সিলেট-১০ কূপই কি বাংলাদেশের প্রথম তেলের খনি?

Published on: December 14, 2023

গত ১০ ডিসেম্বর ২০২৩ এ আয়োজিত একটি সংবাদ সম্মেলনে সিলেটের জৈন্তাপুর – গোয়াইনঘাট এলাকায় ১০ নাম্বার কূপে তেলের সন্ধান পাওয়া গেছে বলে জানান বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু। অতঃপর এই ঘটনাকে “দেশের প্রথম তেলের খনির সন্ধান পাওয়া গেছে” দাবিতে সয়লাব হয়ে যায় সামাজিক মাধ্যম পরিমন্ডল। পিছিয়ে ছিলো না বেশকিছু অনলাইন-ভিত্তিক সংবাদমাধ্যমও। তবে অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, এবারই প্রথম দেশে তেলের খনি আবিষ্কৃত হয়নি। বরং এর আগে ১৯৮৬ সালে সিলেটের হরিপুরে প্রথম তেলের সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল এবং সেটা পাঁচ বছর স্থায়ী হয়েছিল। মজার ব্যাপার হচ্ছে, সিলেটের হরিপুরে প্রথম তেলের মজুত পাওয়ার কথা নসরুল হামিদ বিপু উক্ত সংবাদ সম্মেলনেও বলেছিলেন! তাই সঙ্গত কারণে ফ্যাক্টওয়াচ সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত পোস্টের দাবিকে “মিথ্যা” বলে সাব্যস্ত করছে। 

এমন কিছু পোস্টের নমুনা দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এবং এখানে

দেশে প্রথম তেলের খনির সন্ধান পাওয়া গেছে – এই মর্মে প্রকাশিত কয়েকটি সংবাদমাধ্যমের সংবাদ দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এবং এখানে (আর্কাইভ)।

 

 

ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধান:

সিলেটে সাম্প্রতিক সময়ে তেলের খনি আবিষ্কৃত হওয়ার ঘটনাটি দেশে প্রথম তেলের খনি পাওয়া যাওয়ার ঘটনা কিনা তা যাচাই করতে আমাদের বেশিদূর যেতে হয়নি! গত ১০ ডিসেম্বর ২০২৩ এ আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু জানান, সিলেটের জৈন্তাপুর – গোয়াইনঘাট এলাকায় ১০ নাম্বার কূপে ২৫৭৬ মিটার গভীরতায় খনন করে চারটি স্তরে গ্যাসের সন্ধান পাওয়া গেছে এবং এর মাঝে ১৩৯৭ মিটার থেকে ১৪৪৫ মিটার গভীরতায় পরীক্ষা করে তেলের উপস্থিতি জানা গেছে। তিনি আরও জানান, ঐ কূপ থেকে পরীক্ষামূলকভাবে প্রতি ঘন্টায় ৩৫ ব্যারেল তেলের প্রবাহ পাওয়া গেছে এবং তেলের মজুতের তথ্য জানতে আরও চার থেকে পাঁচ মাস অপেক্ষা করতে হবে। নতুন আবিষ্কৃত তেলের খনি থেকে সম্ভাব্য লাভের কথা বলতে গিয়ে প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু বলেন, “এর আগে ১৯৮৬ সালে দেশে প্রথম তেলের সন্ধান পাওয়া যায় হরিপুরে। এটি পাঁচ বছর স্থায়ী হয়েছিল। ওই সময় এপিআই গ্র্যাভিটি ২৭ ডিগ্রি। এবার সিলেট গ্যাসক্ষেত্রের নতুন কূপে ১ হাজার ৩৯৭ থেকে ১ হাজার ৪৪৫ মিটার গভীরতায় ৮ ডিসেম্বর তেলের উপস্থিতি জানা যায়। প্রাথমিকভাবে এপিআই গ্র্যাভিটি ২৯ দশমিক ৭ ডিগ্রি পাওয়া গেছে।” দেখুন এখানে। 

উল্লেখ্য, এপিআই গ্র্যাভিটি (API Gravity) হচ্ছে আমেরিকান পেট্রোলিয়াম ইন্সটিটিউট এর বেঁধে দেয়া একটি নির্দেশক (Indicator), যা দিয়ে খনি থেকে উত্তোলিত অপরিশোধিত তেলের ভরের প্রতি নির্দেশ করা হয়। তেলের এপিআই গ্র্যাভিটি যত বেশি হবে তা তত বেশি হালকা হবে এবং এপিআই গ্রাভিটি যত কম হবে তা তত ভারী হবে। এপিআই গ্র্যাভিটির উপর ভিত্তি করে অপরিশোধিত তেলকে চারটি শ্রেণীতে (লাইট, মিডিয়াম, হেভি, এবং এক্সট্রা হেভি) ভাগ করা হয়। সিলেটে আবিষ্কৃত নতুন খনি থেকে পাওয়া তেলের এপিআই গ্র্যাভিটি হচ্ছে ২৯.৭ ডিগ্রি, যা মিডিয়াম ক্রুড অয়েল ক্যাটাগরিতে পড়ে। তেলের এপিআই গ্র্যাভিটির উপর তার বাজার মূল্য নির্ভর করে। এপিআই গ্র্যাভিটি যত বেশি হবে তার মূল্যও তত বেশি পাওয়া যাবে।

সিলেটে নতুন তেলের খনির সন্ধান পাওয়া গেছে – এই মর্মে প্রকাশিত বিভিন্ন মূলধারার সংবাদমাধ্যমের কয়েকটি সংবাদ পড়ুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এবং এখানে

১৯৮৬ সালে সিলেটের হরিপুরে প্রাপ্ত তেলের খনি থেকে কেন তেল উত্তোলন অব্যাহত রাখা সম্ভব হয়নি সে সম্পর্কে বিবিসি বাংলাকে বলতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বদরুল ইমাম পদ্ধতিগত উত্তোলনের উপর মনোযোগ দেয়ার কথা বলেন। তিনি বলেন, “হরিপুরে যেটা পাওয়া গিয়েছিল সেখানে কিন্তু নিয়ম মেনে তেল তোলা হয় নি। শুধুমাত্র যতদিন প্রাকৃতিকভাবে উঠে আসছে, ততদিন তোলা হয়েছে। কিন্তু তারপর তেলক্ষেত্র ডেভেলপ করা হয়নি।” তিনি আরও বলেন, “প্রাকৃতিকভাবে তেল ওঠা বন্ধ হয়ে গেলে আমরা মনে করি শেষ হয়ে গিয়েছে। তেল কিন্তু মাইগ্রেশন করে, তারা সরে গিয়ে একটা যুৎসই জায়গায় রিজার্ভ হয়। তখন ভিন্নভাবে ইন্ডাকশন অয়েল দিয়ে তেল উত্তোলন করতে হয়। আমাদের সেরকম পদ্ধতি অবলম্বন করা উচিত।”

মজার ব্যাপার হচ্ছে, যে সকল সংবাদমাধ্যমগুলো “দেশে প্রথম তেলের খনির সন্ধান পাওয়া গেছে” মর্মে সংবাদ প্রকাশ করেছে, তারা কেউ-ই সংবাদের মূল অংশে ১৯৮৬ সালে হরিপুরে পাওয়া প্রথম তেলের খনির কথা উল্লেখ করেননি। উক্ত সংবাদমাধ্যমগুলো নসরুল হামিদ বিপুর সংবাদ সম্মেলনকে তথ্যসূত্র হিসেবে উল্লেখ করে সিলেটে প্রাপ্ত নতুন তেলের খনির সন্ধান পাওয়ার খবরটি প্রকাশ করেছে। অথচ একই সংবাদ সম্মেলনে প্রতিমন্ত্রী মহোদয় যে হরিপুরে পাওয়া প্রথম তেলের খনির কথা বলেছেন সেই তথ্য তাদের কর্ণ বা দৃষ্টিগোচর হয়নি।

অতএব, এই বিষয়টি স্পষ্ট যে, সাম্প্রতিক সময়ে দেশে প্রথম তেলের খনির সন্ধান পাওয়ার তথ্যটি সঠিক নয়। কেননা এর আগেও দেশে তেলের খনির সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল।

সুতরাং, সবকিছু বিবেচনা করে ফ্যাক্টওয়াচ সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত পোস্টের দাবিকে “মিথ্যা” বলে সাব্যস্ত করছে। 

এই নিবন্ধটি ফেসবুকের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রামের নীতি মেনে লেখা হয়েছে।।
এর উপর ভিত্তি করে ফেসবুক যে ধরণের বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এখানে
এছাড়া এই নিবন্ধ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন, সম্পাদনা কিংবা আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার জন্য আবেদন করতে এই লিঙ্কের সাহায্য নিন।

কোনো তথ্যের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকেঃ
ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh