ঋষি সুনাকের শাশুড়ির শৈশব নিয়ে মিথ্যা গল্প

Published on: November 7, 2022

সম্প্রতি ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের শাশুড়ি সুধা মূর্তিকে নিয়ে একটি ফেসবুক পোস্ট ভাইরাল হয়েছে। সেখানে দাবি করা হচ্ছে, সুধা মূর্তির বয়স যখন ১৩ কিংবা ১৪ তখন তিনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান এবং একটি ট্রেনে করে যাওয়ার সময় তাকে সিটের নিচে আবিষ্কার করেন শ্রীমতি ঊষা ভট্টাচার্য নামের এক যাত্রী। পরবর্তীতে তিনি তার টিকেটের টাকা দেন এবং তাকে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কাছে থাকার জন্য পাঠিয়ে দেন। কিন্তু অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, এটি সুধা মূর্তির নিজের গল্প নয়। বরং তাঁর নিজের লেখা বই “দ্য ডে আই স্টপড ড্রিংকিং মিল্ক” থেকে নেয়া একটি গল্প। গল্পের নাম “বোম্বে টু ব্যাঙ্গালোর”। এটি তাঁর নিজের অভিজ্ঞতা থেকে লেখা। সেখানে তিনি নিজে কিভাবে একটি মেয়েকে ট্রেন থেকে এনে একটি সুন্দর জীবন দিয়েছেন তার গল্প লিখেছেন। এছাড়া সুধা মূর্তির শৈশবকালের সাথেও এই গল্পের কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি। অর্থ্যাৎ, তাঁর লেখা গল্পকেই তাঁর নিজের শৈশব বলে প্রচার করা হচ্ছে।

এমন কয়েকটি ফেসবুক পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে এবং এখানে

পোস্টটি হুবুহু তুলে ধরা হলোঃ

একবার একজন টিটিই (ট্রেন টিকিট পরীক্ষক) যিনি মুম্বাই থেকে বেঙ্গালুরুগামী ট্রেনে ডিউটিতে ছিলেন, তিনি একটি মেয়েকে ধরেছিলেন যে একটি সিটের নীচে লুকিয়ে ছিল। তার বয়স ছিল প্রায় 13 বা 14 বছর।

টিটিই মেয়েটিকে তার টিকিট দেখাতে বলে। মেয়েটি ইতস্তত করে উত্তর দিল যে, তাঁর কাছে টিকিট নেই।

TTE মেয়েটিকে অবিলম্বে ট্রেন থেকে নামতে বলে।

হঠাৎ পেছন থেকে একটা আওয়াজ বললোআমি ওর জন্য টাকা দেব এটি ছিল শ্রীমতি ঊষা ভট্টাচার্যের কণ্ঠস্বর, যিনি পেশায় একজন কলেজের প্রভাষক ছিলেন। মিসেস ভট্টাচার্য মেয়েটির টিকিটের টাকা দিয়ে তাকে তাঁর কাছে বসতে অনুরোধ করলেন। সে তার নাম কি তাকে জিজ্ঞাসা করতে মেয়েটি উত্তর দিলচিত্রা

তুমি কোথায় যাচ্ছো?”

আমার কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই।মেয়েটি বলল..

তাহলে চলো আমার সাথে।মিসেস ভট্টাচার্য তাকে বললেন। ব্যাঙ্গালোরে পৌঁছানোর পর, মিসেস ভট্টাচার্য মেয়েটিকে একটি এনজিও(স্চ্ছোসেবী সংস্থার) কাছে হস্তান্তর করেন, যত্ন নেওয়ার জন্য। পরে মিসেস.ভট্টাচার্য দিল্লিতে চলে যান এবং দুজনের যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

প্রায় 20 বছর পর মিসেস ভট্টাচার্যকে সান ফ্রান্সিসকো (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) একটি কলেজে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল।

সে একটি রেস্তোরাঁয় ছিল, খাবার খাচ্ছিল। তিনি শেষ করার পরে তিনি বিলের জন্য জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কিন্তু তাকে বলা হয়েছিল যে, বিল ইতিমধ্যেই পরিশোধ করা হয়েছে। যখন তিনি ফিরে গেলেন, তিনি দেখতে পেলেন একজন মহিলা তার স্বামীর সাথে তার দিকে তাকিয়ে হাসছেন। মিসেস ভট্টাচার্য দম্পতিকে জিজ্ঞাসা করলেন, “কেন আপনি আমার বিল পরিশোধ করলেন?”

যুবতী উত্তর দিল, “ম্যাম, মুম্বাই থেকে ব্যাঙ্গালোর ট্রেন যাত্রার জন্য আপনি আমার জন্য যে ভাড়া দিয়েছিলেন, তার তুলনায় আমি যে বিলটি আপনার জন্য দিয়েছি তা খুবই কম। উভয় মহিলার চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।

ওহ চিত্রাএটা তুমি…!!” খুশিতে অবাক হয়ে বললেন মিসেস ভট্টাচার্য।

পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে যুবতী বলল, “ম্যামআমার নাম এখন চিত্রা নয়। আমি সুধা মূর্তি। আর ইনি আমার স্বামী, বিশ্ববিখ্যাত সফটওয়্যার কোম্পানি ইনফোসিসের কর্ণধার নারায়ণ মূর্তি।

বিস্মিত হবেন না. আমিই ইনফোসিস লিমিটেডের চেয়ারম্যানের স্ত্রী মিসেস সুধা মূর্তি, এবং আমার স্বামীই হলেন সেই মি. নারায়ণ মূর্তি, যিনি বহু মিলিয়ন ইনফোসিস সফটওয়্যার কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

হ্যাঁ, অন্যদের কাছে আপনার সামান্য সাহায্যই তাদের পুরো জীবনটাই বদলে দিতে পারে!

অনুগ্রহ করে যারা কষ্টে আছে, তাদের ভালো করা থেকে বিরত থাকবেন না, বিশেষ করে যখন এটি করার ক্ষমতা আপনার হাতে আছে আপনি সবার জন্য একটি সুন্দর সুখী জীবন কামনা করুন।

এই গল্পের একটু গভীরে যাই

অক্ষতা মূর্তিএই দম্পতির মেয়ে, (যাঁর বাবা দুনিয়া কাঁপানো সফটওয়্যার কোম্পানি ইনফোসিসের কর্ণধার নারায়ণ মুর্তি এবং মা অনাথ আশ্রমে প্রতিপালিত চিত্রা, পরে নাম হয় সুধা মুর্তি) তিনিঋষি সুনাককেবিয়ে করেছেন যিনি সম্প্রতি বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন।

(আপনার সামান্য একটু সাহায্য একজন মানুষের ভাগ্য কতোটা বদলে দেবার ক্ষমতা রাখে, দয়া করে একটু চিন্তা করে দেখবেন)”।

 

 

ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধান

 

ভাইরাল এই পোস্ট থেকে বিভিন্ন কি-ওয়ার্ডের সাহায্যে অনুসন্ধান করা হলে, একই পোস্ট ইংরেজিতেও খুঁজে পাওয়া যায়।

সেখান থেকে পুনরায় কিছু কি-ওয়ার্ডের সাহায্যে অনুসন্ধান করে, ২৪ আগস্ট, ২০১২ এ প্রকাশিত একটি ব্লগ পাওয়া যায়। “Bombay To Bangalore” by Sudha Murthy” শিরোনামে প্রকাশিত এই ব্লগে বলা হচ্ছে, সুধা মূর্তির লেখা বই ‘দ্য ডে আই স্টপড ড্রিংকিং মিল্ক’ থেকে এই গল্পটি নেয়া হয়েছে। গল্পের নাম ‘বোম্বে টু ব্যাঙ্গালোর’।

মূল গল্পটি খুঁজতে চেষ্টা করা হলে সুধা মূর্তির লেখা ‘দ্য ডে আই স্টপড ড্রিংকিং মিল্ক” বইটি খুঁজে পাওয়া যায়। সেখানে থাকা একটি বর্ণনা থেকে জানা যায়,সুধা মূর্তি তার নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে এই বইয়ের গল্পগুলো নিয়েছেন। সেখানে তিনি গল্পের মুল চরিত্রের নাম পরিবর্তন করে তাদের কাহিনীগুলো পাঠকের সামনে নিয়ে আসেন।

 

অনেকগুলো গল্পের মধ্যে এমনই একটি গল্পের নাম ‘বোম্বে টু ব্যাঙ্গালোর’। মূল গল্পের একটি সারাংশ পাঠকদেরর জন্য তুলে ধরা হলোঃ

সুধা মূর্তি একবার ট্রেনে করে ব্যাঙ্গালোর যাচ্ছিলেন। সেসময় ট্রেনে তার সিটের নিচে লুকিয়ে থাকা ১৩-১৪ বছরের একটি মেয়ের সাথে তাঁর পরিচয় হয়। মেয়েটির কাছে টিকেটের টাকা না থাকায় তিনি তাঁর ট্রেনের ভাড়াটি মিটিয়ে দেন। পরবর্তীতে মেয়েটির সাথে কথা বলে জানা যায়, তার নাম চিত্রা (সম্ভবত ছদ্মনাম), তার বাবা একজন কুলি এবং সে জন্মের সময় তার মাকে হারিয়েছে। তার বাবা পুনরায় বিয়ে করে। তার বাবা মারা গেলে তার সৎ মা তাকে অত্যাচার করা শুরু করে তাই সে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসে। ট্রেনটি ব্যাঙ্গালোর আসার পর ঘটনাক্রমে সুধা মূর্তি তাকে তার বন্ধুর একটি আশ্রয়কেন্দ্রে রেখে আসে এবং তার পড়ালেখার দায়িত্ব নেন। এভাবেই চিত্রা একসময় কম্পিউটার সাইন্সে ডিপ্লোমা করে এবং শেষ পর্যন্ত একটি চাকরিও পেয়ে যায়। পরবর্তীতে সে আমেরিকা চলে যায়। অনেকদিন পর সুধা মূর্তি সেন ফ্রান্সিসকোতে একটি লেকচার দিতে গিয়ে সেখানে চিত্রা তাকে একটি সারপ্রাইজ দেয় এবং তার সাথে দেখা করে। জানা যায়, সে অনেক ভালো আছে এবং সে একটি ছেলেকে বিয়ে করতে যাচ্ছে। গল্পে ছেলেটির নাম জন উল্লেখ করা হয়।



একই বিষয়ে নিউজচেকারের একটি ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন থেকে বইটির একটি রিভিউ খুঁজে পাওয়া যায়। ‘Goodreads’ এর এই রিভিউ থেকেও জানা যায়, বইটি সুধা মূর্তির নিজের অভিজ্ঞতা থেকে লেখা নিজের বই।

 

মূল গল্পে কোথাও চিত্রার মূল পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি। বর্তমানে ভাইরাল পোস্টটিতে ১১ পৃষ্ঠার এই গল্পটিকেই ছোট করে “শ্রীমতি ঊষা ভট্টাচার্য” নামে কারোর অভিজ্ঞতা বলে দাবি করা হচ্ছে। তবে কে এই ঊষা ভট্টাচার্য তার কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। এসব পোস্টে চিত্রা চরিত্রটিকে মূলত সুধা মূর্তি বলে দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু মূল গল্পে দেখা যাচ্ছে, এটি সুধা মূর্তির নিজের লেখা গল্প এবং চিত্রা নামের মেয়েটি এমন একটি চরিত্র যাকে তিনি একসময় সাহায্য করেছিলেন।

 

অন্যদিকে, পদ্মশ্রী খেতাবে ভূষিত সুধা মূর্তির শৈশবকালের সাথেও চিত্রা চরিত্রের কোনো মিল পাওয়া যায়না। তাঁর বাবা ছিলেন একজন সার্জন এবং তার মা স্কুল শিক্ষিকা। তিনি তাঁর বাবা-মা এবং দাদির সাথে বড় হয়েছেন। কিন্তু গল্পের চিত্রা চরিত্রের বাবা ছিলেন কুলি এবং মা জন্মের সময়ই মারা যায়। এই একটি অসংগতি থেকেই পরিষ্কার বুঝা যায়, এটি সুধা মূর্তির নিজের গল্প হতেই পারেনা।

 


 

উল্লেখ্য, সুধা মূর্তি এন আর নারায়ণ মূর্তিকে বিয়ে করেন। তাঁদের দুই সন্তানের একজন হলেন অক্ষতা মূর্তি, যিনি ইংল্যান্ডের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের স্ত্রী। ঋষি সুনাক প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই মূলত এমন একটি গল্প ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়তে দেখা যাচ্ছে।

সুধা মূর্তির জীবন সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে তাঁর উইকিপিডিয়া পেজটি দেখুন এখানে

 

অর্থ্যাৎ, পরিষ্কারভাবেই দেখা যাচ্ছে ভাইরাল এই গল্পটি সুধা মূর্তির নিজের কাহিনী নয়। বরং তাঁর লেখা বই থেকে গল্পটি নেয়া হয়েছে। তাঁর জীবনে দেখা এবং শোনা অনেক অভিজ্ঞতার উপর বইটি লিখেছিলেন তিনি। এমনই একটি গল্প হচ্ছে চিত্রার গল্প, যাকে ভাইরাল পোস্টে সুধার নিজের জীবনের গল্প হিসেবে চালিয়ে দেয়া হয়েছে। তাই ফ্যাক্টওয়াচ এমন তথ্য সংবলিত পোস্টগুলোকে মিথ্যা চিহ্নিত করছে।

 

আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন?
কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন?
নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?

এসবের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে জানান।
আমাদেরকে ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh