“চাষ করতে গিয়ে জমিতে ৬০ লাখ টাকার হিরা পেলেন কৃষক”- পুরনো খবর নতুন করে ভাইরাল

Published on: August 1, 2021

গত ২৪ জুলাই ২০২১ তারিখ থেকে “চাষ করতে গিয়ে জ’মিতে ৬০ লাখ টাকার হিরা পেলেন কৃষক”- এমন শিরোনামে একটি সংবাদ সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে দেখা যাচ্ছে। সংবাদটি মূলত ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্যের এক কৃষককে ঘিরে। ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে জানা যায়, মূল সংবাদটি ভারতের “The Times of India” সহ বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমে ২০১৯ সালের ২২ জুলাই প্রকাশিত হয়। অর্থাৎ, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া এই সংবাদটি দুই বছর আগের এবং এর ঘটনাস্থল বাংলাদেশ নয়। আবার, সংবাদে ব্যবহৃত ছবিগুলোও পুরনো ও এডিট করা এবং তথ্যের মধ্যেও রয়েছে অসামঞ্জস্য। সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে ফ্যাক্টওয়াচ সংবাদটিকে “বিভ্রান্তিকর” হিসেবে চিহ্নিত করছে।

 

গত ২৪ জুলাই ২০২১ তারিখ থেকে উক্ত শিরোনামের সংবাদটি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়তে দেখা যাচ্ছে। “News Bangla”, “আয়না” এবং ” বিডি কৃষি টিভি”-সহ আরোও কয়েকটি ফেসবুক পেজ থেকে এই সংবাদটি প্রকাশ করা হয়েছে। এছাড়াও অনেক ফেসবুক ব্যবহারকারীকেও ঘটনাটি আমলে নিয়ে শেয়ার করতে দেখা গিয়েছে।

ঘটনাটি নিয়ে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এবং এখানে

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

অন্যদিকে “jagonews24.com”, “bdkrishitv.com” এবং “bdtime24.net”-সহ বেশ কিছু ওয়েবসাইট থেকেও এই খবর নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। মূলত এইসব ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদনের সূত্র ধরেই ফেসবুকে সংবাদটি ছড়িয়ে পড়তে দেখা গিয়েছে।

বিভিন্ন ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলো দেখুন এখানে, এখানে এবং এখানে

 

সংবাদের বিষয়বস্তু

“bdkrishitv.com”- এর প্রতিবেদনে ঘটনার কোনো তারিখ উল্লেখ না করে বলা করা হয়, “যেনো স্বপ্নের মতো ঘটনা। কৃষক তার জমিতে চাষ করতে গিয়ে খুলে গেলো ভাগ্য। কাজ করতে করতে হঠাৎ ওই কৃষকের চোখে পড়ে একখণ্ড পাথর। তবে পাথরটি দেখতে একটু অন্যরকম লাগে তার কাছে, একটু চকচকও করতে থাকে পাথরটি।” “jagonews24.com” এর প্রকাশিত সংবাদে আল্লাহ বক্স নামের সেই ব্যবসায়ীকে উদ্ধৃত করে আরোও বলা হয়, ঠিকঠাক পালিশ করলে এই হীরার দাম ৬০ লাখ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। সবশেষে এমন হীরা পাওয়ার আরেকটি ঘটনা উল্লেখ করে বলা হয় ” চলতি বছরের ১২ জুন জন্নাগিরি গ্রামে ভেড়া চড়াতে গিয়ে হীরার টুকরা খুঁজে পান এক ভেড়া-পালক। প্রায় ৫০ লাখ টাকা বাজার দরের সেই হীরাটি তিনি বিক্রি করেন ২০ লাখ টাকায়।“

 

অনুসন্ধান

এই ঘটনাটি নিয়ে ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে বেশ কিছু অসংগতি লক্ষ্য করা যায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, ঘটনাটির সময়কাল, ঘটনাস্থল, সংবাদে ব্যবহৃত ছবি এবং অন্যান্য কিছু তথ্য।

২০১৯ সালের ২২ জুলাই অর্থাৎ আজ থেকে দুই বছর আগে ভারতের একটি গণমাধ্যম ” The Times of India”- এই ঘটনা নিয়ে একটি সংবাদ প্রকাশ করে। “Andhra Pradesh farmer strikes Rs 60 lakh diamomd in field“- শিরোনামের ওই প্রতিবেদনের সাথে সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া সংবাদটি প্রায় হুবুহু মিলে যাচ্ছে। এমনকি “jagonews24.com” এর প্রতিবেদনে উল্লেখিত “চলতি বছরের ১২ জুন জন্নাগিরি গ্রামে ভেড়া চড়াতে গিয়ে হীরার টুকরা খুঁজে পান এক ভেড়া পালক”- এই ঘটনাটি মূলত ‘The Times of India’- তে প্রকাশিত ২০১৯ সালের সেই প্রতিবেদন থেকেই নেওয়া। সেখানে বলা হয়, “On June 12, a shepherd, while grazing his sheep at Jonnagiri village, found an eight-carat diamond, which he sold for Rs 20 lakh, while the actual price could be about Rs 50 lakh.” লক্ষ্য করলে দেখা যাবে “jagonews24”, ২০১৯ সালের ১২ জুনে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনাকে ২০২১ সালে এসে “চলতি বছরের ১২ জুন” উল্লেখ করছে। যার ফলে পাঠকের মনে হতেই পারে, প্রতিবেদনে “চলতি বছর” বলতে আসলে ২০২১ সালকে বুঝানো হয়েছে যেহেতু ভাইরাল হওয়া এই সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছে ২০২১ সালে। কিন্তু মূল ঘটনাটি আসলে ২০১৯ সালের।

এছাড়াও “The Weather Channel” এ বিষয়ে ২০১৯ সালের ২২ জুলাই আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এই দুটি প্রতিবেদন থেকে স্পষ্টই বুঝা যায় সাম্প্রতিক সময়ে ভাইরাল হওয়া এই সংবাদটি মূলত ২০১৯ সালের অর্থাৎ আজ থেকে দুই বছর আগের।

 

অন্যদিকে, প্রায় প্রত্যেকটি ফেসবুক পোস্ট এবং ওয়েবসাইটে যে ছবিটি ব্যবহার করা হচ্ছে সেখানেও রয়েছে অসংগতি। দুইটি আলাদা ছবিকে একসাথে যুক্ত করে কোনো ধরনের বিবরণ না দিয়েই ছবিটি ব্যবহার করা হচ্ছে। গুগল রিভার্স ইমেজ সার্চ এর মাধ্যমে দেখা যায়, বাম পাশের ছবিটি “The Hans India” -নামক একটি নিউজপোর্টাল ২০১৬ সালের ১৪ জুন “Diamond hunt commences“- শিরোনামে একটি প্রতিবেদনে ব্যবহার করে। সেই ছবিতে পাঁচজনকে একটি মাঠে বসে থাকতে দেখা যায়। মূলত এই ছবি থেকে বাকিদের সরিয়ে শুধুমাত্র একজনকে রেখে ছবিটি বর্তমানে ভাইরাল হওয়া ফেসবুক পোস্ট এবং ওয়েবসাইটে ব্যবহার করা হচ্ছে।

 

 

 

 

 

 

 

 

আবার, হাতের ডান পাশে দ্বিতীয় যে ছবিটি ব্যবহার করা হয়েছে সেটিও পুরনো একটি ছবি। একই পদ্ধতিতে ছবিটি নিয়ে অনুসন্ধান করা হলে দেখা যায়, “catholicweekly.com”- নামক একটি ওয়েবসাইটে ২০১৬ সালের ২৩ জুন ঠিক এই ছবিটিই প্রকাশ করা হয়। ছবিসূত্র হিসেবে “shutterstock” এর নাম ব্যবহার করা হয়।

অর্থাৎ, পরিষ্কারভাবেই দেখা যাচ্ছে ব্যবহৃত দুইটি ছবিই ২০১৬ সালের। ছবিগুলোকে এডিট করে খবরের সাথে ব্যবহার করা হচ্ছে। আমরা যদি, “The Weather Channel” কিংবা “The Times of India”- এর প্রতিবেদনগুলো লক্ষ্য করি তাহলে দেখা যাবে সেখানে তারা ঘটনার কোনো ছবি ব্যবহার করেনি।

আরেকটি অসংগতি হচ্ছে সংবাদে ব্যবহৃত হীরার দাম নিয়ে। উল্লেখিত এই হীরার মূল্য ভারতের সংবাদমাধ্যম দাবি করছে ৬০ লাখ রুপি। কিন্তু ভাইরাল হওয়া সংবাদগুলোতে হীরার দাম ৬০ লাখ টাকা উল্লেখ করা হচ্ছে। অর্থাৎ এখানে রূপি এবং টাকার মধ্যে এক ধরনের গড়মিল দেখা যাচ্ছে। এতে করে ভারতের সংবাদটিই যে বেমালুম বাংলাদেশের বলে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে, এই ধারণা আরো জোরালো হয়।

 

সিদ্ধান্ত

উপরে বর্ণিত তথ্যের ভিত্তিতে দেখা যাচ্ছে, বর্তমানে যে সংবাদটি সামাজিক মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে তা মূলত ২০১৯ সালের পুরনো একটি সংবাদ। সংবাদের উৎসস্থল ভারত। আবার, সংবাদে ব্যবহৃত ছবি এবং তথ্যগুলোও অনেকাংশেই ঘটনার সঠিক চিত্র উপস্থাপন করছে না। যার ফলে সহজেই বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে। তাই সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে ফ্যাক্টওয়াচ সংবাদটিকে “বিভ্রান্তিকর” চিহ্নিত করছে।

উল্লেখ্য, গত ২৮ মে ২০২১ তারিখে অন্ধ্রপ্রদেশের এই কুরনল জেলায় আবারো এক কৃষকের হীরা পাওয়ার কথা গণমাধ্যমে এসেছে। সম্প্রতি ‘India Today’- এর একটি প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে কৃষিজমিতে আবারো এক কৃষকের ৩০ ক্যারট হীরা খুঁজে পাওয়ার ঘটনা ঘটেছে এবং পরবর্তীতে ওই কৃষক তা ১.২ কোটি রূপিতে বিক্রি করেছে বলে দাবি করা হচ্ছে। এই বিষয়ের সত্যতা যাচাই করতে পুলিশ তদন্ত করে যাচ্ছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।

ধারণা করা যাচ্ছে, এমন একটি খবর আবারও আলোচনায় আসায় ২০১৯ সালের এর পুরনো ওই খবরটি আবারও ভাইরাল হয়ে থাকতে পারে।

 

আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন?
কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন?
নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?

এসবের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে জানান।
আমাদেরকে ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh

 

 

Leave a Reply