৭২ ঘন্টার মধ্যে বাংলাদেশে বড় ভুমিকম্পের আশংকা – গুজব

Published on: September 21, 2023

বিশেষজ্ঞদের মতামত অনুযায়ী, আগামী ৭২ ঘন্টার মধ্যে বাংলাদেশ সহ পাশ্ববর্তী দেশ গুলোতে ৫.৫ থেকে ৬.৮ রিখটার স্কেলের ভূমিকম্প হওয়ার সমূহ আশংকা রয়েছে- এমন একটি খবর ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। তবে এই বিশেষজ্ঞ কারা, তারা কিভাবে কোন ধরনের গাণিতিক মডেল অনুসরণ করেছে বা কি কি তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে এই সম্ভাবনার কথা জানাচ্ছেন, সেটা পরিষ্কার নয়। অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ববিদ , বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এবং কানাডার সাসকাচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞগণ জানাচ্ছেন, এভাবে নির্দিষ্ট দিনতারিখ উল্লেখ করে ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেয়া সম্ভব নয়। সেই প্রযুক্তি এখনো আবিষ্কৃত হয় নি। ফলে এই পোস্টগুলোকে ফ্যাক্টওয়াচ মিথ্যা সাব্যস্ত করছে।

 

গুজবের উৎস:

ছড়িয়ে পড়া কয়েকটি পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানেএখানে, এখানে, এখানে

 

ফ্যাক্টওয়াচ অনুসন্ধান:

ভুমিকম্প সম্পর্কে আমরা জানি, পৃথিবীর কঠিন ভূত্বকের কোন কোন অংশ প্রাকৃতিক কোন কারণে কখনো কখনো অল্প সময়ের জন্য হঠাৎ কেঁপে ওঠে উঠলে তাকে ভূমিকম্প বলে। আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুতপাত এবং মাটির নিচের টেকটোনিক প্লেট এর স্থানচ্যুতি ভুমিকম্পের প্রধান কারন। বাংলাদেশে যেহেতু কোনো সক্রিয় আগ্নেয়গিরি নেই, তাই এখানে টেকটোনিক প্লেটের বিচ্যুতিই ভূমিকম্পের প্রধান কারন। বাংলাদেশ ভূখন্ডটি দুইটি টেকটোনিক প্লেট ( ইন্ডিয়ান প্লেট ও বার্মা প্লেট) এর ওপরে অবস্থিত বিধায় এটি একটি সক্রিয় ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা। ভূ-তত্ত্ববিদদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়েই ঢাকায় বড় ভূমিকম্পের আশংকা জানানো হয়।  ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড অনুসারে বসতবাড়ি নির্মাণসহ ভূমিকম্প নিয়ে সচেতন থাকার জন্য সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন মহল থেকে আহ্বান জানানো হয়। গত ২ মাসে বাংলাদেশে ৩ টা উল্লেখযোগ্য ভূমিকম্প হয়েছে। এরই মাঝে নতুন করে শক্তিশালী ভুমিকম্পের সতর্কতায় জনমনে আতংক বিরাজ করছে।

গুজবের উৎস হিসেবে Earthquake News Everyday নামক পেজ থেকে গত ১৯শে সেপ্টেম্বর বিকাল ৩ টা ১২ মিনিটে আপলোড করা এই পোস্টকে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে।

এখানে বলা হয়েছে, দক্ষিণ-মধ্য এশিয়ার জন্য জরুরী ভূমিকম্পের সতর্কতা এবং পূর্বাভাস (১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, বিকাল ৩ টা , বাংলাদেশ ,কাজাখস্তান ও ভুটানের সময় অনুযায়ী)

দক্ষিণ-মধ্য এশিয়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত, পরবর্তী 48-72 ঘন্টা এবং পরবর্তী 7-10 দিনের মধ্যে, যেকোনো শক্তিশালী/বড় ভূমিকম্প (5.5 ~ 6.8) এবং কিছু মৃদু কম্পন এর একটি সিরিজ এই নিম্নবর্নিত অঞ্চলের যেকোনো স্থানে বা যৌথভাবে অনুভূত হতে পারে। এলাকাগুলো হল- দক্ষিণ এশিয়া আফগানিস্তানে ,পাকিস্তান,ভারত-নেপাল সীমান্ত,ভারত,ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত,,বাংলাদেশ-মিয়ানমার,ভুটান ,মধ্য এশিয়া, কাজাখস্তান, তাজিকিস্তান, চীন, তাইওয়ান ও উজবেকিস্তান

এই অঞ্চলের (দক্ষিণ-মধ্য এশিয়া) জনগণকে অবশ্যই সচেতন থাকতে হবে এবং নিরাপদ দূরত্বে থেকে সতর্ক থাকতে হবে

সক্রিয়  টেকটোনিক প্লেট এবং সিসমিক অ্যাক্টিভিটি জোন: ইন্ডিয়ান-ইউরেশিয়ান মহাদেশীয় প্লেট ইন্ডিয়ান প্লেট, বার্মা প্লেট

এই ভূমিকম্প ঘটতে পারে বা নাও ঘটতে পারে । এখনো নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছেনা । এখনও নিশ্চিত করা হয়নি । তবে গবেষণা এবং ভূমিকম্প মনিটরিং এর মাধ্যমে (এই সময়টায়) শক্তিশালী ভূমিকম্পের সম্ভাবনা পাওয়া যাচ্ছে। 

গবেষণা করেছেন: নাঈম আহমেদ, ভূমিকম্প গবেষক এবং ভূমিকম্প বিশ্লেষক ১৯/০৯/২০২৩

(Indian-Eurasian continental plate Indian plate,Burma plate –এভাবেই লেখা হয়েছে সক্রিয় টেকটোনিক প্লেটগুলোর নাম। যদিও বার্মা প্লেট এবং ইন্ডিয়ান প্লেট স্বতন্ত্র মাইনর প্লেট, এবং ইউরেশিয়ান প্লেট একটি মেজর প্লেট , তবে ইন্ডিয়ান-ইউরেশিয়ান প্লেট নামে কোনো টেকটোনিক প্লেট নেই)

পেজ থেকে ভূমিকম্প গবেষক নাইম আহমেদ এর বিস্তারিত পরিচয় দেওয়া হয়নি। অনুসন্ধানে Earthquake News Everyday এর পরিচালিত একাধিক ফেসবুক গ্রুপ, এবং জনাব নাঈম আহমেদ এর একাধিক ফেসবুক আইডি পাওয়া গেল। (যেমন- এখানে , এখানে , এখানে, এখানে) এসব আইডি’র ইনফর্মেশন অংশ থেকে জানা যাচ্ছে, তিনি  স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে কম্পিউটার সায়েন্স এ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং , অর্থাৎ CSE তে অনার্স করেছেন, এবং  পরে এমবিএ করেছেন চাকরি করছেন খুলনার খানজাহান আলি কলেজ অফ সায়েন্স এন্ড টেকনোলজিতে।

বই বিক্রির জনপ্রিয় ওয়েবসাইট রকমারিতে নাঈম আহমেদের লেখা কবিতার বই- ভালবাসার অপ্রকাশিত কাব্য এর ‘লেখক পরিচিতি’ থেকে জানা যাচ্ছে, তিনি কম্পিউটার বিজ্ঞান এর একজন শিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছেন। তিনি একজন লেখক,কবি,আবৃত্তিকার ,উপন্যাসিক,গল্পকার,গবেষক, নাট্যকার ,মাইন্ড রিডার।

ভূ-তত্ত্ব সম্পর্কিত কোনো বিষয় নিয়ে তিনি কোনো একাডেমিক লেখাপড়া করেছেন কিনা, কিংবা ভূমিকম্প বিষয়ক তাঁর কোনো গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে কিনা, সেটা জানা সম্ভব হয়নি।

Earthquake News Everyday থেকে নিয়মিতই বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশের সম্ভাব্য ভুমিকম্পের পূর্বাভাস দেওয়া হয় । এসব ভূমিকম্পের পূর্বাভাস জনাব নাঈম আহমেদ নিজেই প্রকাশ করেন, নাকি অন্য কোনো উৎস থেকে সংগ্রহ করে তিনি প্রকাশ করছেন, সেটাও নিশ্চিতভাবে বলা হয়নি। জনাব নাঈম আহমেদের পক্ষ থেকেই এই ভবিষ্যদ্বাণী প্রকাশ করা হয়ে থাকলেও, তিনি কি কি তথ্য উপাত্ত গ্রহণ করেছেন, সেই তথ্যগুলোর উৎস কি ছিল, সেই তথ্য কিভাবে বিশ্লেষণ করে তিনি এমন সিদ্ধান্তে এসেছেন, তার ফেসবুক পোস্ট থেকে এসব বিষয়ে কোনো ধারণা পাওয়া যায় নি।

আন্তর্জাতিকভাবে গত কয়েকবছর ধরে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভুমিকম্পের পূর্বাভাস দিয়ে আলোচিত হয়েছেন ফ্রাংক হুগারবিটস (Frank Hoogerbeets)। তার দাবি অনুযায়ী , সৌরজগতের গ্রহদের গতিবিধি এবং তাদের একসূত্রে অবস্থান (planetary alignment) থেকে তিনি ভূমিকম্পের পূর্বাভাস করে। যদিও বিজ্ঞানীরা তাঁর এই পূর্বাভাস ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়েছেন।

আমেরিকার  United States Geological Survey (USGS) এ কর্মরত ভূ-পদার্থবিজ্ঞানী এ্যান্ড্রু মাইকেল ফ্যাক্টচেকিং ওয়েবসাইট স্নপস কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ভূকম্পবিদরা দীর্ঘদিন ধরেই জোয়ার-ভাটার সাথে ভূমিকম্পের কোনো সম্পর্ক আছে কিনা, সেটা খোঁজার চেষ্টা করেছেন। যদিও সাগরের পানিতে জোয়ার ভাটার প্রভাব খুব সহজে দৃষ্টিগোচর হয়, এমনকি কঠিন মাটিতেও এর প্রভাব দেখা যায়, কিন্তু ভূমিকম্পের সাথে এর খুবই ক্ষুদ্র প্রভাব পরিমাপের জন্যও বিপুল পরিমাণ তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করা দরকার হয়। … মোটের উপর বলা যায়, ভূমিকম্পের উপর চাঁদের এত বড় প্রভাব নেই যার উপর নির্ভর করে পূর্বাভাস দেয়া সম্ভব।

চাঁদ বাদে অন্যান্য গ্রহের দিকে নজর দেই। এরা আকারে চাঁদের তুলনায় অনেক বড়, কিন্তু দূরত্ব অনেক বেশি। ফলে এদের প্রভাব খুব সামান্য। উদাহরণস্বরূপ, পৃথিবীর উপরে বৃহস্পতি গ্রহের প্রভাব চাঁদের তুলনায় মাত্র ১% , এবং শুক্র গ্রহের প্রভাব ০.৬%। সঙ্গত কারণেই পৃথিবীতে ভূমিকম্পের ওপর এদের প্রভাব আরো কম।

USGS এর আরেকজন বিজ্ঞানী সুসান হাউ বলেছেন, ফ্রাংক হুগারবিটস এর পূর্বাভাসগুলোকে তুলনা করা যায় সেই নষ্ট ঘড়িটার সাথে, যে দিনের মধ্যে দু’বার ঠিক ঠিক সময় দিতে পারে।


ভারতের কেরালার বাবু কালায়িল (Babu Kalayil) বিভিন্ন সময়ে ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দিয়ে থাকেন, এবং দাবি করেন, তিনি ই এস পি (ESP- Extra sensory perception) ক্ষমতার সাহায্যে নিকট ভবিষ্যতের আসন্ন ভূমিকম্পের ঘটনা জানতে পারেন। তবে ভারতের National Centre for Seismology এর গবেষকরা তার এই দাবি ভিত্তিহীন হিসেবে উড়িয়ে দিয়েছেন। এ বিষয়ে বুমলাইভ এর ফ্যাক্টচেকিং রিপোর্ট দেখুন এখানে। 

তবে, আমাদের আলোচ্য পোস্টের লেখক নাঈম আহমেদ ফ্রাঙ্ক হুগারবিটস বা বাবু কালায়িল এর মত কোনো ধরনের পদ্ধতি উল্লেখ করেননি। তিনি কিসের ভিত্তিতে এই পূর্বাভাস দিচ্ছেন, সেটি না জানিয়েই পূর্বাভাস দিয়ে যাচ্ছেন।

United States Geological Survey (USGS) এর ওয়েবসাইটে তুমি কি ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দিতে পারবে? শীর্ষক এই নিবন্ধে বলা হয়েছে, হ্যা, কিছু মানুষ দাবি করে যে তারা ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দিতে পারে। কিন্তু কেন তাদের দাবি মিথ্যা, তাঁর কারণ হল-

১.  তারা বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে পূর্বাভাস দেয় না , আর ভূমিকম্প হল একটা বৈজ্ঞানিক ঘটনা । উদাহরণস্বরূপ- আকাশে বেশি মেঘ হলে ভূমিকম্প হবে-এমনটা ভুল। আকাশের মেঘ ,মানুষের শরীরের চুলকানি, বাতের ব্যথা ইত্যাদির সাথে মাটির গভীরের ভূমিকম্পের কোনো যোগসূত্র নাই।

২. একটা পূর্বাভাস এর জন্য প্রয়োজনীয় ৩ টা উপাদান (স্থান, সময়, ভূমিকম্পের মাত্রা)কে তারা একসাথে সুনির্দিষ্ট করে জানাতে পারে না ।

৩. তাদের পূর্বাভাস এতই অনির্দিষ্ট যে সবসময়ই কোনো না কোনো ভূমিকম্প তাদের পূর্বাভাসের সাথে মিলবে । যেমন- আমেরিকায় পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে একটা ৪ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত করবে,কিংবা আমেরিকার পশ্চিম উপকূলে আজ ২ মাত্রার একটা ভূমিকম্প আঘাত করবে ইত্যাদি। 

এসব কম মাত্রার ভূমিকম্প প্রতিনিয়তই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ঘটছে । আমেরিকার ন্যাশনাল আর্থকোয়াক ইনফর্মেশন সেন্টার এর বরাত দিয়ে নাসা’র জেট প্রপালসন ল্যাবরেটরি জানাচ্ছে, প্রতিদিন বিশ্বের নানা প্রান্তে কমপক্ষে ৫৫ টা ভূমিকম্প সংঘতিত হচ্ছে, যার অধিকাংশই দুর্বল প্রকৃতির।

earthquaketrack এর এই ওয়েবসাইটে প্রতিদিন বিশ্বের নানা প্রান্তে ঘটে যাওয়া ১.৫ মাত্রার চেয়ে বড় ভুমিকম্পগুলো রেকর্ড করা হয়। এই সাইটের তথ্য অনুযায়ী, গত ১ বছরে ৫২,১৩৯ টা বিভিন্ন মাত্রার ভুমিকম্প রেকর্ড করা হয়েছে।

USGS এর নিবন্ধের সাথে আলোচ্য Earthquake News Everyday এর বাংলাদেশের ভূমিকম্প বিষয়ক পূর্বাভাসটা মিলাতে গেলে দেখা যাচ্ছে, এখানেও নির্দিষ্ট স্থানের কথা না বলে একাধিক স্থানের কথা বলা হচ্ছে এবং নির্দিষ্ট সময়ের কথা না বলে একটা বড় সময়সীমার কথা বলা হচ্ছে।

ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াশিংটন এবং ইউনিভার্সিটি অফ ওরেগন পরিচালিত Pacific Northwest Seismic Network (PNSN) এর এই নিবন্ধে বলা হয়েছে, সাইকিক এবং ছদ্মবিজ্ঞানী (pseudo-scientist)দের কাছে ভূমিকম্পের ভবিষ্যৎবাণী করা একটা জনপ্রিয় বিনোদন। অতিরঞ্জিত এবং ‘পূর্বের সাফল্যের’ অনেক গল্পও শোনা যায় তাদের কাছ থেকে । যে পূর্বাভাসগুলোকে সফল বলে দাবি করা হয়, সেগুলো হয়ত দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা চালিয়ে আসা কোনো ভূ-তাত্ত্বিক ভয়কম্পন বিপর্যয় এর পুনঃবিবৃতি , অথবা সেটা এতই বিস্তৃত এবং অস্পষ্ট যে সাধারণ ভূ-তাত্ত্বিক কার্যাবলী দিয়েই সেটা ব্যাখা করা যায়। সাগরের স্রোত কিংবা প্রাণীদের অস্বাভাবিক আচরণ – কিছুই ভূমিকম্পের পূর্বাভাসে কার্যকরী বলে প্রমাণিত হয়নি। যদি একটি অবৈজ্ঞানিক ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়, তবে বিজ্ঞানীরা বলতে পারেন না যে (সেদিনে, সেই স্থানে) ভবিষ্যদ্বাণীকৃত ভূমিকম্প ঘটবে না । কারণ একটি ঘটনা ইতিমধ্যে পূর্বাভাস দেওয়া তারিখে আকস্মিকভাবে ঘটতেও পারে, যদিও এটি ভাবার কোন কারণ নেই যে পূর্বাভাসিত তারিখে ভুমিকম্প ঘটার সম্ভাবনা অন্য যেকোনো দিনের চেয়ে বেশি।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য , চীনে একটি China Earthquake Networks Center আছে , এবং এখান থেকে প্রাণীদের অস্বাভাবিক কার্যকলাপ প্রত্যক্ষ করে ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেওয়া হয়। ১৯৭৫ এর ৪ঠা ফেব্রুয়ারি চীনের হাইচেং এ ৭.৩ মাত্রার একটি ভূমিকম্প আঘাত হানলেও ক্ষয়ক্ষতি খুব কম হয়েছিল, কারন চীন আগে থেকেই প্রাণীর আচরণ পর্যবেক্ষণ করে এই ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দিয়েছিল।  চীনের এই পূর্বাভাস সম্পর্কে PNSN জানাচ্ছে, উক্ত ভূমিকম্পের আগে থেকেই বেশ কিছু পূর্ব-কম্পন (foreshock) অনুভূত হয়েছিল। এই কম্পনের কারণে প্রাণীকূল অস্বাভাবিক আচরণ করছিল এবং মানুষ নিজেদের বাসা ছেড়ে বাসার বাইরে বেশি সময় কাটাচ্ছিল। ফলে ভূমিকম্পের দিনে ক্ষয়ক্ষতি খুব কম হয়েছিল। দুঃখের বিষয়, অধিকাংশ ভূমিকম্পে এইভাবে পূর্ব-কম্পন দেখা যায়না। চীনদেশেই ১৯৭৬ সালে তাংশান এ ৭.৬ মাত্রার আরেকটি বড় ভুমিকম্প হয়েছিল। তখন আর কোনো ধরনের পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব হয়নি, এবং সেই ঘটনায় আড়াই লাখ মানুষ নিহত হয়েছিল।

বাংলাদেশের ভূমিকম্প নিয়ে চলতি গুজবের দিকে নজর ফেরাই। ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া এই গুজবের ব্যাপারে  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস অনুষদের ডিন ও ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. জিল্লুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেছেন, এটি সম্পূর্ণ গুজব। এখন পর্যন্ত ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেয়ার মতো প্রযুক্তি আবিষ্কৃত হয়নি।

বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ মেহেদী হাসান আনসারী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এটার কোনো বেসিস (ভিত্তি) নেই। এটা গুজব। ভূমিকম্প আগে থেকে আঁচ করা যায় না। যুক্তরাষ্ট্র, জাপানের মতো দেশ কোটি কোটি ডলার খরচ করেও এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি।

তিনি আরও বলেন, পোস্টে বিশেষজ্ঞের কথা বলা হলেও নির্দিষ্ট কারও নাম উল্লেখ করা হয়নি। একে আমলে নেয়ার কিছু নেই।

কানাডার সাসকাচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া ও জলবায়ু বিষয়ক গবেষক মোস্তফা কামাল (পলাশ) বলেছেন, ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেয়া যায় না। এ বিষয়ে গুজব এড়িয়ে চলুন।

তিনি বলেন,‘একটি নির্দিষ্ট মাত্রার ভূমিকম্প হবে ও একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে হবে। এমন কোনো পূর্বাভাস দেওয়ার পদ্ধতি পৃথিবীর স্বীকৃত কোনো ভূমিকম্প বিজ্ঞানী এখন পর্যন্ত আবিষ্কার করতে পারেনি। ভূমিকম্প নিয়ে মানুষের জানার সীমা এখন পর্যন্ত এই যে, কোনো স্থানে ভূমিকম্প হতে পারে ও সে স্থানে কত মানের ভূমিকম্প হওয়ার মতো স্থিতি শক্তি জমা হয়েছে। বাংলাদেশের আশপাশে ভূমিকম্প পরিমাপক যন্ত্রের সংখ্যা খুবই নগণ্য।’

এ বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, বড় ভূমিকম্প হওয়ার পূর্বে কোনো-কোনো স্থানে ১ থেকে ৩ মাত্রার ছোট-ছোট ভূমিকম্প হতে পারে; তবে এত ছোট মানের ভূমিকম্প পরিমাপের জন্য যে পরিমাণ সূক্ষ্ম যন্ত্র দরকার সেই পরিমাণে সূক্ষ্ম যন্ত্র বাংলাদেশের আশপাশে নাই।

‘ফলে আগামী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে বাংলাদেশ ৫.৫ থেকে ৬.৮ মাত্রার ভূমিকম্পের যে সংবাদ ফেসবুকে প্রচার করছে বিভিন্ন নামহীন ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞের উদ্ধৃতি দিয়ে, এর স্বপক্ষে আমার কাছে এই মুহূর্তে কোনো তথ্য-প্রমাণ নেই।’

মোস্তফা কামাল বলেন, বাংলাদেশের পূর্ব ও উত্তর পাশে খুবই সক্রিয় ভূমিকম্প বেল্ট রয়েছে। যেসব ফল্টে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার মতো শক্তি জমা রয়েছে। ফলে যে কোনো মুহূর্তে বাংলাদেশের আশপাশে বড় মানের ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে নির্দিষ্ট করে পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব না যে আগামী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে বাংলাদেশ ৫ দশমিক ৫ থেকে ৬ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পের সম্ভাবনা রয়েছে।

এই প্রেক্ষিতে বিভিন্ন গণমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া এই দাবিকে ‘গুজব’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। যেমন – নিউজবাংলা , জাগোনিউজ , ঢাকা ট্রিবিউন ইত্যাদি।


অতীতেও বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় ভূমিকম্পের আগাম পূর্বাভাস ছড়িয়েছিল, এবং বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছিলেন, এভাবে পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব নয়। এ বিষয়ে অতীতের ফ্যাক্টচেকিং রিপোর্ট দেখতে পারেন এখানে – এপি, স্নোপ্স , দি এক্সপ্রেস ট্রিবিউন।  

সার্বিক বিবেচনায় ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া এই দাবিগুলোকে ফ্যাক্টওয়াচ ‘মিথ্যা’ সাব্যস্ত করছে।

এই নিবন্ধটি ফেসবুকের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রামের নীতি মেনে লেখা হয়েছে।।
এর উপর ভিত্তি করে ফেসবুক যে ধরণের বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এখানে
এছাড়া এই নিবন্ধ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন, সম্পাদনা কিংবা আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার জন্য আবেদন করতে এই লিঙ্কের সাহায্য নিন।

কোনো তথ্যের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকেঃ
ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh