ভারতের তাইমারা উপত্যকায় মোবাইলের সময় বদলে যায়?

Published on: July 31, 2023

ভারতের ঝাড়খন্ডের তাইমারা উপত্যকা দিয়ে অতিক্রমের সময় মোবাইল এর সময় পরিবর্তিত হয়ে কয়েক বছর ভবিষ্যতে চলে যায়- এমন একটি গুজব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। তবে ভারতের একাধিক সংবাদমাধ্যম জানাচ্ছে, এটা সম্পূর্ণ গুজব। একাধিক সংবাদমাধ্যম উক্ত এলাকায় অনুসন্ধানী টিম পাঠালে তাদের মোবাইল ফোনে কোনো ধরনের সময়ের পরিবর্তন দেখা যায়নি। এছাড়া, স্থানীয় অধিবাসীদের সাথে আলাপচারিতায়ও তারা এর সত্যতা খুঁজে পায়নি। সঙ্গত কারণে ফ্যাক্টওয়াচ ফেসবুকে এ ধরনের পোস্টগুলোকে ‘মিথ্যা’ সাব্যস্ত করছে।

গুজবের উৎস

ভারত থেকে বছরখানেক আগে ইংরেজি এবং আঞ্চলিক ভাষায় এই গুজবের সূত্রপাত হয়েছিল। সম্প্রতি বাংলাদেশে এবং বাংলা ভাষাতে এই গুজব দেখা যাচ্ছে।  বাংলা ভাষায় এমন কয়েকটি পোস্ট দেখুন এখানে , এখানে , এখানে , এখানে

ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধান

দূরবিন নিউজ নামক ফেসবুক পেজের এই ভিডিওতে বলা হয়েছে, রহস্যময় এক অঞ্চল অতিক্রম করার সময় হঠাত করেই ফোনের সময় কিংবা তারিখ পরিবর্তিত হয়ে যায়। তাও আবার এক বা দু’মিনিটের ব্যাপার নয়। ফোনগুলাতে পুরা দেড় কিংবা দু’বছর আগের ভবিষ্যৎ সময় দেখানো হয়। অর্থাৎ, ২০২৩ সালে কোনো ব্যক্তি যদি সেই অঞ্চল দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যান তাহলে তাঁর ফোনের সময় পরিবর্তিত হয়ে ২০২৪ কিংবা ২০২৫ সাল দেখাবে।

অদ্ভূত এই স্থানটির দেখা মিলবে বাংলাদেশেরই পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে। সেখানকার ঝাড়খন্ড রাজ্যের রাচি-টাটা ন্যাশনাল হাইওয়েতে অবস্থিত তাইরামা উপত্যকাকে ঘিরে প্রতিনিয়তই ঘটে চলেছে এমন অদ্ভূত সব ঘটনা। ফোনে সময় পরিবর্তন হবার পাশাপাশি জানা যায় , চলন্ত গাড়ির স্পিডোমিটারের সাথে গাড়ির আসল গতিবেগের কোনো মিল খুজে পাওয়া যায়না । কখনো কখনো বন্ধ গাড়ি নিজে থেকেই আপনা আপনি স্টার্ট হয়ে যায়। কখনোবা এ স্থানে কেউ প্রথম এসেও অদ্ভূতভাবে অনুভব করেন জীবনে বহুবার এস্থানে এসেছেন তারা।

তাইমারা উপত্যকাকে ঘিরে এমন আজগুবি সব কাহিনী প্রচলিত থাকায় বহু উতসুক মানুষেরাই এর আসল রহস্য উদ্ধারে এখানে ভীড় জমান। যারা যারা এই তাইমারা উপত্যকায় এসেছিলেন, তাদের মধ্যে অনেকেই অদ্ভূত সব অভিজ্ঞতার সাক্ষী হয়ে আছেন। এরপর এই স্থান নিয়ে তাদের ব্যক্তিগত মতামতের ভিত্তিতে বানানো ভিডিও ও রিলস সোস্যাল মিডিয়ায় প্রকাশিত হলে রীতিমত তা নিয়ে হট্টগোল বেধে যায়।

তবে সকলেই যে এমন পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন, তা ও কিন্তু নয়। এ কারনে তাইমারা উপত্যকাকে নিয়ে বেশ বিতর্ক ও রয়েছে । তবে ভারতের বেশ কিছু গণমাধ্যম ও স্থানীয় অধিবাসীরা এ ঘটনাগুলো সত্য বলে নিশ্চিত করেছেন। তাইমারা উপত্যকাকে ঘিরে ঘটে চলে এসব ঘটনা যে গুজব নয়, তাঁর পরিষ্কার একটি ধারনা দিয়েছিলেন রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব বিভাগের প্রভাষক ডা নীতিশ প্রিয়দর্শী। তিনি জানিয়েছেন, স্বয়ং তাঁর নিজের বন্ধুই এমন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন। সময়টা ছিল তখন ২০২২ সালের ১১ই জানুয়ারি। স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর সেই বন্ধুটি তাইমারা উপত্যকা সড়কে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ড্রাইভিং এর সময় হঠাত করেই একটি কল চলে আসায় তাৎক্ষনিক তিনি ফোনটি ধরতে পারেননি। এরপরে গাড়ি থামিয়ে কলব্যাক করার উদ্দেশ্যে ফোন হাতে নিতেই রীতিমত থ হয়ে গেলেন তিনি। ফোনের স্ক্রিনে দেখা গেল, কল আসার সময়টা ছিল ২০২৩ সালের ২৭শে আগস্ট ।

ঠিক কি কারনে তাইমারা উপত্যকায় এমন রহস্যময় সব ঘটনা ঘটে, আর কেনই বা এখানে এলে ফোনের সময় পরিবর্তিত হয়ে যায় , এমন হাজারো সব প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খেলেও এর প্রকৃত কারন আজ পর্যন্ত কেউ বের করতে পারেননি। তবে বিশেষজ্ঞরা ধারনা করছেন, এই অঞ্চলটিতে বিশেষ ধরনের চৌম্বক শক্তি রয়েছে, যার দরুন এর প্রভাব সরাসরি গিয়ে পড়ে মোবাইল ফোন , গাড়ি সহ বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স পণ্যের উপরে। কিন্তু এটা কেবলই ধারনা। বিজ্ঞানীরা তাইমারা উপত্যকার সত্য উদ্ঘাটনে এখনো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে তাইমারা উপত্যকার মত পৃথিবীতে এমন আরো স্থান রয়েছে যার রহস্য জয় করা মানুষের পক্ষে এখনো সম্ভব হয়নি।

অনুসন্ধানের মাধ্যমে ড. নীতিশ প্রিয়দর্শী’র লেখা একটি কলাম খুজে পাওয়া গেল n7india.com এ । এখানে ডক্টর নিতিশ দাবি করেছেন, তাঁর এক বন্ধু (সঞ্জয় বোস) ২০২২ সালের ১১ই জানুয়ারি তারিখে ওই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। এ সময়ে তাঁর ফোনে একটি মিসড কল আসে। কলের সময় চেক করতে গিয়ে দেখতে পান, কলটি এসেছিল ২০২৩ সালের ১৭ই আগস্ট তারিখে, অর্থাৎ দেড় বছর ভবিষ্যৎ থেকে ।

এই আর্টিকেলে ডক্টর নীতিশ ফোনের কললিস্টের একটি স্ক্রিনশট যুক্ত করেছেন , যার রেজোলুশন খুবই খারাপ এবং এখান থেকে কিছুই পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।

এছাড়া উক্ত সঞ্জয় বোস এর সাথে যোগাযোগ এর ও কোনো উপায় উক্ত নিবন্ধে (বা অন্য কোনো সূত্রে) পাওয়া যায়নি।

তবে মোবাইল এর সময় এর সেটিংস পরিবর্তন করে ভবিষ্যতের কোনো সময় সেট করে রাখা খুবই সহজ। পরিবর্তিত সেটিং এ কোনো ফোন কল এলে তাকে ‘ভবিষ্যৎ সময় থেকে আগত ফোন কল’ হিসেবে উক্ত ডিভাইসে দেখানো হবে।

উদাহরণস্বরুপ, এই প্রতিবেদকের মোবাইলে আজ, ২০২৩ সালের ২৪শে জুলাই তারিখে  ২০২৪ সাল থেকে আসা এই মিসড কলটি লক্ষ করুন । মোবাইলের সেটিং পরিবর্তন করে অন্য ডিভাইস থেকে একটি কল করে এমন ‘ভবিষ্যৎ থেকে আসা মিসড কল’ রেকর্ড করার জন্য সব মিলিয়ে ২ থেকে ৩ মিনিট সময় দরকার হয়েছে।

ভারতের দুইটি আঞ্চলিক সংবাদ মাধ্যম , প্রভাত খবর এবং জাগরন ,তাইমারা উপত্যকার এই গুজবটি নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

প্রভাত খবর জানাচ্ছে,  তাদের সাংবাদিক দল এই স্থানে ৪ ঘণ্টা অবস্থান করেছে, এবং এই সময়ে দলের কারো মোবাইলেই সময় কিংবা তারিখ পরিবর্তিত হয়নি। তারা স্থানীয়দের সাথেও কথা বলেছে, এবং সময় পরিবর্তনের এই দাবির সত্যতা খুঁজে পায়নি। স্থানীয় একটি স্কুলের উপস্থিতির ডিজিটাল রেকর্ডারে তারিখ পরিবর্তিত হয়ে সমস্যা দেখা দিয়েছিল বলে গুজব উঠেছিল। প্রভাত খবর এর দল উক্ত বিদ্যালয়ে (কস্তুরবা গান্দী বালিকা বিদ্যালয়) গিয়ে জানতে পারে, কেবলমাত্র একবার এমন ঘটনা ঘটেছিল  । এটি যেকোনো যান্ত্রিক ত্রুটির কারণেও ঘটতে পারে।

জাগরণ এর খবরে বলা হয়েছে, কস্তুরবা গান্দী বালিকা বিদ্যালয় উক্ত উপত্যকাতেই অবস্থিত নয়। বিদ্যালয়টা জামচুন নামক অন্য এক এলাকায় অবস্থিত , যেটি তাইমুরা উপত্যকা থেকে বেশ দূরে।  দৈনিক জাগরণ এর সাংবাদিক তাইমুরা উপত্যকায়  নিজের মোবাইল বের করে সময় চেক করেছেন এবং ছবিও তুলেছেন, কিন্তু সময় বা তারিখে কোনো ধরনের পরিবর্তন দেখতে পাননি। কোনো সরকারী সংস্থা,কিংবা কোনো মোবাইল সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান এই এলাকার এমন কোনো অস্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যের কথা নাগরিকদের অবহিত করেনি।

দূরবিন নিউজের ভিডিওতে দাবি করা হয়েছে, এই এলাকায় চলন্ত গাড়ির স্পিডোমিটারের সাথে গাড়ির আসল গতিবেগের কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না । কখনো কখনো বন্ধ গাড়ি নিজে থেকেই আপনা আপনি স্টার্ট হয়ে যায়।

তবে ডক্টর নিতিশ চক্রবর্তী কিংবা অন্য কারো বর্ণনায় এমন কোনো ঘটনা খুঁজে পাওয়া যায়নি।

যেহেতু , তাইমারা উপত্যকায় ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস এর সময় পরিবর্তনের দাবির সপক্ষে কোনো জোরালো প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না , এবং একাধিক অনুসন্ধানী সাংবাদিক সরেজমিনে উক্ত এলাকায় গিয়ে এই দাবির কোনো সত্যতা খুঁজে পায় নি, তাই ফ্যাক্টওয়াচ এসংক্রান্ত পোস্টগুলোকে মিথ্যা সাব্যস্ত করছে।

এই নিবন্ধটি ফেসবুকের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রামের নীতি মেনে লেখা হয়েছে।।
এর উপর ভিত্তি করে ফেসবুক যে ধরণের বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এখানে
এছাড়া এই নিবন্ধ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন, সম্পাদনা কিংবা আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার জন্য আবেদন করতে এই লিঙ্কের সাহায্য নিন।

কোনো তথ্যের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকেঃ
ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh