জাপানে অতিরিক্ত মোটা হওয়ার কারণে ট্যাক্স দিতে হয়?

Published on: July 19, 2023

সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমে একটি পোস্ট শেয়ার করে দাবি করা হচ্ছে যে, জাপানে ২০০৮ সালে প্রণীত “Metabo Law” এর আওতায় কেউ অতিরিক্ত মোটা হলে তাকে ট্যাক্স দিতে হবে। তবে, ফ্যাক্টওয়াচ অনুসন্ধান করে দেখেছে যে, জাপানে স্থূলতা (Obesity) কমানোর লক্ষ্যে ২০০৮ সালের জানুয়ারি মাসে “Metabo Law” নামক একটি আইন পাস করা হয়, যেখানে ৪৫ থেকে ৭৪ বছর বয়সী নারী ও পুরুষদের বছরে একবার তাদের কটিরেখা (Waistline) মাপতে বলা হয়েছে এবং কারও কটিরেখা যদি নির্দেশিত মাপ (Range) থেকে বেশি থাকে তাহলে তাদেরকে চিকিৎসা নিতে বলা হয়েছে। তাছাড়া, উক্ত পোস্টটিতে তথ্যসূত্র হিসেবে “New York Times” এর নাম উল্লেখ করা ছিলো বিধায় ঐ পত্রিকায় ২০০৮ সালে জাপানে স্থূলতা কমানোর উদ্যোগ নিয়ে প্রকাশিত একটি নিবন্ধ পাওয়া যায়। সেখানে বলা হয়, প্রতিষ্ঠানগুলো এবং স্থানীয় সরকার তাদের নাগরিক/কর্মচারিদের স্থুলতার বিষয়টি ম্যানেজ করতে না পারলে সেসব প্রতিষ্ঠান কিংবা স্থানীয় সরকারকে জরিমানা গুনতে হবে। স্থুলকায় ব্যক্তিকে ট্যাক্স কিংবা জরিমানা দেয়ার কোনো বিধান সেখানে ছিল না। সঙ্গত কারণে ফ্যাক্টওয়াচ সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত পোস্টের দাবিটিকে “বিভ্রান্তিকর” বলে সাব্যস্ত করছে। 

এমন কিছু পোস্টের নমুনা দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এবং এখানে

 

 

ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধান:

সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত পোস্টের দাবিটির সত্যতা যাচাই করতে আমরা প্রাসঙ্গিক কিছু কি-ওয়ার্ড ব্যবহার করে গুগল সার্চ করি এবং যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক ফ্যাক্ট-চেকিং সংস্থা “Snopes” এর একটি রিপোর্ট খুঁজে পাই। “Is It Illegal to be Fat in Japan?” শীর্ষক শিরোনামের ঐ ফ্যাক্ট-চেকিং রিপোর্টটিতে বলা হয়েছে যে, জাপান ২০০৮ সালে দেশটিতে স্থূলতার (Obesity) পরিমাণ কমানোর লক্ষ্যে তাদের ৪৫ থেকে ৭৪ বছর বয়সী সকল নারী ও পুরুষের জন্য “Metabo Law” নামক একটি আইন পাস করে, যেখানে উক্ত বয়সসীমার মধ্যে অবস্থানরত মানুষদের বলা হয়েছিলো তারা যেন বছরে একবার তাদের কটিরেখা (Waistline) পরিমাপ করে দেখে এবং কটিরেখা নির্দেশিত মাপের (Range) চেয়ে বেশি হলে তারা যেন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়। রিপোর্টটিতে আরও বলা হয়েছে যে, উক্ত আইনটি স্থূলতাকে কোন আইনের অপরাধমূলক লঙ্ঘন (Criminal offense) হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেনি। 

 

মূলত, “Metabo Law” নামটি এসেছে metabolic syndrome থেকে, যা দ্বারা উচ্চ রক্তচাপ, রক্তে উচ্চ শর্করার উপস্থিতি, শরীরের অতিরিক্ত চর্বি, এবং শরীরে অস্বাভাবিক কোলেস্টেরলের মাত্রা এর কথা বুঝানো হয়েছে যা হৃদযন্ত্রের বিভিন্ন রোগ, স্ট্রোক, ডায়াবেটিসসহ আরও নানা জটিল রোগের কারণ হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক পাবলিক রেডিও নিউজ প্রোগ্রাম দি ওয়ার্ল্ড এ ১০ নভেম্বর ২০০৯ এ প্রকাশিত “Fat in Japan? You’re breaking the law.” শীর্ষক শিরোনামের একটি নিবন্ধে বলা হয়েছে, জাপানে মানুষরা মেটাবলিক সিন্ড্রোম (Metabolic syndrome) থেকে রেহাই পেতে এবং সরকার কর্তৃক আরোপিত আদর্শ কটিরেখার মানদন্ডের (Standard) সাথে সংহতি রেখে চলতে মেদ (Fat) পরিহারের চেষ্টা করছে। নিবন্ধটিতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, জাপানি আইনপ্রণেতারা ৪০ এর বেশি বয়সী নারী এবং পুরুষদের কটিরেখার সর্বোচ্চ মাপ নির্ধারণ করে দিয়েছে, যা পুরুষদের ক্ষেত্রে ৮৫ সেন্টিমিটার বা ৩৩.৫ ইঞ্চি এবং নারীদের ক্ষেত্রে ৯০ সেন্টিমিটার বা ৩৫.৪ ইঞ্চি। তবে, স্থূলতা সম্পর্কিত স্বাস্থ্য ঝুঁকি কমিয়ে খরচ বাঁচানোর উদ্দেশ্যে প্রবর্তিত জাপানের “Metabo Law” এর সাথে অনেকেই একমত হতে পারেননি। ডাক্তার এবং স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, জাপানি আইনপ্রণেতাদের ঠিক করে দেওয়া কটিরেখার সীমা (Limits) ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিস ফেডারেশন এর প্রস্তাবিত নির্দেশিকার সাথে সাংঘর্ষিক। তাছাড়া, জাপানের টোকাই বিশ্ববিদ্যালয় (Tokai University) এর স্কুল অব মেডিসিন এর অধ্যাপক এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ইয়োচি ওগোশি (Yoichi Ogushi) বলেছেন, “জাপানিদের ওজন কমানোর কোন প্রয়োজন নেই।” তিনি আরও বলেছেন, “ওজন কমানোর জন্য পরিচালিত প্রচারণার কোন ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আমি মনে করি না। একইরকম প্রচারণা যদি আমেরিকায় চালানো হয় তাহলে সেখানে অনেকেই উপকৃত হবে কারণ অনেক আমেরিকানই আছে যাদের ওজন ১০০ কিলোগ্রামেরও (২২০ পাউন্ড) বেশি। কিন্তু জাপানিরা এতই লিকলিকে যে তারা ওজন কমাতে পারে না।”  

 

তবে সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত পোস্টটিতে উত্থাপিত দাবির তথ্যসূত্র হিসেবে নিউ ইয়র্ক টাইমস এর নাম উল্লেখ করা হয়েছিলো বিধায় আমরা ঐ পত্রিকায় জাপানে স্থূলতা কমানোর উদ্যোগ নিয়ে প্রকাশিত একটি নিবন্ধ খুঁজে পাই। ১৩ জুন ২০০৮ এ প্রকাশিত “Japan, Seeking Trim Waists, Measures Millions” শীর্ষক শিরোনামের ঐ নিবন্ধটিতে অতিরিক্ত মোটা হওয়ার জন্য কোন ট্যাক্স প্রদানের কথা উল্লেখ নেই। বরং, নিবন্ধটিতে বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানগুলো তার কর্মচারিদের এবং স্থানীয় সরকারগুলো তাদের নাগরিকদের স্থুলতার বিষয়টি খেয়াল রাখবে। যদি তারা তাদের আওতায় থাকা মানুষজনের অতিরিক্ত ওজন কমানোর জন্য নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থ হয়, তাহলে জাপানের সরকার সেসব প্রতিষ্ঠান বা স্থানীয় সরকারগুলোকে আর্থিক জরিমানা করবে কিন্তু স্থুলকায় ব্যক্তিকে আর্থিক জরিমানা করা কিংবা তাদের ওপর ট্যাক্স আরোপের কোনো বিধান সেখানে ছিল না।

 

অতএব, আমাদের আলোচনা থেকে এই বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে যে, জাপানে অতিরিক্ত মোটা হওয়ার কারণে সরকারকে ট্যাক্স দেওয়ার জন্য “Metabo Law” এর প্রবর্তন হয়নি। বরং, ৪৫ থেকে ৭৪ বছর বয়সী নারী-পুরুষদের স্থূলতা সম্পর্কিত শারীরিক জটিলতা প্রশমন করতে উক্ত আইনটি প্র করা হয়েছিলো।

সুতরাং, সবকিছু বিবেচনা করে ফ্যাক্টওয়াচ সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত পোস্টের দাবিটিকে “বিভ্রান্তিকর” বলে সাব্যস্ত করছে।

এই নিবন্ধটি ফেসবুকের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রামের নীতি মেনে লেখা হয়েছে।।
এর উপর ভিত্তি করে ফেসবুক যে ধরণের বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এখানে
এছাড়া এই নিবন্ধ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন, সম্পাদনা কিংবা আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার জন্য আবেদন করতে এই লিঙ্কের সাহায্য নিন।

কোনো তথ্যের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকেঃ
ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh