অলৌকিক পাথর গলিয়ে ফেলছে পেরেক – বিভ্রান্তিকর

Published on: June 2, 2022

একটি কালো পাথরে কিছু পেরেক রাখার পর নিমিষেই তা গলে যাচ্ছে- এমন একটি ভাইরাল ভিডিও কিছুদিন থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে সামাজিক মাধ্যমে। দাবি করা হচ্ছে, পাথরটি পাওয়া গেছে আফগানিস্তানে এবং এই পাথরে ইউরেনিয়াম রয়েছে।

অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, ভিডিওটি সত্য। এখানে কোনো ধরনের এডিট করা হয়নি। তবে পাথরের গুণের কারণে পেরেক গলে যাচ্ছে না, বরং পেরেকটি গ্যালিয়াম ধাতু দিয়ে তৈরি হওয়ার কারণেই গলে যাচ্ছে। ওই নির্দিষ্ট পাথরের এখানে কোনো ভূমিকা নেই। যে কোনো স্থানে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস এর বেশি তাপমাত্রা পেলেই এই পেরেকগুলো গলে যায়।

গুজবের উৎস:

২০২২ সালের ৬ ই মে ফেইসবুকের “ঢাকা মাহফিল মিডিয়া” নামক একটি পেইজ থেকে এই ভিডিও শেয়ার করে ক্যাপশান দেওয়া হয়-

“সুবহানাল্লাহ!

আফগানিস্তানের পাহাড়ে এমন কিছু ইউরেনিয়াম বৈশিষ্ট্য পাথর পাওয়া গিয়েছে যা দেখতে একেবারেই কুচ কালো।

এবং পাথরগুলি স্পর্শ করলে বরপ ( পড়ুন বরফ) শীতল মনে হয়, কিন্তু এর সংস্পর্শে কোন ধাতব বস্তু রাখার কিছুক্ষণ পর মোমের মত গলগল করে গলে পড়ে।“

 

একই রকম পোস্ট বিভিন্ন ফেইসবুক পেইজ থেকে একইভাবে কপি পেস্ট করে শেয়ার করা হয়।

এমন কিছু পোস্ট পাবেন  এখানে এখানে এবং এখানে


 

এই গুজবটা আন্তর্জাতিকভাবেও ভাইরাল।

২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসের ১ তারিখে @kabirkhan488 নামক একজন টুইটার ব্যবহারকারী টুইটারে একটি ক্লিপ শেয়ার করে বলেন আফগানিস্তানে পাওয়া একটি কালো পাথরে কিছু লোহার পেরেক রাখার পরেই সেগুলো গলে যাচ্ছে। পাথরটি ঠাণ্ডা হলেও স্টিল এবং লোহার তৈরি যেকোনো জিনিস ই নাকি এই পাথর গলিয়ে ফেলতে সক্ষম!

আসল পোস্টটি দেখুন এখানে

আন্তর্জাতিকভাবে ভাইরাল হওয়া কিছু লিংক দেখুন এখানে এখানে এবং এখানে

ফ্যাক্টওয়াচ অনুসন্ধান

পেরেক বলতে সবার প্রথমে লোহার পেরেক এর মথাই মাথায় আসে। তবে লোহা ছাড়াও অন্যান্য ধাতু দিয়ে পেরেক তৈরি করা সম্ভব।

লোহার গলনাঙ্ক ১৫৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্ত এর চেয়ে অনেক কম গলনাঙ্কের বিভিন্ন ধাতু পাওয়া যায়।

উপরের এই তালিকা থেকে দেখা যাচ্ছে, মার্কারি, গ্যালিয়াম, সিজিয়াম, ফ্রান্সিয়াম -এদের সবার গলনাংক খুব কম। মার্কারির মাইনাস ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এবং অন্যদের গলনাংক ২৭ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস এর মধ্যে ঘোরাফেরা করছে।

সাধারণ তাপমাত্রায় কক্ষ তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ধরা হয়। তবে একেক দেশে এবং একেক ঋতু তে এই তাপমাত্রা ওঠানামা করে। এছাড়া , মানুষের শরীরের সাধারণ তাপমাত্রা ৩৬.৫ থেকে ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস হয়ে থাকে।

গলনাঙ্কের সংজ্ঞা অনুযায়ী, কোনো পদার্থের গলনাঙ্কের চেয়ে বাইরের তাপমাত্রা বেশি হলে সেটি গলে যাবে। আর কম হলে সেটি কঠিন অবস্থায় থাকবে।

যেমন ,পানির গলনাঙ্ক ০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাই ০ ডিগ্রির চেয়ে তাপমাত্রা কম থাকলে বরফ জমে, আর বেশি হলেই পানিতে পরিণত হয়।

অধিকাংশ ধাতু ( লোহা, সোনা, রুপা, তামা, এলুমিয়াম ইত্যাদি) সাধারণ তাপমাত্রায় কঠিন পদার্থ হলেও মার্কারি, ফ্রান্সিয়াম, সিজিয়াম এবং গ্যালিয়াম – এই ৪ টা ধাতুকে সাধারণ তাপমাত্রায় প্রায়ই তরল অবস্থায় পাওয়া যায়।

ফ্রান্সিয়াম একটি তেজষ্ক্রিয় মৌল। এর অর্ধায়ু মাত্র ২২ মিনিট ,অর্থাৎ এটি ক্ষনস্থায়ী। একই সাথে এর মূল্য খুবই বেশি। ১ গ্রাম ফ্রান্সিয়াম এর দাম আনুমানিক ১ বিলিয়ন ডলার।

সিজিয়াম এর দাম অত বেশি না হলেও, বেশ ভালই দাম এর। এক গ্রাম এর দাম ৮৩ ডলার।

গ্যালিয়াম প্রতি কেজির দাম ৪৮৩ ডলার, অর্থাৎ এক গ্রাম এর দাম আধ ডলার এর চেয়েও কম। কম দাম হওয়ার কারণে, এবং স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ হওয়ার কারণে গ্যালিয়াম দিয়েই তরল ধাতুবিষয়ক বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়।

ইউটিউবে তরল গ্যালিয়াম ধাতুর কিছু ব্যবহার দেখতে পাবেন এখানে ।

অনেক পেশাদার জাদুকর গ্যালিয়াম এর তৈরি  চাবি কিংবা চামচ কিংবা ধাতব জিনিস ব্যবহার করে বিভিন্ন ম্যাজিক ট্রিক দেখান। যেমন ।

গ্যালিয়াম এর তৈরি লোহার পেরেক ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস এর চেয়ে বেশি গরম কোনো জায়গায় রাখলে, কিংবা সূর্যের রোদে রাখলে, কিংবা হাতের তালুতে রাখলেই সেটি কিছুক্ষণ পরে গলে যাবে।

আলোচ্য ভিডিওতে ঠিক সেটাই দেখা যাচ্ছে।

কাজেই, ধারণা করা যায় , এখানে লোহার পেরেক নেই, এখানে গ্যালিয়াম এর পেরেক রাখা হয়েছে।

কারন, লোহা গলালে যথাক্রমে তা নীল ও কমলা বর্ণ ধারণ করে এবং সবশেষে গলে যায়।  কিন্তু ভিডিওটিতে উল্লেখিত পেরেকগুলো গলে যাওয়ার পরেও ধাতুটির রং অপরিবর্তিত অর্থাৎ সাদা রয়েছে, যা গ্যালিয়াম ধাতুর বৈশিষ্ট্য ।

এছাড়া, ভাইরাল পোস্টের দাবি অনুযায়ী, এই পাথরগুলি যেকোনো ধাতুকে ‘মোমের মত গলগল করে গলাতে’ পারলেও ,ভিডিওতে কেবলমাত্র একটি ধাতুকেই গলাতে দেখা গেছে। লোহা সহ অন্য কোনো ধাতুকে গলাতে দেখা যায়নি। কেবলমাত্র গ্যালিয়াম, অর্থাৎ একটিমাত্র ধাতুকেই গলানোর ঘটনা দেখা গেছে।

মূল ভিডিওটা কবে কোথায় কে রেকর্ড করেছে, সেটি জানা সম্ভব হয়নি। তবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফ্যাক্ট চেকিং সংস্থাও এই ভিডিওর ধাতুকে ‘গ্যালিয়াম’ হিসেবে সনাক্ত করেছে।

যেমন- স্নোপস, অল্ট নিউজ , রিউমার স্ক্যানার , জেদ্দা এস্ট্রোনমি সোসাইটি  ইত্যাদি ।

এখানে, আরেকটি প্রশ্ন আসতে পারে। সেটা হল, গ্যালিয়াম যদি সাধারণ তাপমাত্রাতেই তরল থাকে, তাহলে একেবারে শুরুতে এগুলো কঠিন অবস্থায় ছিল কেন ?

ধারণা করছি, এই এক্সপেরিমেন্ট করার জন্য গ্যালিয়াম এর পেরেকগুলোকে নিম্ন তাপমাত্রায় ( বরফ দিয়ে, কিংবা পানির মধ্যে চুবিয়ে, অথবা কাপড় দিয়ে ঢেকে) রাখা হয়েছিল। ভিডিও শুরু আগে তাদেরকে বের করা হয়েছে এবং গলনাঙ্কের চেয়ে বেশি তাপমাত্রা পেয়ে সেগুলো গলে গিয়েছে।

আরো একটি সম্পূরক প্রশ্ন করতে পারেন অনেকে। গ্যালিয়াম যেহেতু কক্ষ তাপমাত্রায় তরল পদার্থ, তাহলে সেই গ্যালিয়াম দিয়ে এভাবে পেরেক বানানো কি লাভজনক হবে? এটা দিয়ে কোনো গৃহস্থালী কাজ করা যাবে?

এর উত্তর হচ্ছে, না। গ্যালিয়াম এর পেরেক বানানো লাভজনক নয়। ধারণা করছি, শুধুমাত্র এই পরীক্ষা, বা ভিডিও করার জন্য কোনো ছাঁচের সাহায্যে এই পেরেকগুলো বানানো হয়েছিল। কোনো সাধারণ বা নিয়মিত কাজের জন্য নয়।

পাথরটি কি ইউরেনিয়াম হতে পারে ?

ইউরেনিয়াম একটি তেজষ্ক্রিয় ধাতু। খনিতে পাথরের আকারে ইউরেনিউয়াম এর আকরিক পাওয়া যায়, যেখান থেকে রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় ইউরেনিয়াম আহরণ করা হয়। তেজষ্ক্রিয়তা প্রতিরোধী বিশেষ পোষাক পরে শ্রমিকরা এই ইউরেনিয়াম নিষ্কাশন করেন।

ইউরেনিয়াম ধাতু থেকে অনবরত আলফা,বিটা ও গামা রশ্মি বের হতে থাকে। আশেপাশে কোনো গাইগার মুলার কাউন্টার নামক যন্ত্র থাকলে সেটিতে এর তেজষ্ক্রিয়তা দেখা যাবে। মানব কোষে এই তেজষ্ক্রিয় রশ্মি ঢুকলে সেটি কোষ মেরে ফেলা সহ শরীরে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।

তবে ইউরেনিয়াম ধাতু, অথবা ইউরেনিয়াম আকরিক এর এমন কোনো বৈশিষ্ট্য নেই, যার ফলে আশেপাশের অন্য বস্তুর তাপমাত্রা বৃদ্ধি করবে।

এছাড়া, পাথরটি থেকে যদি উচ্চ তাপমাত্রা নির্গত হত ( যে তাপমাত্রা ১৫৩৮ ডিগ্রি গলনাংকের লোহাকে গলিয়ে ফেলতে পারে), সেক্ষেত্রে ,এত উচ্চ তাপমাত্রায় পরীক্ষক স্থির হয়ে বসে এত কাছ থেকে ভিডিও করতে পারতেন না। এখান থেকেও বোঝা যায়, পাথর থেকে কোনো তাপ নির্গত হয়নি। কাজেই, এটি সাধারণ পাথর হবার সম্ভাবনাই বেশি।

তবে আফগানিস্তানের বিভিন্ন খনিতে ইউরেনিয়াম খনিজ পদার্থটি আছে, এবং এর প্রেক্ষিতে গুজবটি বেশি বিশ্বাসযোগ্যতা পেয়েছিল।

সারমর্ম

ভাইরাল ভিডিওতে প্রদর্শিত ঘটনাটি সত্য। এখানে অলৌকিকতার কিছু নেই । তবে ভিডিওর ক্যাপশনে বিভিন্ন বিভ্রান্তিকর দাবি করা হচ্ছে। এখানে ,পাথরের কোনো বিশেষ ক্ষমতা নেই। তবে পেরেকগুলো বিশেষ ধাতু, গ্যালিয়াম, দিয়ে তৈরি ,যা সহজেই গলে যেতে পারে। নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় যে কোনো সাধারণ পাথর বা হাতের তালুতে রেখে দিলেই এই ধাতু কিছুক্ষণের মধ্যে গলে যায়। সার্বিক বিবেচনায় ফ্যাক্টওয়াচ এই পোস্টগুলোকে বিভ্রান্তিকর সাব্যস্ত করছে।

 

আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন?
কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন?
নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?

এসবের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে জানান।
আমাদেরকে ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh

Leave a Reply