ছাত্রলীগের বিজ্ঞপ্তি বিকৃত করে প্রচার

Published on: August 27, 2023

সম্প্রতি ভিন্ন ভিন্ন ক্যাপশনে ছাত্রলীগের একটি বিজ্ঞপ্তি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। বিজ্ঞপ্তিটি পড়ে জানা যাচ্ছে ইসলামপন্থী এবং নিজেকে মুসলিম দাবী করার জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চার ছাত্রলীগ নেতাকে বহিষ্কা করা হয়েছে। 

কিন্তু ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, টাকার বিনিময়ে ভর্তি পরীক্ষায় অন্যের হয়ে প্রক্মি দেয়ার জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চার ছাত্রলীগ নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। মূলত ছাত্রলীগের অফিশিয়াল বিজ্ঞপ্তিটি ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে এডিট করেসংগঠন বিরোধী’ –এর স্থলেইসলামপন্থী’, ‘শৃঙ্খলাপরিপন্থি’ –এর স্থলেশৃঙ্খলা পন্থীএবংসংগঠনের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়’ –এর স্থলেনিজেদেরকে মুসলিম দাবি করাবিশেষণগুলো বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাই ফ্যাক্টওয়াচ ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া পোস্টগুলোকেবিকৃতহিসেবে চিহ্নিত করছে। 

গুজবের উৎস : 

ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া এমন কিছু পোস্টের নমুনা দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে

 

 

ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধান :

ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া বিজ্ঞপ্তির অনুরূপ বিজ্ঞপ্তি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের অফিশিয়াল ফেসবুক আইডি Bangladesh Students’ League থেকে ১৯ শে আগস্ট, ২০২৩ তারিখে পোস্ট করা হয়। বিজ্ঞপ্তির মূল অংশে লেখা থাকে “বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের জরুরি সিদ্ধান্ত মোতাবেক জানানো যাচ্ছে যে, সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার প্রেক্ষিতে সংগঠনবিরোধী, শৃঙ্খলা-পরিপন্থি, অপরাধমূলক এবং সংগঠনের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয় এমন কার্যকলাপে জড়িত থাকার অপরাধে মুশফিক তাহমিদ তন্ময় (সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা, রাজু আহমেদ (যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, শের-ই-বাংলা ফজলুল হক শাখা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়), মহিবুল মমিন সনেট (কর্মী, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ,শহীদ হাবিবুর রহমান হল শাখা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়) ও শাকোয়ান সিদ্দিক প্রাঙ্গণ (কর্মী, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, শের-ই-বাংলা ফজলুল হক শাখা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়) কে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ থেকে স্থায়ী বহিস্কার করা হলো।” ১৯ শে আগস্ট, ২০২৩ তারিখে প্রকাশিত উক্ত বিজ্ঞপ্তিতে সাক্ষর করেন মেফতাহুল ইসলাম পান্থ (দপ্তর সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ)।

তবে উক্ত বিজ্ঞপ্তির কোথাও ‘ইসলামপন্থী’, ‘শৃঙ্খলা পন্থী’ এবং ‘নিজেদেরকে মুসলিম দাবি করা’ এমন কোন বিশেষণ ব্যবহার করা হয়নি। মূলত এডিটিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে ‘সংগঠন বিরোধী’ -এর স্থলে ‘ইসলামপন্থী’, ‘শৃঙ্খলা-পরিপন্থি’ -এর স্থলে ‘শৃঙ্খলা পন্থী’ এবং ‘সংগঠনের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়’ -এর স্থলে ‘নিজেদেরকে মুসলিম দাবি করা’ বিশেষণগুলো বসিয়ে দেওয়া হয়েছে।

১৯শে আগস্ট, ২০২৩ তারিখে ‘প্রক্সিকাণ্ডে অভিযুক্ত রাবির ৪ ছাত্রলীগ নেতাকর্মী স্থায়ী বহিষ্কার’ শিরোনামে সমকাল থেকে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে রাবি ছাত্রলীগের চার নেতাকর্মীর বহিষ্কারের কারণ জানা যায়। প্রতিবেদনে ছাত্রলীগের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজের বহিস্কারের বিজ্ঞপ্তিটির বিষয়ে উল্লেখ করা হয়। উক্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ১৭ই আগস্ট রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) ভর্তি হতে আসা এক শিক্ষার্থীকে ‘প্রক্সি চুক্তি’র টাকার জন্য তুলে নিয়ে মুক্তিপণ দাবির অভিযোগ ওঠে  ১৯ শে আগস্ট বহিস্কার হওয়া সেই চার ছাত্রলীগ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে। এ ছাড়াও জালিয়াতিতে জড়িত থাকার অভিযোগে ওঠে তাদের বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় ছাত্রলীগের চারজনসহ আরো দুই-তিন অজ্ঞাত ব্যক্তিকে আসামি করে শুক্রবার মামলা দায়ের করেন অপহরণকৃত শিক্ষার্থীর মা রেহেনা বেগম।

একইদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক আব্দুস সালাম বাদী হয়ে, পৃথক আরেকটি মামলা দায়ের করেন। এই ঘটনার আগেও মুশফিক তাহমিদ তন্ময়ের বিরুদ্ধে উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রক্সি কাজ দেওয়ার অভিযোগ ছিলো।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি গোলাম কিবরিয়া বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগকে বিষয়টি অবহিত করা হয়েছিল। তারাও বিষয়টি জানতেন। সেজন্য দলীয় শৃঙ্খলা পরিপন্থী কাজ করায় দল সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সাংগঠনিক সম্পাদক তন্ময়কে একই অভিযোগে আগেও একবার বহিষ্কার করেছিল কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। সুতরাং বিষয়টি কেন্দ্রের নজরেই ছিল।’

 

উক্ত বিষয় নিয়ে ১৯শে আগস্ট, ২০২৩ তারিখে জাগো নিউজ ২৪ এর একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে প্রক্সি চক্রের একটি গ্রুপের সঙ্গে ৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা চুক্তি করেন আহসান হাবীব নামের এক ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী। এর পরিপ্রেক্ষিতে ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা নগদ ও ৬০ হাজার টাকার চেক পরিশোধ করেন তিনি। ভর্তির পরে বাকি টাকা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ভর্তি শেষে বাকি টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে তাকে আটকে রেখে শিক্ষার্থীর বাবার কাছে আরও তিন লাখ টাকা দাবি করে ওই প্রক্সি চক্র। তাকে শারীরিকভাবে নির্যাতনও করা হয়। পরে প্রক্টরিয়াল বডির লোকজনের সহায়তায় বিকেল সাড়ে ৫টায় শের-ই-বাংলা হলের ভেতর থেকে তাকে উদ্ধার করা হয়।

জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে হাবীব স্বীকার করেন, নিজে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করে প্রক্সি পরীক্ষার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান। তবে তার প্রক্সি পরীক্ষা কোন পরীক্ষার্থী দিয়েছে তা জানাতে পারেননি।

এই ঘটনায় গত শুক্রবার (১৮ আগস্ট) রাবি ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে জালিয়াতি অভিযোগে ছাত্রলীগের নেতাসহ মোট আটজনের বিরুদ্ধে মামলা করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

মামলার আসামিরা হলেন মো. আহসান হাবিব (১৯), রাবির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী মো. প্রাঙ্গণ (২২), রাবি শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মুশফিক তাহমিদ তন্ময় (২৪), বিশ্ববিদ্যালয়ের শের-ই- বাংলা হল শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের ২০১৮-১৯ সেশনের শিক্ষার্থী রাজু আহমদ (২৩), মো. সাকিবসহ (২৪) আরও অজ্ঞাতনামা ২/৩ জন।

এর আগে ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতির অভিযোগে ছাত্রলীগ থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছিল তন্ময়কে। পরে তার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয়।

 

উক্ত ঘটনাকে কেন্দ্র করে কালের কণ্ঠ, চ্যানেল ২৪ বিডি, বাংলাট্রিবিউন সহ আরো বেশকিছু গণমাধ্যম সংবাদ প্রচার করেছে।

ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া পোস্টগুলোর সত্যতা যাচাই করে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে রিউমার স্ক্যানার বাংলাদেশ। তারা তাদের প্রতিবেদনে বিজ্ঞপ্তিটিকে এডিটেড বলে চিহ্নিত করেছে।


সারমর্ম

ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ছাত্রলীগের অফিশিয়াল বিজ্ঞপ্তিটি ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে এডিট করে ‘সংগঠন বিরোধী’ -এর স্থলে ‘ইসলামপন্থী’, ‘শৃঙ্খলা-পরিপন্থি’ -এর স্থলে ‘শৃঙ্খলা পন্থী’ এবং ‘সংগঠনের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়’ -এর স্থলে ‘নিজেদেরকে মুসলিম দাবি করা’ বিশেষণগুলো বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া ছাত্রলীগের এই চার নেতা বহিস্কার হয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার সময় প্রক্সিকান্ডে, ইসলামপন্থী বা নিজেদের মুসলিম দাবী করার জন্য নয়। তাই ফ্যাক্টওয়াচ ভাইরাল পোস্টটিকে “বিকৃত” হিসেবে চিহ্নিত করছে।

 

এই নিবন্ধটি ফেসবুকের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রামের নীতি মেনে লেখা হয়েছে।।
এর উপর ভিত্তি করে ফেসবুক যে ধরণের বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এখানে
এছাড়া এই নিবন্ধ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন, সম্পাদনা কিংবা আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার জন্য আবেদন করতে এই লিঙ্কের সাহায্য নিন।

কোনো তথ্যের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকেঃ
ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh