ইসলামী স্লোগান দেয়ায় নবীকে জেলে দিতে বলেছেন মির্জা আব্বাস?

Published on: November 19, 2023

যা দাবি করা হচ্ছে: একটি ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে “নবী প্রেমীর অ্যাকশন, ডাইরেক্ট অ্যাকশন, নারায়ে তাকবীর, আল্লাহু আকবর” স্লোগান শুনে বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাস স্লোগানকারীকে উদ্দেশ্য করে বলছেন, “ওই বেটা কার কথা কইতেছোস তুই? ফাজিল কোথাকার! নবী কি জেলে গেছে নাকি? নবীরে ধইরা জেলে দিয়া আয় কমুনি। ফাজিল কোথাকার!” উক্ত ভিডিওটির নিচে জুড়ে দেয়া টেক্সটে দাবি করা হচ্ছে যে, ইসলামী স্লোগান দেয়ায় নবীকে জেলে দিতে বললেন বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাস।

যা আসলে ঘটেছে: গত ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৩ এ একদফা দাবির আন্দোলনে যাত্রাবাড়িতে একটি সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তৃতা দিতে গিয়ে মির্জা আব্বাস ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির গ্রেফতারকৃত বিভিন্ন নেতাকর্মীদের নাম বলছিলেন। এই সময় কিছু স্লোগানকারীকে “নবী ভাই, নবী ভাই” বলে স্লোগান দিতে শোনা যায়। বারবার স্লোগান বন্ধ করতে বলা হলেও তা বন্ধ করা হয়নি বিধায় মির্জা আব্বাস বক্তৃতার একপর্যায়ে বিরক্ত হয়ে স্লোগানকারীকে উদ্দেশ্য করে বলেন,  “ওই বেটা কার কথা কইতেছোস তুই? ফাজিল কোথাকার! নবী কি জেলে গেছে নাকি? নবীরে ধইরা জেলে দিয়া আয় কমুনি। ফাজিল কোথাকার!” উল্লেখ্য, স্লোগানকারীরা যে “নবী ভাইয়ের” নাম নিয়ে স্লোগান দিচ্ছিলেন তিনি ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক নবী উল্লাহ নবী। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের ইউটিউব চ্যানেল থেকে প্রাপ্ত ২২ সেপ্টেম্বর এ অনুষ্ঠিত সমাবেশের ভিডিও ক্লিপ থেকে বিষয়গুলো সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে। অতএব, ইসলামী স্লোগান দেয়ায় নবীকে জেলে দিতে বলেছেন মির্জা আব্বাস – এটা সঠিক নয়। সঙ্গত কারণে ফ্যাক্টওয়াচ সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত ভিডিওটির দাবিকে “মিথ্যা” বলে সাব্যস্ত করছে। 

এমন কয়েকটি ভিডিও এর নমুনা দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এবং এখানে। 

 

ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধান:

সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত ভিডিওটিতে উত্থাপিত দাবিটি সঠিক কিনা তা যাচাই করতে আমরা উক্ত ভিডিও থেকে কিছু স্ক্রিনশট নিয়ে রিভার্স ইমেজ সার্চ পদ্ধতিতে অনুসন্ধান করি। প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানা গেছে, উক্ত ভিডিওটি গত ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৩ এ যাত্রাবাড়িতে আয়েজিত ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির একটি সমাবেশে মির্জা আব্বাসের বক্তৃতা দেয়ার সময় ধারণ করা হয়েছিলো। পরবর্তীতে উক্ত সমাবেশের স্থান এবং সময়কে সূত্র ধরে মির্জা আব্বাসের সম্পূর্ণ বক্তৃতাটি খুঁজতে গিয়ে জাগো নিউজ এবং দৈনিক ইত্তেফাক এর অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলে ২২ এবং ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩ এ প্রকাশিত দুটো ভিডিও খুঁজে পাওয়া গেছে। উক্ত ভিডিও দুটো দেখে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, সেগুলো যাত্রাবাড়িতে বিএনপির সমাবেশে মির্জা আব্বাসের দেয়া বক্তৃতার অংশ। 

দৈনিক ইত্তেফাকের ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশিত “১ দফা দাবিতে বিএনপির সমাবেশে বক্তব্য দিচ্ছেন মির্জা আব্বাস” শিরোনাম সংবলিত ১৫ মিনিট পাঁচ সেকেন্ডের ভিডিওটির ৩৫ সেকেন্ড থেকে তিন মিনিট ২০ সেকেন্ড পর্যন্ত শুনে বোঝা গেছে যে, মির্জা আব্বাস ইসলামী স্লোগান দেয়ার নবীকে জেলে দিতে বলেননি। বরং এই দুই মিনিট ৪৫ সেকেন্ড অংশে তিনি যা বলেছিলেন তার সারাংশ করলে দাঁড়ায়: একদফা এবং বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে বিএনপির সমাবেশটি অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। গত ১৫ বছরে আওয়ামীলীগ সরকারের নিপীড়নের শিকার হয়ে অনেক বিএনপি নেতাকর্মী প্রাণ হারিয়েছেন এবং অনেকে গ্রেফতার হয়ে জেলে আছেন। তাঁদের কথা বলতে গিয়ে মির্জা আব্বাস বক্তৃতার একটি পর্যায়ে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির কয়েকজন নেতাকর্মীর (ঢাকা-৫ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক তানভীর আহমেদ রবিন, সাধারণ সম্পাদক রফিকুল আলম মজনু, ইউসুফ বিন জলিল কালু, প্রভৃতি)  নাম উল্লেখ করেন। মির্জা আব্বাস যখন গ্রেফতারকৃত নেতাকর্মীদের নাম বলছিলেন সেই সময় সমাবেশে উপস্থিতরত কিছু স্লোগানকারীকে “নবী ভাই, নবী ভাই” রবে স্লোগান দিতে শোনা যায়। বক্তৃতার মাঝে ব্যাঘাত ঘটায় মির্জা আব্বাস বিরক্ত হয়ে যান এবং স্লোগানকারীদের কাছে জানতে চান তারা কোন নবীর কথা বলছেন। এইখানে আমরা ধারণা করে নিচ্ছি মির্জা আব্বাস বুঝতে পেরেছিলেন স্লোগানকারীরা ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক নবী উল্লাহ নবী এর নাম নিয়ে স্লোগান দিচ্ছিলেন। কেননা পরে তিনি বলেছিলেন, নবী কি জেলে গিয়েছিলো নাকি। মজার ব্যাপার হচ্ছে, সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত ভিডিও এবং ইউটিউব থেকে প্রাপ্ত ভিডিওতে দেখা গেছে নবী উল্লাহ নবী একটি সাদা-কালো ডোরাকাটা শার্ট পরিহিত অবস্থায় মির্জা আব্বাসের ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন ঐ মূহুর্তে। 

তাছাড়া, জাগো নিউজ২৪ এর ওয়েবসাইট এবং অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলে অভিন্ন অর্থাৎ, “স্লোগানে বিরক্ত হয়ে মেজাজ হারালেন আব্বাস” – শিরোনাম সংবলিত একটি প্রতিবেদন এবং একটি ভিডিও খুঁজে পাওয়া গেছে, যা আমাদের যাচাইকে আরও নিশ্চিত করেছে।

এখন আসা যাক সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত ভিডিওটিতে কি ঘটেছিলো সেই বিষয়ে। মূলত বিএনপির সমাবেশে মির্জা আব্বাসের বক্তৃতার ভিডিওটির কিছু অংশকে ডিজিটাল প্রযুক্তির সহায়তায় সম্পাদনা করে “নারায়ে তাকবীর, আল্লাহু আকবর” অংশটুকু কৌশলে জুড়ে দেয়া হয়েছিলো, যা আসলে ঐ বক্তৃতারই অংশ না। কিন্তু সম্পাদনাটি এমনভাবে করা হয়েছিলো যাতে মনে হচ্ছিলো মির্জা আব্বাস ইসলামী স্লোগান শুনে বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলেন। তখন সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত ভিডিও এবং ভিডিও এর নিচে জুড়ে দেয়া টেক্সট এর বক্তব্য পড়ে মনে হচ্ছিলো মির্জা আব্বাস বোধহয় নবী মুহাম্মদ (সা:) কে উদ্দেশ্য করে কিছু বলেছেন। তবে, উপরের আলোচনা থেকে আমরা এখন বুঝতে পেরেছি যে, মির্জা আব্বাস কোন ইসলামী স্লোগান শুনে বিরক্ত হননি এবং নবী মুহাম্মদ (সা:) কে উদ্দেশ্য করে কিছু বলেননি। 

সুতরাং, সবকিছু বিবেচনা করে ফ্যাক্টওয়াচ সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত ভিডিওটির দাবিকে মিথ্যা বলে সাব্যস্ত করেছে। 

এই নিবন্ধটি ফেসবুকের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রামের নীতি মেনে লেখা হয়েছে।।
এর উপর ভিত্তি করে ফেসবুক যে ধরণের বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এখানে
এছাড়া এই নিবন্ধ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন, সম্পাদনা কিংবা আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার জন্য আবেদন করতে এই লিঙ্কের সাহায্য নিন।

কোনো তথ্যের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকেঃ
ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh