ইসরায়েল ও হামাসের চলমান সংঘাতের প্রেক্ষিতে ভাইরাল ছবিদুটোর একটি এআই নির্মিত অন্যটি পুরানো

Published on: October 12, 2023

ইসরায়েল এবং হামাসের চলমান সংঘাতকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে । অন্যান্য কিছু ছবির সাথে একই পোস্টে এই ছবি আপলোড হওয়ায়, এবং কৌশলী ক্যাপশনের কারণে ফেসবুক ব্যবহারকারীরা এই ছবিগুলোকে সাম্প্রতিক সময়ের ছবি ভেবে বিভ্রান্ত হতে পারেন । এর মাঝে হামাস ছত্রীসেনাদের আল আকসা মসজিদের চারপাশে অবতরণের ছবিটি এআই নির্মিত বলে প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। আর হুইলচেয়ারে বসে স্লিং-শটের মাধ্যমে ঢিল ছুঁড়ে মারার ছবিটি ৫ বছরের পুরনো বলে অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।

একারণে ফ্যাক্টওয়াচ পোস্টগুলোকে “বিভ্রান্তিকর” হিসেবে চিহ্নিত করছে। 

গুজবের উৎস 

ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া কয়েকটি পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে

ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধান 

এই পোস্টগুলোতে দুইটি করে  ছবি আপলোড করা হয়। আপলোড করা প্রথম ছবিতে দেখা যায় অস্ত্রে সজ্জিত ছত্রীসেনারা প্যারাশুটের মাধ্যমে আল-আকসা মসজিদের চারপাশে অবতরণ করছে। দ্বিতীয় ছবিটিতে দেখা যায় একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি হুইলচেয়ারে বসে স্লিং-শটের (ঘুর্ণন শক্তি কাজে লাগিয়ে ছোড়া) মাধ্যমে ভারি বস্তু ছুঁড়ে মারছেন।

পোস্টগুলোর ক্যাপশনে লেখা ছিলো “ক্বাবা রক্ষায় উড়ে আসা পাখীরূপী আবাবিল আমি দেখিনি

তবে আল-আকসা রক্ষায় উড়ে আসা মানুষরূপী আবাবিল দেখছি এই প্রতিবন্ধী ভাইয়ের সাহস দেখে গোটা মুসলিম বিশ্ব আজ গর্বিত আল্লাহপাক ফিলিস্তিনি বাসিকে রক্ষা করুন আমিন

…আল্লাহু আকবার,,,”।

অর্থ্যৎ ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া পোস্টগুলো সাম্প্রতিক সময়ে ইসরায়েল এবং ফিলিস্থিনের সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের মধ্যকার চলমান সংঘাতের সময়ে ধারণ করা এমন আভাস দিচ্ছে।

 

প্রথম ছবিটির সত্যতা

 

১০ অক্টোবর, ২০২৩ তারিখে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম সিবিএস নিউজের সংবাদে হামাস ইসরায়েলের কোন শহরে আক্রমণ করেছে তার একটি ম্যাপ প্রকাশ করে। ম্যাপে দেখা যায় হামাস যোদ্ধারা গাজা স্ট্রিপের (Gaza Strip) সীমান্তে থাকা ইসরায়েলের শহরগুলোতে প্রবেশ করতে পারে। অর্থ্যৎ হামাসের আক্রমণ কিংবা অনুপ্রবেশ গাজা স্ট্রিপের সীমান্তবর্তী ইসরায়েলের শহরগুলোতে হয়।

গুগল ম্যাপে দেখা যাচ্ছে হামাসের আক্রমণের শিকার ইসরায়েলের শহরগুলোর ভিতর দেরত (Sderot) আল আকসা মসজিদের সব থেকে নিকটবর্তী শহর। দেরত থেকে আল আকসা মসজিদের দূরত্ব কমপক্ষে ৮৯.১ কিলোমিটার।

এ থেকে বোঝা যাচ্ছে হামাস গাজা স্ট্রিপের নিকটবর্তী সীমান্ত এলাকায় হামলা করে এবং কিছু ছত্রীসেনা সেখানে প্যারাশুটের মাধ্যমে অবতরণ করে। কিন্তু হামাসের যোদ্ধারা আল আকসা মসজিদের আশপাশে প্যারাশুট নিয়ে নামেনি। হামাসের আক্রমণকৃত স্থান থেকে আল আকসা মসজিদ আরো ৮৯.১ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।

Huggingface নামক এআই ইমেজ শনাক্তকারী টুল দিয়ে যাচাই করলে ছবিটির ৯৫% এআই নির্মিত বলে জানা যায়।

 

দ্বিতীয় ছবির সত্যতা

১৮ই অক্টোবর, ২০১৮ সালে এএফপি প্রকাশিত একটি সংবাদ থেকে জানা যায় মাহমুদ হামস ২৫তম বাইয়ুক্স-কালভাডোস যুদ্ধের প্রতিবেদক গাজার বাসিন্দাদের “গ্রেট মার্চ অফ রিটার্ন” বিক্ষোভের সময় হুইলচেয়ার-আবদ্ধ বিক্ষোভকারীর ছবিটির জন্য পুরস্কার পান। এই ছবিগুলো ১১ই মে ২০১৮ সালে তোলা হয়েছিলো। এএফপির সংবাদে হুইলচেয়ারে বসা ব্যক্তির পরিচয় দিতে গিয়ে বলা হয়: “হুইলচেয়ারে থাকা লোকটি একজন পরিচিত বিক্ষোভকারী। তার নাম সাবের আল-আশকার এবং বিশ্বাস করুন বা না করুন তার বয়স মাত্র ২৯। সে দেখতে অনেক বেশি বয়স্ক। সে একটি বাসে আসে এবং তার বন্ধুরা তাকে নামতে সাহায্য করে এবং তাকে প্রতিবাদের স্থানে নিয়ে যায়।”

উক্ত খবর থেকে আরো জানা যায় সেখানে আরও দু’জন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ছিলেন যারা নিয়মিত বিক্ষোভকারীও ছিলেন, কিন্তু তাদের হত্যা করা হয়েছে।

অতএব ,  দেখা যাচ্ছে দ্বিতীয় ছবিটি বর্তমান সময়ের না। ছবিটি ১১ই মে, ২০১৮ সালে ধারণকৃত ছবি। এই ব্যক্তির নাম সাবের আল আসকার ।

উল্লেখ্য, একই রকম শারীরিক কাঠামোযুক্ত অপর এক ব্যক্তির পাথর ছোড়ার দৃশ্যও অনলাইনে ছড়িয়ে পড়েছিল। তাঁর নাম ফাদি আবু সালেহ। এই দু’জনের ছবি নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভ্রান্তিও তৈরি হয়েছে।

২৪শে মে, ২০২১ সালে  Periodismo De Izquierda নামক আর্জেন্টাইন গণমাধ্যমে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে আলোচ্য ছবিটির সদৃশ একটি ছবি পাওয়া যায়। নিবন্ধটির শিরোনাম ছিলো “প্যালেস্টাইন, ক্ষমতা এবং অক্ষমতা মধ্যে সীমানা অতিক্রম”। এখানে দাবি করা হয় , ছবিটি ফাদি আবু সালেহ নামক একজন যুবকের।

 

১৮ই আগস্ট, ২০১৮ সালে Haber Kudüs নামক একটি এক্স একাউন্ট থেকে দুই পা না-থাকা প্রতিবন্ধী ব্যক্তির পাথর ছোঁড়ার বেশকিছু ছবি আপলোড করা হয়। ওই পোস্টটিতে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ছবিটির অনুরূপ ছবিও ছিলো। পোস্টটি দেখুন এখানে

তবে ১৫ই মে, ২০১৮ সালে BuzzFeed News থেকে প্রকাশিত একটি রিপোর্টে জানা যাচ্ছে এই পা না থাকা হুইলচেয়ারে বসা এই যুবকের নাম ফাদি আবু সালেহ না। ছবিতে থাকা ব্যক্তিটি ২৯ বছর বয়সী সাবের আল আসকার। ছবিটি ক্যামেরাবন্দি করেন এএফপির ফটগ্রাফার মাহমুদ হামস। মাহমুদ হামস ছবিগুলো তুলেছিলেন ১৫ই মে, ২০১৮ সালে যখন ইসরায়েল সেনা এবং ফিলিস্তিনের গাজা স্ট্রিপের জনগণের মধ্যে সংঘর্ষ চলছিল। ওই সংঘর্ষে ৬০ জন ফিলিস্তিনি মারা যায় এবং এই মারা যাওয়া ব্যক্তিদের ভিতর ফাদি আবু সালেহও ছিলেন। তবে মাহমুদ হামসের জানান এই সংঘর্ষে আসকার মারা যায়নি।

তবে তৎকালীন সময়ে এই ছবিটাকে ইসরায়েলের সেনাবাহিনীর গুলিতে মারা যাওয়া ফাদি আবু সালেহর ছবি দাবি করে টুইটারে প্রচার করা হয়। উল্লেখ্য ফাদি আবু সালেহ ২০০৮ সালে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে এক বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে ইসরায়েলি সেনাদের গুলিতে পা হারায়।

১৪ই মে, ২০১৮ সালে দি আরব নিউজের করা একটি প্রতিবেদন থেকেও ফাদি আবু সালেহের মৃত্যুর ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে।

অর্থাৎ, এটা নিশ্চিত যে এই আলোচিত ছবিটি সাম্প্রতিক সময়ের নয়।

সারমর্ম

ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ছবি দুইটির প্রথমটি এআই অথবা ফটো এডিটিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে। আর দ্বিতীয় ছবিটি বর্তমান সময়ের না। কিন্তু ছবি দুইটিকে হামাস এবং ইসরায়েলের চলমান সংঘাতের প্রেক্ষিতে প্রচার করা হচ্ছে। এ কারণে ফ্যাক্টওয়াচ পোস্টগুলোকে “বিভ্রান্তিকর” হিসেবে চিহ্নিত করছে।

 

এই নিবন্ধটি ফেসবুকের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রামের নীতি মেনে লেখা হয়েছে।।
এর উপর ভিত্তি করে ফেসবুক যে ধরণের বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এখানে
এছাড়া এই নিবন্ধ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন, সম্পাদনা কিংবা আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার জন্য আবেদন করতে এই লিঙ্কের সাহায্য নিন।

কোনো তথ্যের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকেঃ
ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh