজার মাধ্যমে মানুষের নিম্ন লিখিত উপকারগুলো হয়

1/দেহের সেল পরিষ্কার হয়।

2/ ক্যান্সার সেল ধ্বংস হয়।

3 পাকস্থলীর প্রদাহ সেরে যায়।

4/ ব্রেইনের কার্যকারিতা বাড়ে।

5/শরীর নিজে নিজেই সেরে উঠে।

6/ডায়াবেটিস ভাল হয়।

7/বার্ধক্য রোধ করা যায়।

8/ স্থুলতা দূর হয়।

9/দীর্ঘ জীবন লাভ করা যায়।

আল্লাহ তাকে ইমানের দাউলাত দান করুন।

বিজ্ঞান নিয়ে আপনি যত ঘাটাঘটি করবেন আল্লাহর বিশ্বাস আপনার ভেতর তত বেড়ে যাবে।  সুবাহানআল্লাহ।

এসব প্রমান গুলি দেখলে নিজেকে সত্যিই খুব ভাগ্যবান মনে হয়। যদি একটু ভুল করে ভুল পথে জন্ম হয়ে যেতো। যদি অন্যকোন ধর্মে আমার জন্ম হয়ে যেতো।

আল্লাহর কাছে লাখ লাখ শোকরিয়া, সঠিক পথে পৃথিবীতে পাঠানোর জন্য।

আল্লাহ মহান

যত বেশি শেয়ার করবেন তত মানুষ বিষয়টি জানবে আর তাদের  আল্লাহর প্রতি ঈমান প্রবল হবে। তাই শেয়ার করুন

 

ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধান

প্রথমেই ভাইরাল পোস্টে থাকা ছবি দুইটি অনুসন্ধান করে নিশ্চিত হওয়া যায় যে এখানে জাপানি জীববিজ্ঞানী ইয়োশিনোরি ওহশোমির কথাই বলা হচ্ছে।

ভাইরাল পোস্টে, ওহশোমির একটি গবেষণার কথা উল্লেখ করে কিছু দাবি করা হয়। নির্দিষ্টভাবে বলা হয়, তিনি রমজানের উপর গবেষণা করে ২০১৬ সালে নোবেল পেয়েছিলেন। পরবর্তীতে প্রাসঙ্গিক কিছু কি-ওয়ার্ডের মাধ্যমে অনুসন্ধান করা হলে জানা যায় যে, ০৩ অক্টোবর ২০১৬ এ নোবেল কর্তৃপক্ষ থেকে প্রকাশিত একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি পাওয়া যায়।

এই প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হচ্ছে, অটোফেজি পদ্ধতি নিয়ে তার আবিষ্কারের জন্য ওহশোমিকে শরীরতত্ত্ব অথবা মেডিসিন বিভাগে নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত করা হচ্ছে। উক্ত বিজ্ঞপ্তির সারাংশটি বাংলায় অনুবাদ করা হলোঃ

“এই বছরের নোবেল বিজয়ী অটোফেজির অন্তর্নিহিত প্রক্রিয়াগুলি উদঘাটন করেছেন এবং ব্যাখ্যা করেছেন। অটোফেজি একটি মৌলিক প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে আমাদের শরীরের কোষগুলোর ভেতরকার লয় ও নবায়নকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব।

অটোফ্যাজি শব্দটি গ্রীক শব্দ অটো- থেকে এসেছে, যার অর্থ “স্বয়ং”, এবং ফাগেইন, যার অর্থ “খাওয়া”। সুতরাং, অটোফ্যাজি বলতে “নিজেকে খাওয়া” বোঝায়। এই ধারণাটি ৬০ এর দশকে উদ্ভাবিত হয়েছিল, যখন গবেষকরা দেখতে পান শরীরের কোষগুলো নিজেরা নিজেদের বিনাশ করতে পারে, নিজেকে চারপাশ থেকে ঝিল্লিতে আটকে ফেলার মাধ্যমে। এভাবে কোষগুলো বস্তার মতো ফুসকুড়িতে পরিণত হয়, যেটি পরবর্তীতে নবায়নের জন্য কোষের ভেতরে লাইসোসোম নামে একটি রিসাইকল সেন্টারে স্থানান্তরিত হয়। এর আগে এই বিষয়ে তেমন কিছু জানা ছিলো না। ১৯৯০ এর শুরুর দিকে ইয়োশিনোরি ওহসুমির অনেকগুলো পরীক্ষায়, অটোফেজি জন্য প্রয়োজনীয় জিনগুলি সনাক্ত করতে ইস্ট (Yeast) ব্যবহার করেন। তারপরে তিনি ইস্টে অটোফেজি অন্তর্নিহিত প্রক্রিয়াগুলি ব্যাখ্যা করেন এবং দেখিয়েছিন যে আমাদের কোষগুলিতেও অনুরূপ অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয়।

কীভাবে কোষ তার জমানো মালামাল রিসাইকল করে তা বোঝার ক্ষেত্রে ওহশোমির এই আবিষ্কার নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। অনেক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া যেমন উপবাসের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়া কিংবা সংক্রমণের প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি বোঝার ক্ষেত্রে অটোফেজি দারুণ রাস্তা দেখিয়েছে। অটোফ্যাজি জিনের মিউটেশন যে কোনো রোগের কারণ হতে পারে এবং অটোফেজির এই প্রক্রিয়াটি ক্যান্সার এবং অন্যান্য স্নায়বিক রোগের সাথে যুক্ত থাকতে পারে।”

 

অটোফেজি এবং ইয়োশিনোরি ওহশোমি

অটোফেজি লাইসোসোম নির্ভর একটি প্রক্রিয়া। এটি শরীরের অভ্যন্তরীণ অঙ্গসমূহকে পরিষ্কার এবং রিসাইকল করার একটি পদ্ধতি। ০৮ অক্টোবর ২০১৬ এ প্রকাশিত প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, বিজ্ঞানী ইয়োশিনোরি ওহশোমি পৃথিবীতে সর্ব প্রথম অটোফেজি নিয়ে কাজ শুরু করেন। তিনি লক্ষ্য করেন লাইসোজম শুধু দেহের আবর্জনা বা ক্ষতিগ্রস্ত উপাদান জমা করে রাখে না। এটা রিসাইক্লিং চেম্বার বা নবায়নযোগ্য শক্তিব্যবস্থা হিসেবে কাজ করে নতুন উপাদান/কোষ তৈরি করে। ইউশিনোরি দেখিয়েছেন, কোষেরা নিজেরাই নিজেদের বর্জিতাংশ বা আবর্জনাকে আটকায়। এরপর সেখান থেকে উপকারী উপাদানগুলোকে ছেঁকে আলাদা করে ফেলে। তারপর ওই দরকারি উপাদানগুলো দিয়ে উৎপাদন করে শক্তি কিংবা গড়ে তোলে নতুন নতুন অনেক কোষ। মহৎ কাজ তাঁকে আজ ২০১৬ সালে নোবেল পুরস্কার এনে দিয়েছে

অর্থ্যাৎ, ওহশোমি এই অটোফেজি প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণকারী জিন শনাক্ত করেন এবং এইসব জিনে সমস্যা হলে কিভাবে বিভিন্ন রোগ সৃষ্টি হয় তা ব্যাখ্যা করতে সমর্থ হন।

 

অটোফেজির প্রয়োগ

ভাইরাল পোস্টে রোজার কারণে ক্যান্সারসহ বিভিন্ন রোগ নিরাময় হয় বলে দাবি করা হচ্ছে। “Can the science of autophagy boost your health?” শিরোনামে বিবিসি প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, ওজন কমানো এবং যৌবন ধরে রাখার একটি নতুন প্রক্রিয়া হতে পারে এই অটোফেজি।

সেখানে আরোও বলা হয়, ইঁদুরের উপর এক পরীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে, এই প্রক্রিয়ার অন্তর্গত ইঁদুরগুলি তুলনামূলক ভালোভাবে বেশিদিন বাঁচে। এছাড়াও অটোফেজি ক্যান্সারসহ আরোও অনেক রোগের ক্ষেত্রেই ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে বলেও অনেক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে। তবে যেহেতু এটি একটি নতুন প্রক্রিয়া তাই এখনো এ নিয়ে অনেক গবেষণা চলমান রয়েছে।

 

অটোফেজির সাথে রোজা কিংবা উপবাসের সম্পর্ক কি?

মেডিকাল নিউজ টুডে’র একটি নিবন্ধে বলা হচ্ছে, অটোফেজি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে শরীরের কোষগুলো পুরনো সঞ্চয় ফেলে দিয়ে নিজেকে নতুন করে তোলে। তবে কয়েকটি উপায়ে এই প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করা যেতে পারে। এর মধ্যে উপবাস বা রোজা একটি উপায়। এছাড়া ব্যায়ামের সাহায্যেও এই প্রক্রিয়া শুরু করানো যেতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে এইসব প্রক্রিয়ার বিভিন্ন পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া সম্পর্কেও সচেতন থাকতে বলা হয়েছে।

সুতরাং, দেখা যাচ্ছে যে জাপানিজ এই বিজ্ঞানী মূলত অটোফেজি নামক একটি প্রক্রিয়ার উপর গবেষণার কারণে নোবেল বিজয়ী হন, রমজানের উপর গবেষণা করে নয়। অটোফেজি একটি শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া, উপবাস বা রোজা রাখার মাধ্যমে এটিকে চাঙা করা যায়। কিন্তু উপবাস বা রোজামাত্রই অটোফেজি নয়। ওহশোমির গবেষণা অটোফেজি নিয়ে, কোনোভাবেই রমজানের রোজা নিয়ে নয়। তাই ফ্যাক্টওয়াচ এই দাবিকে “বিভ্রান্তিকর” চিহ্নিত করছে।

 

সংশোধনী : প্রথম অনুচ্ছেদের তৃতীয় বাক্যে ”অটোফেজি এমন একটি প্রক্রিয়া যার সাথে রোজা বা উপবাসের বেশ খানিকটা মিল আছে” -বাক্যটি সংশোধন করে ”অটোফেজি আর রোজা এক জিনিস নয়। অটোফেজি সাধারন শারীরবৃত্তীয় একটা প্রক্রিয়ার নাম। রোজা বা উপবাস যেটা ত্বরান্বিত করতে পারে” বাক্যটি যোগ করা হল। এর ফলে সামগ্রিক বক্তব্যটি অধিকতর পরিষ্কার হয়।

আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন?
কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন?
নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?

এসবের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে জানান।
আমাদেরকে ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh

Leave a Reply