Published on: [August 2,2021]
‘‘অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রীনা ফ্লোরা নিজ ওয়ালে লিখেছেন’’—এমন শিরোনামে একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস ভাইরাল হয়েছে। একই স্ট্যাটাস গতবছরও বিভিন্ন সময়ে ভাইরাল হতে দেখা গেছে। ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে দেখা গেছে ,এটি ডাক্তার মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা’র লেখা নয়। এমনকি ডাক্তার ফ্লোরার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তিনি নিজে ফেসবুকের মাধ্যমে কখনও এ ধরনের প্রচার–প্রচারণা চালান না। এর মাধ্যমে কেউ প্রতারিত হলে তার দায়-দায়িত্ব আইইডিসিআর বা অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বহন করবেন না। সেব্রিনা ফ্লোরার এই সতর্কীকরনের ভিত্তিতে ফ্যাক্টওয়াচ তাঁর নামে প্রচারিত এ ধরনের ভাইরাল পোস্টকে মিথ্যা হিসেবে শনাক্ত করছে। |
বিভ্রান্তির উৎস
ডাক্তার ফ্লোরা’র ছবিসহ কিংবা ছবি ছাড়াই বিভিন্ন জায়গায় ডাক্তার ফ্লোরা’র নামে এই দীর্ঘ পোস্ট শেয়ার হতে দেখা যাচ্ছে। এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে ।
অতীতেও এই পোস্ট বিভিন্ন সময়ে শেয়ার হতে দেখা গেছে। যেমন- ২০২১ সালের এপ্রিল মাসেই এই পোস্ট ভাইরাল হয়েছিল। এমন কয়েকটি পোস্ট দেখুন এখানে , এখানে, এখানে , এখানে
কি বলা হচ্ছে এই পোস্টে ?
রাইজিংনিউজটুয়েন্টিফোর ডট কম এর ফেসবুক পেজ থেকে থেকে ১লা আগস্ট ২০২১ সকাল ১০ টা ২৫ মিনিটে শেয়ার করা পোস্টে বলা হয়েছে,
অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রীনা ফ্লোরা নিজ ওয়ালে লিখেছেন…
লকডাউন উঠে যাবে হয়ত কয়েকদিন পরই। কেন উঠবে সেটাও পরিষ্কার । হাজার হাজার মানুষ না খেয়ে মরবে। লকডাউন রাখা হয়েছিল ভাইরাসটা যেন ধীরে ছড়ায়, ততদিনে যেন ভ্যাক্সিন আবিষ্কার হয়ে যায় । কিন্তু দুঃখের কথা হলো, পুরো পৃথিবীর ৭০০ কোটির সবার হাতে হাতে এই ভ্যাক্সিন পৌঁছাতে, কম করে হলেও ৩-৪ বছর লাগবে। তাই এমন অনন্তকাল লকডাউন রাখা সম্ভব না, সে যত উন্নত রাষ্ট্রই হোক না কেন । চীন, ইতালিতেও উঠিয়ে নেওয়া হচ্ছে লকডাউন ।
তবে আমরা কি এভাবেই মরব ?
সহজ ভাষায় বলতে গেলে, হ্যাঁ এবং এটা একদমই প্রাকৃতিক ব্যাপার । প্রতিটা যুগে যুগে এমন Evolution হয়েছে । এক যুগে ‘ডাইনোসর’ ছিল, কিন্তু প্রকৃতিতে টিকে থাকতে পারেনি বলে তারা আজ নেই । অথচ সেই জুরাসিক যুগের ‘তেলাপোকা’ এখনো টিকে আছে । কারণ সে নিজেকে Evolve করে, নিজেকে চেঞ্জ করে প্রকৃতিতে টিকে থাকতে পেরেছে । ম্যামথও ছিল তখন, হয়ত ‘ম্যামথ’ তার রূপ চেঞ্জ করেই বর্তমানের হাতি হয়েছে। এগুলাই Evolution.
তো এগুলো বলার মানে কী ? এগুলো জেনে কী করব ?
আমাদেরও প্রকৃতির উপাদানের সাথে Evolve হতে হবে । লড়াই করে টিকে থাকতে হবে । আমাদের নিজেদেরও চেঞ্জ হতে হবে । কিছু নিয়ম মেনে চললেই এই টিকে থাকা সম্ভব ।
১) অভ্যাসঃ-
বাজে অভ্যাসগুলা ত্যাগ করতে হবে । কথায় কথায় মুখে আঙুল দেয়া, কলমের মুখ কামড়ানো, আঙুল জিহ্বায় লাগিয়ে কাগজ উল্টানো, থুতু দিয়ে টাকা গোনা ইত্যাদি যুগ যুগ ধরে চলে আসা বাজে অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে । সাথে মাস্ক পড়তে হবে এবং সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে । ২০০৩ এ জাপানে সার্স ভাইরাসের মহামারির পর তাদের মধ্যে এই অভ্যাসগুলো গড়ে উঠেছিল, যা আজ খুব ভাল কাজ করছে ইমিউনিটি বৃদ্ধি করতে । ধূমপান যথাসম্ভব পরিহার করা ।
২) এনভায়রনমেন্টঃ
আমরা খুব ভাগ্যবান যে আমরা এমন পরিবেশে আছি । নয়ত এই ঘনবসতিপূর্ণ দেশ কবেই শেষ হয়ে যেত। আর্দ্রতা এবং তাপমাত্রা খুব ভালো কাজ করছে । আর্দ্রতা বেশি থাকা মানে বাতাসে ধুলাবালি কম উড়বে । শীতে আর্দ্রতা কম থাকে, চারিদিক শুষ্ক থাকে বলে বেশি ধুলা ওড়ে । এজন্য শীতপ্রধান দেশে এই ভাইরাস হানা দিচ্ছে বেশি । তাই ঠান্ডা/এসি এভোয়েড করতে হবে, এসি রুমের আর্দ্রতা কমিয়ে দেয়।
৩) ইমিউনিটিঃ
এটাই মোস্ট ইম্পোর্টেন্ট । এই পুরো পোস্ট লিখার পেছনে এই পয়েন্টটাই দায়ী । হার্ড ইমিউনিটির বিকল্প নাই । আমাদের ইমিউনিটি বুস্ট করতেই হবে । সেটা কীভাবে ?
ফিজিক্যালি এন্ড মেন্টালি ।
ফিজিক্যালিঃ
* নিয়ম মাফিক ঘুমাতে হবে, রাত জাগা খুব খারাপ শরীর ও ইমিউন সিস্টেমের জন্য । প্রতিদিন কমপক্ষে ৬-৮ ঘন্টা ঘুমাতে হবে ।
* প্রতিদিন ব্যায়াম করতে হবে, প্রায় ১৫-৩০ মিনিট । মাসল এক্টিভিটি বাড়াতে হবে ।
* প্রায়ই রোদে ঘুরতে হবে ছাদে । রোদ দরকার, ভিটামিন ডি লাগবেই লাগবে ।
খাবারঃ
- ভাতে কোন ঘোড়ার আন্ডার পুষ্টিও নাই, উল্টা অতিরিক্ত ভাত খেলে আপনি মোটা হবেন । ভাত কম খেয়ে তরকারি এবং প্রোটিন জাতীয় খাবার খেতে হবে ।
- প্রচুর পানি খেতে হবে (এটা খুব বাজে অভ্যাস আমরা পানি খেতে চাই না )।
- এন্টি অক্সিডেন্ট-যুক্তখাবার খেতে হবে । শাক সবজি খেতে হবে । প্রয়োজনীয় প্রটেকশন নিয়ে বাজারে যান, নয়ত ইমিউনিটির অভাবে এমনিও মরতে হবে।
- ভিটামিন সি বা টকযুক্ত ফল, কমলা, লেবু খেতে হবে । এছাড়াও সিজনাল ফল খেতে হবে । প্রতিদিন সকালে লেবু সিদ্ধ গরম পানি খান ।
- ফাস্ট ফুড টোটালি অফ, চিনি কিংবা লবণ খাওয়াও কমাতে হবে ।
- আমাদের দেশের মশলাগুলো দারুণ কাজের । লং, লবঙ্গ, জিরা, হলুদ, দারুচিনি এইগুলো মারাত্মকভাবে ইমিউনিটি বুস্ট করে । দুধে হলুদ মিশিয়ে খাবেন, হলুদ অনেক কাজের । চায়ে মশলা মিশিয়ে খাবেন । গ্রিন টি (এন্টিঅক্সিডেন্ট) বেস্ট, গ্রিন টিতে এই মশলাগুলো খেলে অনেক ভালো।
- কালোজিরা কার্যকরী একটা জিনিস । প্রতিদিন সকাল বেলা উঠে এক চামচ মধুর সাথে কালোজিরা অনেক বেটার একটা কম্বিনেশন । এছাড়া কালোজিরা ভর্তা/ভাজি খাবারের সাথেও খেতে পারেন ।
মেন্টালি:
ইমিউন বুস্টের জন্য সঠিক হরমোনাল ব্যালেন্স ঠিক রাখা খুব জরুরি । তাই মনকে শান্ত রাখতে হবে, হাসি খুশি থাকতে হবে । ধর্মীয় প্রার্থনায় মন দিন, মন সুন্দর থাকবে।
সবাই ভাল থাকুক, সবাই সুস্থ থাকুক । সবাইকে নিয়েই বাঁচতে চাই । বাকিটুকু আল্লাহ ভরসা ।
—-অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রীনা ফ্লোরা
ধন্যবাদ।
ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধান
এই পোস্টের প্রথম অনুচ্ছেদের তথ্য ( ততদিনে যেন ভ্যাক্সিন আবিষ্কার হয়ে যায় কিংবা চীন, ইতালিতেও উঠিয়ে নেওয়া হচ্ছে লকডাউন ) থেকে বোঝা যাচ্ছে, এটা বর্তমান সময়ের কোনো পোস্ট নয়, বরং এমন এক সময়ের পোস্ট যখন করোনার ভ্যাক্সিন আবিষ্কৃত হয়নি । এবং যখন বাংলাদেশে দীর্ঘ লকডাউন চলছিল ।
‘এনভায়রনমেন্ট’ শীর্ষক অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, শীতপ্রধান দেশে এই ভাইরাস হানা দিচ্ছে বেশি । এটিও পুরনো পর্যবেক্ষণ। এখন আর এই দাবির সত্যতা পাওয়া যাচ্ছেনা। বরং গ্রীষ্মপ্রধান দেশ ভারত এবং ব্রাজিল শীর্ষ করোনা আক্রান্ত দেশের মধ্যে রয়েছে।
ইমিউনিটি শীর্ষক অনুচ্ছেদে উপদেশ দেওয়া হয়েছে, টক ফল বা ভিটামিন সি যুক্ত গরম পানি খান। প্রকৃতপক্ষে , ভিটামিন সি বা গরম পানি খেলে করোনামুক্ত থাকা যাবে, এই গুজবের কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি।
এছাড়া একই অনুচ্ছেদে কালোজিরা কে ‘কার্যকরী’ বলা হয়েছে। মধু এবং কালোজিরা খেতে বলা হয়েছে। তবে করোনা প্রতিরোধের জন্য মধু এবং কালোজিরার কোনো উপকারিতা পাওয়া যায়নি ।
বিডিফ্যাক্টচেকের এক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০২০ সালের ৬ই মে তারিখে MD Nasirul Islam নামে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী এই দীর্ঘ পোস্ট টি করেন। পরবর্তীতে, এই পোস্টের হেডিং পরিবর্তন করে, ডাক্তার মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরার নাম যুক্ত করে ভাইরাল হয়ে যায় ।
IEDCR এর প্রেস বিজ্ঞপ্তি
গত বছরের ১লা জুন রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের (আইইডিসিআর) এর পক্ষ থেকে গনমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ফেসবুকে প্রচারিত এসব তথ্যকে নাকচ করে দেওয়া হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়ে, সম্প্রতি ফেসবুকে DR. Sabrina flora নামক একটি ভুয়া ফেসবুক আইডিসহ কাছাকাছি নামে বেশ কয়েকটি ফেসবুক আইডি খোলা হয়েছে। যেখানে অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরার ছবি দিয়ে বিভিন্ন ধরনের অবৈজ্ঞানিক ও বিভ্রান্তিমূলক তথ্য প্রচার করা হচ্ছে।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, আইইডিসিআর তথা দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার অপপ্রয়াস চালানোর নিমিত্তে দেয়া এসব পোস্টে জনগণকে বিভ্রান্ত না হবার জন্য সবাইকে অনুরোধ জানানো হচ্ছে। অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা ফেসবুকের মাধ্যমে কখনও এ ধরনের প্রচার–প্রচারণা চালান না। এর মাধ্যমে কেউ প্রতারিত হলে তার দায়-দায়িত্ব আইইডিসিআর বা অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বহন করবেন না।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আইইডিসিআর ইতিমধ্যে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করছে এবং সবাইকে সহযোগিতা করার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করছে।
এই প্রেস বিজ্ঞপ্তির কথা জাতীয় দৈনিকগুলো গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করেছিল তখন। যেমন- দৈনিক যুগান্তর, বাংলানিউজটুয়েন্টিফোর, ডিবিসি নিউজ ইত্যাদি ।
সিদ্ধান্ত
প্রচারিত ভাইরাল পোস্টটিতে কিছু পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের সাথে মিললেও অনেকগুলো পরামর্শ সঠিক নয়। ডাক্তার ফ্লোরা’র নামে এই পোস্ট ছড়াতে থাকলে ফেসবুক ব্যবহারকারীরা বিভ্রান্ত হতে পারেন। সবগুলো পরামর্শকেই সঠিক বলে ভাবতে পারেন। এ কারণে এই সম্পূর্ণ পোস্টকেই ফ্যাক্টওয়াচ ‘মিথ্যা’ বলে চিহ্নিত করেছে।
আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন? এসবের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে জানান। |