ইয়েমেনে পুরুষদের বহুবিবাহ আইনত বাধ্যতামূলক করা হয়েছে?

Published on: August 21, 2023

সম্প্রতি ইয়েমেনে বহুবিবাহ আইনত বাধ্যতামূলক – এমন দাবি করা পোস্ট ফেসবুকে ছড়াচ্ছে।  বলা হচ্ছে, “ইয়েমেন সরকার কর্তৃক প্রবর্তিত নতুন বহুবিবাহ আইন অনুযায়ী প্রত্যেক পুরুষকে কমপক্ষে দুটো বিয়ে করতে হবে এবং কোন ব্যক্তি যদি এই আইন অমান্য করে বা কোন স্ত্রী যদি তার স্বামীকে দ্বিতীয় বিয়ে করতে বাধা দেয় তাহলে ঐ অমান্যকারী কিংবা বাধাদানকারীকে ১৫ বছরের কারাদণ্ড দেওয়ার বিধান রয়েছে”। উক্ত পোস্টের সাথে সংযুক্ত ইয়েমেনের মিনিস্ট্রি অব এনডাউমেন্ট অ্যান্ড গাইডেন্স এর দায়িত্বরত মন্ত্রী আহমেদ আতিয়া (Ahmed Attia) এর স্বাক্ষরকৃত একটি নথি শেয়ার করা হয়েছে। সেখানে পুরুষদের বাধ্যতামূলক দুটো বিয়েসংক্রান্ত কিছু বিধিবিধানগুলো লক্ষ্য করা যায়। তবে, ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে জানা গেছে, ডক্টর আহমদ আতিয়া এর স্বাক্ষরকৃত পুরুষদের বহুবিবাহ (Polygamy) সংক্রান্ত উক্ত নথিটি জাল (Forged)। লেবাননের দৈনিক সংবাদপত্র আন-নাহার (An-Nahar) কর্তৃক প্রকাশিত একটি ফ্যাক্ট-চেকিং নিবন্ধ থেকে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। উল্লেখ্য, ইয়েমেনে পারসোনাল স্ট্যাটাস কোড অনুযায়ী পুরুষদের বহুবিবাহ বা চারটি বিয়ে করার অনুমোদন আছে। যেহেতু ইয়েমেনে বহুবিবাহ অনুমোদিত, সেহেতু সেখানে পুরুষদের দুটো বিয়ে করা বাধ্যতামূলক সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন যুক্তি অনুযায়ী খাটে না। সুতরাং, সঙ্গত কারণে ফ্যাক্টওয়াচ সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত পোস্টগুলোর দাবিকে “মিথ্যা” বলে সাব্যস্ত করছে।

 

এমন কিছু পোস্টের নমুনা দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এবং এখানে

 

ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধান:

সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত পোস্টের দাবি এবং উক্ত পোস্টের সাথে সংযুক্ত আহমেদ আতিয়া এর স্বাক্ষরকৃত নথিটির সত্যতা যাচাই করতে রিভার্স ইমেজ সার্চ পদ্ধতি ব্যবহার করে উক্ত নথিটির উৎস অনুসন্ধান করা হয়। অনুসন্ধানে লেবাননের দৈনিক সংবাদপত্র আন-নাহারে ৩০ নভেম্বর ২০২০ এ প্রকাশিত আরবি ভাষায় লিখিত একটি নিবন্ধের খোঁজ পাওয়া গেছে। অতঃপর গুগল ট্রান্সলেটরের সাহায্য নিয়ে আন-নাহারের ‘Yemen requires men to marry a second woman?’ – শীর্ষক শিরোনামের নিবন্ধটি আরবি থেকে বাংলায় অনুবাদ করে পড়ে দেখা গেছে যে, আন-নাহার সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া নথিটির বিষয়বস্তু সঠিক কিনা তা যাচাই করে দেখেছে এবং তারা জানতে পেরেছে যে ইয়েমেনের মিনিস্ট্রি অব এনডাউমেন্ট অ্যান্ড গাইডেন্স এর দায়িত্বরত মন্ত্রী আহমেদ আতিয়া এর স্বাক্ষরকৃত উক্ত নথিটি পুরানো এবং জাল। আন-নাহার আরও উল্লেখ করেছে যে, একই রকম জাল নথি ব্যবহার করে ২০১৬ সালে ইরাক, ইরিত্রিয়া, সুদান, এবং সৌদি আরবে পুরুষদের বাধ্যতামূলক বহুবিবাহ এর আইন প্রবর্তনের গুজব ছড়ানো হয়েছিলো। সেই সময় পুরুষদের বাধ্যতামূলক বহুবিবাহ এর আইন প্রবর্তনের দাবিকে গুজব হিসেবে চিহ্নিত করে সংবাদ প্রকাশ করেছিলো বেশকিছু আরবি সংবাদমাধ্যম। সংবাদগুলো দেখুন এখানে, এখানে, এবং এখানে। 

 

তাছাড়া, আহমেদ আতিয়া, যার স্বাক্ষর সংবলিত জাল নথিটি শেয়ার হয়েছিলো, তাঁর ব্যক্তিগত ফেসবুক এবং টুইটার অ্যাকাউন্টে জাল নথির একটি ছবি যুক্ত করে লিখেছেন যে, তাঁর নাম ব্যবহার করে ছড়িয়ে পড়া নথিটি জাল।

২০১৬ সালে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া পুরুষদের একাধিক বিবাহ বাধ্যতামূলক সংক্রান্ত আইন প্রবর্তনের গুজবটি নিয়ে বিবিসি নিউজ আরবি ‘The rumor of “compulsory polygamy” begins in Iraq and reaches Eritrea’ – শীর্ষক শিরোনামে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করে।  উক্ত নিবন্ধটি পড়ে জানা গেছে যে, পুরুষদের কমপক্ষে দুটো বিয়ে করা আইনত বাধ্যতামূলক – এই গুজবটি ইরিত্রিয়ায় ছড়িয়ে পড়ার আগে ইরাকে প্রথম শুরু হয়। ‘লেটারহেড (Letterhead) অথবা কোন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার স্বাক্ষর সংবলিত একটি সরকারি নথি ফাঁস হয়েছে এবং ফাঁসকৃত নথি থেকে জানা গেছে সরকার পুরুষদের একাধিক বিয়ে করা বাধ্যতামূলক সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করেছে’ – এরকম পদ্ধতি অনুসরণ করে ইরাক এবং ইরিত্রিয়ায় গুজবটি ছড়ানো হয়েছিলো। তাছাড়া, নিবন্ধটি পড়ে ইরাক থেকে ছড়িয়ে পড়া গুজবটির উৎপত্তি সম্পর্কে কিছুটা আঁচ করা গেছে। নিবন্ধটিতে বলা হয়েছে, ইরাকে দীর্ঘ যুদ্ধের পর বহু নারী বিধবা হয়েছেন এবং অবিবাহিত পুরুষের ঘাটতি আছে বিধায় দেশটির রাজনীতিবিদরা পুরুষদের দ্বিতীয় বিয়ে করা সাপেক্ষে তাদের আর্থিক প্রণোদনা দেওয়ার চিন্তাভাবনা করেন। তবে, উক্ত আর্থিক প্রণোদনার প্রস্তাবটি পরবর্তীতে আইন হিসেবে প্রণীত হয়নি।

 

উল্লেখ্য, কিছু আরব দেশগুলোতে বহুবিবাহকে স্বাভাবিক বলে গণ্য করা হয়। এমনকি ইয়েমেনে পারসোনাল স্ট্যাটাস কোড অনুযায়ী পুরুষদের একাধিক বিয়ে করা অনুমোদন রয়েছে। দেশটির পারসোনাল স্ট্যাটাস ল (Law) এর ১২ নং ধারার প্রথম এবং দ্বিতীয় উপধারায় বলা হয়েছে, পুরুষদের জন্য একাধিক স্ত্রী রাখার অনুমোদন রয়েছে এবং তারা কিছু শর্ত পূরণ করা সাপেক্ষে অন্য আরেকটি বিয়ে করতে পারবেন। যেহেতু ইয়েমেনে বহুবিবাহ আইনত অনুমোদিত, সেহেতু সেখানে নতুন আইন প্রণয়ন করে বহুবিবাহ বাধ্যতামূলক করা যুক্তিযুক্ত নয়। আর সেরকম কিছু হয়নিও ইয়েমেনে। 

অতএব, আমাদের উপরের আলোচনা থেকে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে যে, ইয়েমেনে বহুবিবাহ বাধ্যতামূলক করার যে নথিটি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিলো তা আসল নয় এবং একইরকম জাল নথি ব্যবহার করে পূর্বে ইরাক, ইরিত্রিয়া, সুদান, এবং সৌদি আরবে বহুবিবাহ বাধ্যতামূলক করার গুজবটি ছড়ানো হয়েছিলো। 

সুতরাং, সবকিছু বিবেচনা করে ফ্যাক্টওয়াচ সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত পোস্টের দাবিকে “মিথ্যা” বলে সাব্যস্ত করছে।

এই নিবন্ধটি ফেসবুকের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রামের নীতি মেনে লেখা হয়েছে।।
এর উপর ভিত্তি করে ফেসবুক যে ধরণের বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এখানে
এছাড়া এই নিবন্ধ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন, সম্পাদনা কিংবা আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার জন্য আবেদন করতে এই লিঙ্কের সাহায্য নিন।

কোনো তথ্যের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকেঃ
ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh