মৌমাছি বিলুপ্ত হবার চার বছরের মধ্যে মানুষ বিলুপ্ত হবে – আইনস্টাইন বলেছেন এ কথা?

Published on: September 20, 2022   

আইনস্টাইনের মতে, মৌমাছি বিলুপ্ত হওয়ার চার বছরের মধ্যে পৃথিবীর সকল মানুষ মারা যাবে- এমন একটি দাবি সম্প্রতি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। অনুসন্ধানে আলবার্ট আইনস্টাইনের উক্তির নির্ভরযোগ্য কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বরং একাধিক প্রমাণের ভিত্তিতে এটিই বেশি যুক্তিযুক্ত যে, তিনি এমন কোনো মন্তব্য করেননি। এছাড়া আইনস্টাইনের বিষয়টি বাদ দিলেও উক্তিটির যথার্থতা পাওয়া যায় না। কারণ মৌমাছি বিলুপ্তির চার বছরের মধ্যে মানুষ মারা যাবে এমন দাবির পক্ষে কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায়নি।

এমন কিছু ফেসবুক পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে এবং এখানে

ভাইরাল এসব পোস্টের মূল দাবিটি হচ্ছে, আলবার্ট আইনস্টাইনের মতে, মধু ও মোমাছি বিলুপ্তির চার বছরের মধ্যে মানুষ মারা যাবে।

 

উক্তির সূত্রপাত

“কোট ইনভেস্টিগেটর” নামে উদ্ধৃতি অনুসন্ধানের একটি মাধ্যমে এই উক্তি সম্পর্কে অনুসন্ধান করা হলে, মৌমাছি নিয়ে ১৯০১ সালে প্রথম এমন একটি উক্তির সন্ধান পাওয়া যায়। উক্তিটি ছিলো এমন- “If I remember well, it was Einstein who said: “Remove the bee from the earth and at the same stroke you remove at least one hundred thousand plants that will not survive”। তবে উক্তিটি আইনস্টাইন করেছেন এমন কোনো প্রমাণ তারা পায়নি। তাদের মতে, মোরিস ম্যাটারলিনক (Maurice Maeterlinck) এর “দ্য লাইফ অব দ্য বি” এ ১৯০১ সালে তিনি এটি লিখেছিলেন। এর কয়েক দশক পর থেকেই উক্তিটি বিভিন্নভাবে ছড়িয়ে পড়ে।

পরবর্তীতে, ১৯৬৫ সালের মে মাসে একটি ফরাসি সাময়িকী “La Vie des Bêtes et l’Ami des Bêtes” দাবি করে যে, আইনস্টাইন গণনা করে দেখেছেন মৌমাছিবিহীন পৃথিবীতে মানুষ চার বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারবে।

এরপর আরোও বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে এই উক্তিটি ব্যবহৃত হয়। সর্বশেষ ২০২১ সালে দ্য গার্ডিয়ানের একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সেসময় একটি বাথরুমের পাশের ফলকের উপর পরিবেশবিদ স্যার ডেভিড অ্যাাটেনবোরো (David Attenborough) এর নামে একই মন্তব্য লিখা হয়। পরবর্তীতে বিষয়টি নজরে এলে অ্যাাটেনবোর’র হস্তক্ষেপে লিখাটি মুছে ফেলা হয়।

অন্যদিকে, বলিউডেও এমন উক্তির প্রমাণ পাওয়া যায়। ২০১০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত বিখ্যাত সিনেমা “মাই নেম ইজ খান” এর “তেরে নেয়না” নামে একটি গানে মৌমাছি সংক্রান্ত এই তথ্যটি দেখতে পাওয়া যায়। সিনেমার মূল দুই অভিনেতা শাহরুখ খান এবং কাজল । গানের এক পর্যায়ে আলবার্ট আইনস্টাইনের বরাতে তারা বলেন, যদি পৃথিবীর সব মধু মৌমাছি (Honey Bee) মারা যায় তবে তার ঠিক চার বছর পর সব মানুষও মারা যাবে। সম্ভবত এর পর থেকেই ভারতসহ এর পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে উক্তিটি ছড়িয়ে পড়ে।

ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধান

কোট ইনভেস্টিগেটরে উক্তিটি অনুসন্ধান করা হলে, একই উক্তির দুইটি আলাদা সংস্করণ পাওয়া যায়। উক্তি দুইটি এমনঃ

১. If the bee disappeared off the surface of the globe, then man would only have four years of life left. No more bees, no more pollination, no more plants, no more animals, no more man.

২. If the bee disappears from the surface of the earth, man would have no more than four years to live.

এ সম্পর্কে কোট ইনভেস্টিগেটর জানায়, এমন মন্তব্যের কোনো প্রকৃত প্রমাণ নেই। জানা যায়, এলিস ক্যালাপ্রাইস (Alice Calaprice) তার “The Ultimate Quotable Einstein” বইয়ের “Probably Not by Einstein” ক্যাটাগরিতে এই উক্তিটি অন্তর্ভুক্ত করেছেন। অর্থাৎ এই ক্যাটাগরিতে সেসব উক্তিই সন্নিবিষ্ট আছে, যেগুলো আইনস্টাইন বলেছেন এমন কোনো প্রমাণ কখনো পাওয়া যায় নি। ২০১০ সালে প্রকাশিত এই বইয়ে উপরোক্ত প্রথম উক্তিটি নিয়ে আলোচনা করা হয়। সেখানে ধারণা করা হয়, আইনস্টাইনের নিম্নোক্ত চিঠিটিকে বিকৃত করে উক্ত উক্তিটি তৈরি করা হয়েছে।

সেখানে স্নোপসের একটি প্রতিবেদনকে উদ্ধৃত করা হয়। “Did Einstein Say Without Bees, Mankind Would Soon Perish?” শিরোনামে স্নোপসের এই প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ১৯৯৪ সালে ব্রাসেলসে মৌমাছি সংগ্রাহকদের একটি প্রতিবাদ সভা হয়। সেখানে “ন্যাশনাল ইউনিয়ন অব ফ্রেঞ্চ এপিকালচার” নামে একটি সংগঠন কিছু লিফলেট বিতরণ করে। এমনই একটি লিফলেটে আলবার্ট আইনস্টাইনকে উদ্ধৃত করে বর্তমানে ভাইরাল এই উক্তিটি ছাপা হয়।

স্নোপস তাদের প্রতিবেদনে এই উক্তিটিকে অপ্রমাণিত (Unproven) চিহ্নিত করে। প্রতিবেদনের শেষে বলা হয়, ” All in all, this looks like a classic case of a useful quote being invented and put into the mouth of a famous person for political purposes.”।

ইউনিভার্সিটি অব জর্জিয়ার পতঙ্গবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কেথ এস ডেলাপ্লেন (Keith S. Delaplane) একটি প্রবন্ধে লিখেন, এই উক্তির সত্যতা নিয়ে নির্ভরযোগ্য কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। অধ্যাপক আরো বলেন, এমনকি মোটামুটি নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, তিনি এমন কথা বলেননি। এছাড়া তিনি আরোও লিখেন, আইনস্টাইন পতঙ্গবিদ ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন পদার্থবিদ, মৌমাছি বিষয়ে মন্তব্য করতে পারে পতঙ্গবিজ্ঞানীরা।

অর্থাৎ, পরিষ্কারভাবেই বুঝা যাচ্ছে যে আলবার্ট আইনস্টাইনের উক্ত মন্তব্যের কোনো প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যায়নি।

 

মৌমাছি বিলুপ্ত হলে মানুষও কি আসলেই চার বছরের মধ্যে বিলুপ্ত হবে?

এ বিষয়ে অনুসন্ধান করা হলে, Britannica.com এ একটি প্রবন্ধ পাওয়া যায়। সেখানে এর এডিটর “Melissa Petruzzello” লেখাটি লিখেন। প্রবন্ধের শেষ অনুচ্ছেদে মৌমাছি বিলুপ্তির সাথে মানবজাতির সম্পর্ক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়। পাঠোকদের জন্য অনুচ্ছেদটি বাংলায় অনুবাদ করা হলোঃ

“মৌমাছির ক্ষতি মানুষের খাদ্য ব্যবস্থাকে নাটকীয়ভাবে পরিবর্তন করবে কিন্তু তা দুর্ভিক্ষের দিকে নিয়ে যাবে না। এখনও মানুষের বেশিরভাগ খাদ্য  শস্যদানা থেকে আসে, যা বায়ু-পরাগায়িত এবং তা মৌমাছির সংখ্যা দ্বারা প্রভাবিত হয় না। তবে অনেক ফল ও সবজি পোকামাকড়-পরাগায়িত এবং মৌমাছি ছাড়া এত বিশাল পরিমাণে এবং এত সস্তায় উৎপাদন করা সম্ভব নয়। যেমন,  ব্লুবেরি এবং চেরি ফলের ৯০% পরাগায়ণ মৌমাছির উপর নির্ভরশীল। যদিও অনেক ফল এবং সবজি ফসলের হাতে পরাগায়ন করা সম্ভব, কিন্তু এটি অবিশ্বাস্যভাবে সময় এমং শ্র্মসাপেক্ষ। জাপানে ক্ষুদ্র রোবোটিক পরাগায়নকারী ড্রোন তৈরি করা হয়েছে; কিন্তু পুরো বাগান বা সময়-সংবেদনশীল ফুলের ক্ষেত্রে তা ভীষণ ব্যয়বহুল। মৌমাছি ছাড়া তাজা পণ্যের প্রাপ্যতা এবং বৈচিত্র্য উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাবে এবং মানুষের পুষ্টি খুব সম্ভবত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যে ফসলগুলি হাতে- বা রোবট-পরাগায়নের জন্য সাশ্রয়ী হবে না সেগুলি সম্ভবত হারিয়ে যাবে বা শুধুমাত্র মানুষের শখের বাগানে টিকে থাকবে”।

এছাড়া আমাদের বেঁচে থাকার জন্য মৌমাছি কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা জানতে অনুসন্ধান করা হলে বিবিসির একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়। সেখানে বলা হচ্ছে, মৌমাছি খুবই গুরুত্বপূর্ণ পরাগায়নকারী। তারা প্রায় ১০০ প্রজাতির ফসলের মধ্যে ৭০ টির পরাগায়ন করে যা বিশ্বের 90% খাদ্যের যোগান দেয়। অর্থের হিসাবে বছরে যা দাঁড়ায় ৩০ বিলিয়ন ডলার। সর্বোপরি সেখানে বলা হচ্ছে, ৭ বিলিয়ন জনসংখ্যাকে টিকিয়ে রাখতে মৌমাছিবিহীন একটি বিশ্বকে লড়াই করতে হবে।

অর্থ্যাৎ, পরিষ্কারভাবেই বুঝা যাচ্ছে মৌমাছি প্রকৃতি ও মানবজাতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই এর বিলুপ্তি ঘটলে খাদ্য শৃঙ্খলে ব্যাপক ব্যাঘাত ঘটবে। তবে তাদের বিলুপ্তির চার বছর পরে মানুষও বিলুপ্ত হবে এর পক্ষে কোনো যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায়নি।

পরিশেষে দেখা যাচ্ছে যে, মৌমাছি সম্পর্কিত আলবার্ট আইনস্টাইনের উক্তিটির নির্ভরযোগ্য কোনো প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে এটি নিশ্চিত যে মৌমাছি বিলুপ্ত হলে মানুষের খাদ্যশৃঙ্খলে ভীষণ ব্যাঘাত ঘটবে। কিন্তু মৌমাছি বিলুপ্তির চার বছর পর মানুষ মারা যাবে — এরকম হিসাব নিকাশ কেউ বৈজ্ঞানিকভাবে করেছেন এমন জানা যায় নি। পদার্থবিদ আইনস্টাইনের পক্ষে এমন মন্তব্য করা নিতান্ত মুশকিল। এটি হয়ত জীববিজ্ঞানী, পতঙ্গবিদ কিংবা খাদ্যবিশেষজ্ঞ বলতে পারবেন। তাই ফ্যাক্টওয়াচ এমন দাবিকে মিথ্যা চিহ্নিত করছে।

 

আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন?
কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন?
নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?

এসবের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে জানান।
আমাদেরকে ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh