শুধুমাত্র বাম হাতের অনামিকাই হৃৎপিণ্ডের সাথে যুক্ত?

Published on: June 27, 2023

সামাজিক মাধ্যমে প্রায়ই একটি পোস্ট শেয়ার হতে দেখা যায় যে, বিয়ের আংটি বাম হাতের অনামিকায় বা চতুর্থ আঙ্গুলে পরা হয় কারণ ঐ একটি আঙ্গুলের শিরাই (Veins) সরাসরি হৃৎপিণ্ডের সাথে যুক্ত। প্রাচীন মিশরীয় বিশ্বাস অনুযায়ী এই শিরাটিকে Vein of Love বা লাতিন ভাষায় Vena Amoris নামে ডাকা হয়। কিন্তু মানবদেহের শারীরসংস্থানবিদ্যা (Anatomy) অনুযায়ী হাতের প্রত্যেকটি আঙ্গুলই শিরার মাধ্যমে হৃৎপিণ্ডের সাথে যুক্ত, যা আঙ্গুল থেকে হৃৎপিণ্ডের দিকে রক্ত বহন করে নিয়ে যায় এবং আঙ্গুলে তাপ, চাপ, এবং ব্যথার অনুভূতি প্রদান করে। তাই, একমাত্র বাম হাতের অনামিকা বা চতুর্থ আঙ্গুলের শিরা সরাসরি হৃৎপিণ্ডের সাথে যুক্ত – এই তথ্যটি সঠিক নয়। মূলত বিয়ের আংটি কোন হাতের কোন আঙ্গুলে পরা হবে তা নির্ভর করে পরিধানকারীর বিশ্বাস, সংস্কৃতি, সমাজ, এবং তিনি কোন সময়ে বাস করছেন তার উপর। সঙ্গত কারণে ফ্যাক্টওয়াচ সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত পোস্টের দাবিকে “মিথ্যা” বলে সাব্যস্ত করছে।

এরকম কিছু পোস্টের নমুনা দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এবং এখানে

Image: Example of a viral Facebook post

 

ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধান:

শুধুমাত্র বাম হাতের অনামিকার শিরার সাথে হৃৎপিণ্ডের সরাসরি সংযোগ রয়েছে?

মানবদেহের হৃৎপিণ্ডের কাজ হচ্ছে রক্তকে পাম্প করে পুরো শরীরের প্রত্যেকটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গে তা পৌঁছে দেওয়া। মানবদেহে রক্তসংবহনের এই প্রক্রিয়াকে সাহায্য করে শিরা (Veins) এবং ধমনী (Arteries)। ধমনী হৃৎপিণ্ড থেকে রক্ত বহন করে নিয়ে যায় এবং শিরা রক্তকে হৃৎপিণ্ডে পৌঁছে দেয়। তাই, পুরো মানবদেহ শিরা এবং ধমনীর মাধ্যমে হৃৎপিণ্ডের সাথে যুক্ত। স্বাভাবিকভাবে, মানবদেহের দুটো হাতের প্রত্যেকটি আঙ্গুলের সাথেই শিরা এবং ধমনীর মাধ্যমে হৃৎপিণ্ডের সংযোগ রয়েছে। মানুষের হাতের গঠনতন্ত্র দেখলে বুঝা যাবে যে, আঙ্গুলের শিরাগুলো বড় একটি  শিরার সাথে যুক্ত হয়ে হৃৎপিণ্ডের সাথে যুক্ত হয়েছে। শুধুমাত্র বাম হাতের অনামিকার শিরার সাথে হৃৎপিন্ডের সংযোগ থাকলে আমরা কেবল ঐ আঙ্গুলেই বাইরের স্পর্শ, তাপ, এবং চাপ অনুভব করতাম, কারণ রক্তের সাহায্যে অক্সিজেন বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গে পৌঁছে স্নায়ুকে সচল রাখে। 

Visible Body নামক ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে বলা হয়েছে যে, Vena Amoris (Vein of Love) হচ্ছে একটি মিথ এবং মানবদেহে এর কোন অস্তিত্ব নেই বরং, প্রত্যেকটি আঙ্গুলই বাম হাতের অনামিকার মতো শিরার মাধ্যমে হৃৎপিণ্ডের সাথে যুক্ত। উল্লেখ্য, প্রাচীন মিশরীয়দের বিশ্বাস অনুযায়ী Vein of Love বা Vena Amoris হচ্ছে একটি শিরা যা বাম হাতের চতুর্থ আঙ্গুলকে সরাসরি হৃৎপিণ্ডের সাথে সংযুক্ত করেছে। মনে করা হয় যে পশ্চিমা সংস্কৃতিতে বিয়ের আংটি বাম হাতের অনামিকা বা চতুর্থ আঙ্গুলে পরার পেছনে প্রাচীন মিশরীয়দের উক্ত বিশ্বাসের প্রভাব রয়েছে।

Image: Excerpt from the Visible Body’s website

 

বাম হাতের অনামিকায় বিয়ের আংটি পরার তাৎপর্য

আমরা আগেই জেনেছি প্রাচীন মিশরীয়রা বিশ্বাস করতো যে মানবদেহের বাম হাতের অনামিকার সাথে শিরার মাধ্যমে হৃৎপিন্ডের সরাসরি সংযোগ রয়েছে এবং বাম হাতের ঐ আঙ্গুলকে হৃৎপিণ্ডের প্রতীক হিসেবে ধরে নিয়ে তারা নববধূদের বাম হাতের অনামিকায় বিয়ের আংটি পরিয়ে দিতো। তবে, মানুষের বিভিন্ন আচার-রীতি নিয়ে লেখা সাহিত্য ঘেঁটে দেখা গেছে যে শুধুমাত্র বাম হাতের অনামিকাতে বিয়ের আংটি পরানোর কারণ ভিন্ন। 

চার্লস জন স্যামুয়েল থম্পসন মনে করতেন বিভিন্ন কারণে বাম হাতে আংটি পরানোর সিদ্ধান্ত আরোপ করা হতো এবং তাঁর The Hand of Destiny: The folk-lore and superstitions of everyday life বইয়ের ৫৫ নং পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ডান হাতের চেয়ে বাম হাত নিকৃষ্টতম বিচারে বাম হাতে বিয়ের আংটি পরানো হয়, যা আনুগত্যও নির্দেশ করে। অর্থাৎ, স্ত্রীদের বাম হাতে বিয়ের আংটি স্বামীর প্রতি আনুগত্যের বহিঃপ্রকাশ হতে পারে। লিলিয়ান আইখলার তাঁর ১৯২৪ সালে প্রকাশিত The Customs of Mankind বইয়ের ২৩৪ নং পৃষ্ঠায় লিখেছেন, বাম হাতে আংটি পরিধান স্বামীর প্রতি স্ত্রীর আনুগত্যের নিদর্শন। প্রাচীন কালে ডান হাতকে শক্তি ও কর্তৃত্ব এবং বাম হাতকে আনুগত্যের নিদর্শন হিসেবে ধরা হতো। 

তাছাড়া, বাম হাতের চতুর্থ আঙ্গুলের ব্যবহারিক উপযোগিতা অন্যান্য আঙ্গুলের চেয়ে কম হওয়ায় এই নির্দিষ্ট আঙ্গুলটিকে নির্বাচন করা হয়। লিলিয়ান আইখলারের ঐ একই বইয়ের ২৩৫ নং পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, বাম হাতের চতুর্থ আঙ্গুলে বিয়ের আংটি পরার যথাযথ কারণ হতে পারে অন্যান্য আঙ্গুলের তুলনায় এর কম ব্যবহারিক উপযোগিতা। 

খ্রিস্টানদের বিয়েতে বাম হাতের চতুর্থ আঙ্গুলে আংটি পরানোর একটা প্রথা ছিলো। জর্জ ফ্রেডরিক কুঞ্জ তাঁর ১৯১৭ সালে প্রকাশিত Rings for the Finger: From the Earliest Known Times to the Present বইয়ের ১৯৪ নং পৃষ্ঠায় লিখেছেন, চার্চে খ্রিস্টান যাজক বিয়ের আংটি নিয়ে কনের বাম হাতের প্রথম তিনটি আঙ্গুলে ঐ আংটি স্পর্শ করে যথাক্রমে “পিতার নামে (In the name of Father), পুত্রের নামে (of the Son), এবং পবিত্র আত্মার নামে (of the Holy Ghost)” উচ্চারণ করে চতুর্থ আঙ্গুল স্পর্শ করে সেই আঙ্গুলে আংটি পরিয়ে দেয়। ঐ একই বইয়ে পান্তোয়া দে লা ক্রুজ এর আঁকা একজন অজ্ঞাত নারীর পোর্টেটে দেখা যায় যে, ঐ নারী বাম হাতের চতুর্থ এবং পঞ্চম আঙ্গুলে দুটো আংটি পরিহিত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছেন। 

Image: Excerpt from George F. Kunz’s book Rings for the Finger

 

স্থান-কাল-সমাজ-সংস্কৃতি নির্বিশেষে আংটি বাম হাতে পরা হয়?

আংটি কোন হাতের কোন আঙ্গুলে পরা হবে তা একটি আপেক্ষিক বিষয়। অর্থাৎ, আংটি পরিধানকারী কোন সময়ে বাস করছেন, কোথায় বাস করছেন, কোন সংস্কৃতিতে বাস করছেন প্রভৃতি বিষয়ের উপর নির্ভর করে তিনি কোন হাতে আংটি পরবেন। রোমান পন্ডিত প্লিনি দ্য এল্ডার (Pliny the Elder) তাঁর খ্রিস্টাব্দ প্রথম শতকে লেখা প্রাকৃতিক ইতিহাস (Natural History) বইয়ের ষষ্ঠ ভলিউমের ৮০ নং পৃষ্ঠায় লিখেছেন, প্রথমে হাতের কড়ে আঙ্গুলের পাশের অনামিকা আঙ্গুলে আংটি পরার রীতি ছিলো যা বিভিন্ন ভাস্কর্যের বেলায়ও দেখা গেছে। পরবর্তী সময়ে বৃদ্ধাঙ্গুলির পাশে তর্জনীতে আংটি পরার রীতি চালু হয় এবং বর্তমানে (লেখক তাঁর সময়ের কথা বলছেন) হাতের কড়ে আঙ্গুলেও আংটি পরবার চল (Fashion) শুরু হয়েছে। তিনি আরও লিখেছেন, গ্যালিয়া (বর্তমান ফ্রান্স) এবং ব্রিটানিয়া (বর্তমান ব্রিটেন) এর মানুষদের মাঝে আংটি পরার জন্য মধ্যমা (Middle finger) ব্যবহৃত হয়েছে। আজকের দিনে আমাদের মাঝে (লেখক নিজের কথা বলছেন) ঐ একটি আঙ্গুলই (মধ্যমা) কেবল ব্যতিক্রম, বাকি সবগুলো আঙ্গুলই আংটি পরার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে।

জর্জ ফ্রেডরিক কুঞ্জের লেখা Rings for the Finger: From the Earliest Known Times to the Present বইয়ের ১৯৫ নং পৃষ্ঠায় দেখা যায় যে, ফ্রান্সে একাদশ এবং পঞ্চদশ শতাব্দীর মাঝে কিছু ব্যতিক্রম বাদে বিয়ের আংটি কনে ডান হাতের আঙ্গুলে পরিধান করতো। তাঁর বইটির ১৯৪ নং পৃষ্ঠায় আরও বলা হয়েছে, ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম জর্জের শাসনামলে (১৭১৪-১৭২৭) বিয়ের আংটি বৃদ্ধাঙ্গুলিতে পরিধান করা অস্বাভাবিক কিছু ছিলো না, যদিও বিয়ের অনুষ্ঠানের সময় তা অনামিকা আঙ্গুলেই পরিধান করা হতো। 

তাছাড়া, আরও বিভিন্ন কারণেও বাম হাত ব্যতীত ডান হাতে বিয়ের আংটি পরিধান করা হয়। যেমন: সমলিঙ্গের বিবাহে অনুগত সম্পর্কের নিদর্শন হিসেবে ডান হাতে বিয়ের আংটি পরিধান করা হয়, যারা বাম হাতে সব কাজ করেন তারা ডান হাতে আংটি পরতে সাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, এবং সাংস্কৃতিক ভিন্নতার কারণে কেউ ডান হাতে আংটি পরিধানকে আনুগত্য এবং শ্রদ্ধার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে মনে করেন। 

 

বিশেষ দ্রষ্টব্য যে, আমাদের এই রিপোর্টটি তৈরিতে এবং রিপোর্টে ব্যবহৃত বিভিন্ন প্রাসঙ্গিক লিটারেচার উৎসসহ খুঁজে পেতে সহায়তা করেছে দক্ষিণ আফ্রিকা ভিত্তিক ফ্যাক্ট-চেকিং সংস্থা আফ্রিকা চেক এর একই বিষয় নিয়ে লেখা একটি রিপোর্ট। 

 

অতএব, আমাদের আলোচনার মাধ্যমে এই বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে যে, মানবদেহের সকল আঙ্গুলের সাথেই শিরার মাধ্যমে হৃৎপিন্ডের সংযোগ রয়েছে এবং শুধুমাত্র Vena Amoris এ বিশ্বাসের জন্য নয় বরং, অন্যান্য কারণে বাম হাতের অনামিকায় বিয়ের আংটি পরিধান করা হয়। মূলত একজন ব্যক্তির সমাজ, সংস্কৃতি, বিশ্বাস ঠিক করে দেয় তিনি কোন হাতে বিয়ের আংটি পরিধান করবেন।

সুতরাং, সবকিছু বিবেচনা করে ফ্যাক্টওয়াচ এই সিদ্ধান্তে এসেছে যে, সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত পোস্টের দাবিটি “মিথ্যা।”

এই নিবন্ধটি ফেসবুকের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রামের নীতি মেনে লেখা হয়েছে।।
এর উপর ভিত্তি করে ফেসবুক যে ধরণের বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এখানে
এছাড়া এই নিবন্ধ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন, সম্পাদনা কিংবা আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার জন্য আবেদন করতে এই লিঙ্কের সাহায্য নিন।

কোনো তথ্যের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকেঃ
ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh