ল্যান্ডিং গিয়ার বিকল হওয়া উড়োজাহাজ নিশান গাড়ির মাধ্যমে অবতরণ করেছে?

Published on: August 1, 2023

সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত একটি ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে যে, একটি উড়োজাহাজের ল্যান্ডিং গিয়ার বিকল হয়ে যাওয়ায় সেটা একটি লাল রঙের পিকআপ ভ্যানের সাহায্যে নিরাপদে অবতরণ করেছে এবং ভিডিওটি দেখে মনে হচ্ছে যে পিকআপ ভ্যানটির চালক তার সাহসিকতায় উড়োজাহাজ যাত্রীদের জীবন বাঁচিয়েছেন। তবে, ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে জানা গেছে যে, উক্ত ভিডিওটি কোন বাস্তব ঘটনার নয়। বরং, নিশান ব্র্যান্ডের একটি গাড়ির জন্য তৈরিকৃত বিজ্ঞাপন এটি। জোয়িক স্টুডিওজ (Zoic Studios) নামক একটি ভিজুয়াল এফেক্ট কোম্পানি উক্ত বিজ্ঞাপনটি নির্মাণ করেছিলো এবং উক্ত স্টুডিওর ইউটিউব চ্যানেল থেকে প্রাপ্ত একটি ভিডিও থেকে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। মূলত, সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত ভিডিওটি যে একটি বিজ্ঞাপনের অংশ তা কোথাও স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি বলে শেয়ারকারীরা এটিকে আসল ঘটনা ভেবে বিভ্রান্ত হচ্ছেন। সঙ্গত কারণে ফ্যাক্টওয়াচ উক্ত ভিডিওটির দাবিকে “মিথ্যা” বলে সাব্যস্ত করছে।

এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এবং এখানে

 

ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধান:

সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত ভিডিওটির দাবির যথাযথতা যাচাই করতে আমরা উক্ত ভিডিও থেকে কিছু স্ক্রিনশট নিয়ে রিভার্স ইমেজ সার্চ করি এবং বেশকিছু ইউটিউব ভিডিও, ফ্যাক্ট-চেকিং রিপোর্ট, এবং নিবন্ধ খুঁজে পাই। সামাজিক মাধ্যমে যে ভিডিওটিকে পিকআপ ভ্যানের চালকের সাহসিকতায় উড়োজাহাজ যাত্রীদের জীবন বেঁচেছে বলে দাবি করা হচ্ছে তার সাথে আমাদের রিভার্স ইমেজ সার্চে প্রাপ্ত কয়েকটি ইউটিউব ভিডিওর হুবহু মিল রয়েছে। উক্ত ইউটিউব ভিডিওগুলো থেকে জানা গেছে যে, উড়োজাহাজের ল্যান্ডিং গিয়ার বিকল হয়ে যাওয়ায় একটি পিকআপ ভ্যানের সহায়তায় অবতরণ করার দৃশ্যটি বাস্তব কোন ঘটনা নয় বরং, এটি নিশান ব্র্যান্ডের একটি গাড়ির জন্য নির্মাণকৃত বিজ্ঞাপনের অংশ। যেমন: ইউটিউব থেকে প্রাপ্ত এই ভিডিওর ডানপাশে নিচে লেখা রয়েছে, “Fictionalization: Do not attempt” অথবা এই ভিডিওটির বর্ণনায় লেখা হয়েছে, “This is not actual real time footage, but a clever TV commercial Ad for the Nissan Frontier Pickup Truck.” উল্লেখ্য, “NissanUK” নামক একটি অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল থেকে ২৫ নভেম্বর ২০১১ সালে “Nissan FRONTIER Saves Aeroplane from Crashing” শিরোনামের একটি ভিডিও প্রকাশ করে যার সাথে সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত ভিডিও এবং ইউটিউব থেকে প্রাপ্ত অন্যান্য ভিডিওগুলোর মিল রয়েছে।

আমাদের রিভার্স ইমেজ সার্চের ফলাফলে স্নোপস এবং ফ্যাক্টলি নামক দুটো ফ্যাক্ট-চেকিং সংস্থার নিবন্ধ পাওয়া গেছে যেখানে পিকআপ ভ্যানের চালকের সাহসিকতায় উড়োজাহাজ যাত্রীদের জীবন বেঁচেছে – শীর্ষক দাবিটিকে খন্ডন করা হয়েছে। ফ্যাক্টলির লেখা ঐ ফ্যাক্ট-চেকিং রিপোর্টটিতে নিশান ফ্রন্টিয়ার এর বিজ্ঞাপনটি তৈরির কারিগর হিসেবে আমেরিকার জোয়িক স্টুডিওজ (Zoic Studios) এর নাম উল্লেখ করা হয়েছে যারা ভিজুয়াল এফেক্ট বা ভিএফএক্স (VFX) প্রযুক্তি ব্যবহার করে পিকআপ ভ্যানের সাহায্যে উড়োজাহাজ অবতরণের বিজ্ঞাপনটি নির্মাণ করেছে। জোয়িক স্টুডিওজ এর ওয়েবসাইটে উক্ত বিজ্ঞাপন সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য দেওয়া আছে এবং তাদের ইউটিউব চ্যানেলে নিশান ফ্রন্টিয়ার এর বিজ্ঞাপনটি কিভাবে নির্মাণ করা হয়েছিলো তার একটি ভিডিও প্রকাশ করা হয়েছে। উক্ত ভিডিওটি দেখলেই বুঝা যাবে যে পিকআপ ভ্যানের সাহায্যে উড়োজাহাজ অবতরণের ঘটনাটি বাস্তব নয়। 

তাছাড়া, একটি পিকআপ ভ্যানের পক্ষে উড়োজাহাজের সামনের চাকা বা নাকের দিককার ভার বহন করা প্রায় অসম্ভব। জালোপনিক (Jalopnik) নামক একটি ওয়েবসাইটে প্রকাশিত “Science Smackdown: Nissan Frontier Airplane Ad” শীর্ষক শিরোনামের নিবন্ধে বলা হয়েছে যে, একটি বোয়িং ৭২৭ (Boeing 727) উড়োজাহাজের অবতরণকালে ওজন হয় প্রায় ৭৩০০০ কেজি (Kilogram) এবং তখন সেটা ঘন্টায় ১৫০ থেকে ১২০ মাইল বেগে রানওয়ের দিকে ছুটে যায়। অবতরণকালে একটি উড়োজাহাজের সামনের চাকা বা ল্যান্ডিং গিয়ারকে ঐ উড়োজাহাজটির মোট ওজনের পাঁচ থেকে দশ পার্সেন্ট ওজন বহন করতে হয়। তাহলে অবতরণকালে একটি উড়োজাহাজের ল্যান্ডিং গিয়ারের ওজন দাঁড়ায় প্রায় ২৩০০ কেজি। তাছাড়া, উড়োজাহাজটির নাক বা ল্যান্ডিং গিয়ার যত নিচের দিকে নামবে ততই তার ওজন বৃদ্ধি পেতে থাকবে। এখন ৬৮০ কেজি ধারণক্ষমতা সম্পন্ন নিশান ফ্রন্টিয়ার এর উপর যদি ২৩০০ কেজি ওজনের ল্যান্ডিং গিয়ার, যা ঘন্টায় ১০০ মাইলেরও অধিক বেগে ছুটছে, রাখা হয় তাহলে পিকআপ ভ্যানটির পুরো কাঠামো ভেঙেচুরে যাবে। অতএব, সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত ভিডিওটিতে পিকআপ ভ্যানের সহায়তায় উড়োজাহাজ অবতরণের যে দৃশ্যটি দেখা যাচ্ছে তা বাস্তবে প্রায় অসম্ভব। 

উল্লেখ্য, এর আগেও প্রতারণাপূর্ণ বিজ্ঞাপন প্রচারের দায়ে নিশান এবং একটি বিজ্ঞাপন সংস্থার বিরূদ্ধে অভিযোগ করেছিলো আমেরিকার ফেডারেল ট্রেড কমিশন। উক্ত বিজ্ঞাপনটিতে নিশান ফ্রন্টিয়ার এর পিকআপ ভ্যানটিকে প্রতারণাপূর্ণভাবে উপস্থাপন করা হয়েছিলো। অর্থাৎ, ভ্যানটির পক্ষে যে কাজ করা সম্ভব নয় সেটা বিজ্ঞাপনে দেখানো হয়েছে। ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে প্রকাশিত একটি প্রেস রিলিজ থেকে জানা গেছে, বিজ্ঞাপনে পিকআপ ভ্যানের প্রতারণাপূর্ণ প্রদর্শন করা যাবে না – এই শর্তে নিশান ব্র্যান্ড ফেডারেল ট্রেড কমিশনের অভিযোগটি নিষ্পত্তি করেছে।  

অতএব, উপরের আলোচনা থেকে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে যে, উড়োজাহাজের ল্যান্ডিং গিয়ার অকেজো হয়ে যাওয়ায় সেটা একটি পিকআপ ভ্যানের সাহায্যে অবতরণ করেছে এবং ভ্যানটির চালকের সাহসিকতায় উড়োজাহাজ যাত্রীদের জীবন বেঁচেছে – এই ঘটনাটি বাস্তব নয়। বরং, সামাজিক মাধ্যমে আমরা যে ভিডিওটি দেখেছি সেটা একটা বিজ্ঞাপনের অংশ।

সুতরাং, সবকিছু বিবেচনা করে ফ্যাক্টওয়াচ উক্ত ভিডিওটির দাবিকে “মিথ্যা” বলে সাব্যস্ত করছে।

এই নিবন্ধটি ফেসবুকের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রামের নীতি মেনে লেখা হয়েছে।।
এর উপর ভিত্তি করে ফেসবুক যে ধরণের বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এখানে
এছাড়া এই নিবন্ধ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন, সম্পাদনা কিংবা আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার জন্য আবেদন করতে এই লিঙ্কের সাহায্য নিন।

কোনো তথ্যের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকেঃ
ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh