কানাডার আদালতের সাম্প্রতিক রায়ে বিএনপিকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ বলা হয়নি

Published on: August 8, 2023

বিএনপিকে আবারও সন্ত্রাসী সংগঠন বললো কানাডার আদালত – এমন একটি সংবাদ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে  ছড়িয়ে পড়েছে । মূলধারার কয়েকটি সংবাদমাধ্যমও একই ধরনের সংবাদ প্রকাশ করেছে। তবে কানাডার আদালতের সাম্প্রতিক রায় (Haque v. Canada) বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, কানাডার আদালত বলছে বিএনপির সাথে সন্ত্রাসবাদের সম্পর্কের নির্ভরযোগ্য প্রমাণ তারা পায়নি। তবে বিএনপি এমন একটি সংগঠন যেটি জোরপূর্বক গণতান্ত্রিক সরকারকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করতে চেয়েছে বলে কানাডার আদালত মনে করে। অর্থাৎ, ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া দাবির সাথে কানাডার আদালতের রায়ে শব্দগত পার্থক্য রয়েছে। সঙ্গত কারণে ফ্যাক্টওয়াচ ভাইরাল দাবিকে বিভ্রান্তিকর সাব্যস্ত করছে।

গুজবের উৎস

ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া কয়েকটি পোস্ট দেখতে পাবেন এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে



মূলধারার গণমাধ্যমেও এই খবরটি ছড়িয়ে পড়েছে। এমন কয়েকটি খবর দেখুন এখানে , এখানে

ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধান

আর টিভির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলকে (বিএনপি) সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে অভিহিত করেছেন কানাডার আদালত। নিয়ে অভিবাসনসংক্রান্ত মামলার রায়ে কানাডার আদালতে বিএনপিকে পঞ্চমবারের মতো সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আখ্যায়িত করা হলো।

১৫ জুন টরন্টোর আদালতের রায় পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মোহাম্মদ জিপসেদ ইবনে হক নামে এক বিএনপির এক কর্মী কানাডায় রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন। যা কানাডার ফেডারেল কোর্ট নাকচ করে দেন।

জিপসেদ ইবনে হক রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা নাকচ করে দেওয়ার বিরুদ্ধে জুডিশিয়াল রিভিউ দায়ের করেছিলেন। সন্ত্রাসী দলের সদস্য অভিহিত করে তার সেই রিভিউটিও খারিজ করে দেয়া হয়।

রায়ে বলা হয়, রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনাকারী বিএনপির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বলপ্রয়োগ সন্ত্রাসের মাধ্যমে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাতের চেষ্টা করছে বিএনপি।

রায়ে আরও বলা হয়, বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়েছেন বলে দাবি করে কানাডায় রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছিলেন মোহাম্মদ জিপসেদ ইবনে হক। আবেদনকারী ২০১১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বিএনপির সদস্য ছিলেন বলে দাবি করেছেন।

কানাডার অভিবাসন কর্তৃপক্ষ মনে করে, বিএনপি বলপ্রয়োগ এবং নাশকতার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টা করেছে।বিএনপি একটি সন্ত্রাসী দল।

কানাডার ফেডারেল কোর্টের রায়ের মানদণ্ড হিসেবে ২০১৮ সালে মাসুদ রানা ২০২২ সালে সেলিম নামে বিএনপির অপর দুই কর্মীর রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন নাকচ করার প্রসঙ্গ টানা হয়। তখন ওই দুই আবেদনকারীর রায়েও বিএনপিকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে অভিহিত করা হয়েছিল।

এর আগে ২০১৭ সালে ঢাকার মিরপুরের স্বেচ্ছাসেবক দলের কর্মী পরিচয়ে কানাডায় রাজনৈতিক আশ্রয় চাওয়া মোহাম্মদ জুয়েল হোসেন গাজীর আবেদন নাকচ হয়েছিল। তখনো বিএনপিকে সন্ত্রাসী সংগঠন বলেছিলেন কানাডার আদালত।

বাংলাদেশ ছাত্র লীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক সভাপতি সঞ্জিত চন্দ্র দাস গত ৩১শে জুলাই নিজের ফেসবুক প্রফাইল থেকে  ৫ বার বিএনপিকে সন্ত্রাসী সংগঠন বলল কানাডার আদালত  শিরোনামে একটি ভিডিও প্রকাশ করেন । এই ভিডিওর ৪০তম সেকেন্ডে ভাষ্যকারকে বলতে শোনা যায়, কানাডার অভিবাসী কর্তৃপক্ষ ID বিএনপিকে এমন একটি সংগঠন বলে বিশ্বাস করার যুক্তিসঙ্গত কারন খুজে পেয়েছে যারা বলপ্রয়োগ এবং নাশকতায় জড়িত থেকে  আওয়ামীলীগ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টা করেছে। বিএনপি সন্ত্রাসবাদের সাথে জড়িত ছিলনা, তা বিশ্বাস করার যুক্তিসঙ্গত কোনো কারন আইডি খুজে পায়নি।

এসময় রায়ের কপির ৩ নাম্বার অনুচ্ছেদটি ভিডিওতে হাইলাইট করে দেখানো হয় । এই অনুচ্ছেদের শেষ বাক্য ছিল- The ID [Immigration Division] did not find reasonable grounds to believe that the BNP was an organization that had engaged in terrorism. যার বাংলা অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, বিএনপি সন্ত্রাসবাদের সাথে জড়িত ছিল, এমনটা বিশ্বাস করার যুক্তিসঙ্গত কোনো কারণ অভিবাসন বিভাগ খুঁজে পায়নি।

পাশাপাশি, এই রায়ে আরো বলা হয়েছে যে অভিবাসন দপ্তরের বিশ্বাস করার ন্যায্য কারণ আছে যে, বিএনপি এমন একটি সংগঠন যেটি আওয়ামিলীগ সরকারের বিরূদ্ধে শক্তি প্রদর্শন করে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল বা ইন্ধন দিয়েছে [“The ID found reasonable grounds to believe the BNP was an organization that had engaged in or instigated the subversion by force of the Awami League government in Bangladesh].

অর্থাৎ, মূল রায়ে বিএনপিকে “সন্ত্রাসবাদী সংগঠন” বলা হয় নি, বরং তারা অতীতে আওয়ামি লীগ সরকারের বিরূদ্ধে জোর খাটিয়ে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড করেছে বা এরকম কাজে ইন্ধন দিয়েছে। সুতরাং ভিডিওর দাবির সাথে আদালতের রায়ের সুস্পষ্ট পার্থক্য যাচ্ছে।

উল্লেখ্য, এই ভিডিওতে সময় টিভির লোগো দেখা গেলেও , এবং ভিডিও প্রতিবেদনের শেষে প্রতিবেদক ‘তাজওয়ার মাহমিদ, সময় সংবাদ’ হিসেবে পরিচয় দান করলেও বর্তমানে সময় টিভির ফেসবুক পেজে বা ইউটিউব চ্যানেলে এই ভিডিওটি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তবে সময় টিভির বরাতে অনেকেই এই ভিডিওটা শেয়ার করছেন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভেরিফাইড ফেসবুক পেজেও সময় টিভির কপিরাইট এর কথা উল্লেখ করে এই ভিডিওটি আপলোড করা হয়েছিল ।

কানাডার ফেডারেল কোর্ট এর ওয়েবসাইট থেকে Haque v. Canada শীর্ষক মামলার রায় সংগ্রহ করে দেখা গেল, মোহাম্মদ জিপসেদ ইবনে হক নামক বিএনপি’র এক কর্মী কানাডার নাগরিকত্বের আবেদনের প্রেক্ষিতে এই রায় দেয়া হচ্ছে। এখানে, জনাব হক এর সাথে বিএনপি’র সংশ্লিষ্টতার কারণে তার আবেদন নাকচ করা হয়েছে। কানাডার Immigration and Refugee Protection Act এর ৩৪ নং ধারা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি যদি অতীতে সন্ত্রাসবাদের সাথে যুক্ত থাকেন, বা কোনো দেশের সরকারকে বলপূর্বক উৎখাতের চেষ্টার সাথে জড়িত থাকেন, তাহলে তিনি কানাডায় থাকার জন্য অযোগ্য বিবেচিত হবেন।

এই আইনের ৩৪(১)(সি) ধারায় সন্ত্রাসবাদের সাথে যুক্ত থাকার কথা ( engaging in terrorism) এবং ৩৪(১)(বি )ধারায় কোনো সরকারকে বলপূর্বক উৎখাতের চেষ্টার কথা বলা হয়েছে।  (engaging in or instigating the subversion by force of any government)

এখানে, মোহাম্মদ জিপসেদ ইবনে হক বিএনপি’র রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন বলে আদালতে তার বক্তব্যে জানিয়েছিলেন  । বিচারক এখানে জিপসেদ হককে (এবং বিএনপিকে) উক্ত আইনের ৩৪(১)(বি) ধারা অনুযায়ী অনুপযুক্ত সাব্যস্ত করছেন।

উল্লেখ্য, একই ধরনের মামলায় অতীতেও কানাডার আদালতে ভিন্ন বিচারকের এজলাশে বাংলাদেশী আশ্রয়প্রার্থীদের আবেদন নাকচ করা হয়েছিল। ২০১৭ সালের Gazi v. Canada নামে পরিচিত মামলায় বিএনপি’র  জনৈক সাবেক কর্মী, মোহাম্মদ জুয়েল হোসেন গাজী  কানাডায় স্থায়ী নাগরিকত্বের আবেদন করেছিলেন। এসময় আদালত Immigration and Refugee Protection Act এর ৩৪ (১) (সি) ধারা অনুযায়ী জনাব জুয়েলকে, এবং বিএনপিকে সন্ত্রাসবাদের সাথে জড়িত হিসেবে সাব্যস্ত করে। ফলশ্রুতিতে তার আবেদনটি বাতিল হয়ে যায়।

২০১৮ সালের মে মাসে Kamal v. Canada নামে পরিচিত মামলায় বিএনপি কর্মী মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল কানাডায় শরণার্থী হিসেবে বসবাসের আবেদন করেছিলেন। সেই আবেদন প্রাথমিকভাবে গ্রহণ করা হলেও পরবর্তীতে Immigration and Refugee Protection Act এর ৩৪(১)(সি) এবং (বি) ধারা অনুযায়ী তাকে অগ্রহণযোগ্য সাব্যস্ত করা হয়।

২০১৮ সালের অক্টোবর মাসেই বিএনপি কর্মী মাসুদ রানার দায়ের করা অপর একটি মামলায় আদালত একই রায় দেয়। অর্থাৎ বিএনপিকে ৩৪(১)(সি) ধারা অনুযায়ী সন্ত্রাসবাদের সাথে জড়িত থাকা দল, এবং ৩৪(১)(বি)ধারা অনুযায়ী বলপ্রয়োগে সরকারকে উৎখাত করার চেষ্টায় নিয়োজিত রাজনৈতিক দল হিসেবে সাব্যস্ত করে।

২০২২ সালে বিএনপির অপর এক কর্মী, জনৈক সেলিম বাদশার মামলায় আদালত বিএনপিকে ৩৪(১)(সি) ধারায় অর্থাৎ সন্ত্রাসবাদের সাথে যুক্ত দল হিসেবে বিবেচনা করেছিল।

অর্থাৎ, অতীতের ৪ টি মামলাতেই কানাডার আদালত বিএনপি কর্মীদেরকে, এবং রাজনৈতিক দল বিএনপিকে Immigration and Refugee Protection Act এর ৩৪ (১) (সি) ধারা অনুযায়ী  সন্ত্রাসবাদের সাথে যুক্ত হিসেবে সাব্যস্ত করে তাদের আবেদন বাতিল করেছিল । অন্য কথায় ,এই ৪ টি মামলায় বিএনপি সন্ত্রাসবাদের সাথে যুক্ত রাজনৈতিক দল হিসেবে কানাডার ফেডারেল কোর্ট বিবেচনা করেছে। তবে বর্তমান মামলায় এই আদালত বিএনপিকে সন্ত্রাসী সংগঠন বা সন্ত্রাসবাদের সাথে যুক্ত সংগঠন হিসেবে মনে করার যথাযথ কারণ পায়নি। বরং বিএনপি বলপূর্বক আওয়ামি লীগ সরকারের বিরূদ্ধে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিল এমন সংগঠন হিসেবে বিশ্বাস করার প্রমাণ পেয়েছে। উভয় ক্ষেত্রেই বাদীদের কানাডায় বসবাসের অনুমতি নাকচ করা হয়েছে, তবে তবে তা কানাডিয়ান অভিবাসন আইনের ভিন্ন ভিন্ন ধারায়।

কানাডার আদালত আদতে কি রায় দিয়েছে, এই জল্পনা কল্পনার মাঝে গত ১লা আগস্ট দৈনিক মানব জমিন বিএনপিকে সন্ত্রাসী সংগঠন বলেনি কানাডার আদালত শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশ করেছে। এখানে বলা হয়, বিএনপিকে সন্ত্রাসী সংগঠন উল্লেখ করে কোনো রায় দেয়নি কানাডার আদালত। কানাডার আদালতের রায়ে বলা হয়েছে, ইমিগ্রেশন ডিপার্টমেন্ট এমন কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ পায়নি যাতে প্রতীয়মান হয় যে, বিএনপি সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে যুক্ত কোনো সংগঠন। গত ১৫ই জুন কানাডার ফেডারেল কোর্ট এ রায় ঘোষণা করে।

মোহাম্মদ জিপসেদ ইবনে হক নামের একজন বিএনপি কর্মীর দায়ের করা মামলায় আদালত এ পর্যবেক্ষণ দেয়। আদালতের ওয়েবসাইটে ২৬ পৃষ্টার রায়টি এখনও পাওয়া যাচ্ছে।

এতে আরও বলা হয়, ২০১১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত আবেদনকারী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপির সদস্য ছিলেন। প্রসঙ্গত এ রায়টি নিয়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে নানা আলোচনা চলছে।

ফ্যাক্টওয়াচ সার্বিক বিবেচনায় দাবিটিকে “বিভ্রান্তিকর” সাব্যস্ত করছে।

এই নিবন্ধটি ফেসবুকের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রামের নীতি মেনে লেখা হয়েছে।।
এর উপর ভিত্তি করে ফেসবুক যে ধরণের বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এখানে
এছাড়া এই নিবন্ধ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন, সম্পাদনা কিংবা আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার জন্য আবেদন করতে এই লিঙ্কের সাহায্য নিন।

কোনো তথ্যের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকেঃ
ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh