ডিবিপ্রধান হারুন কি ক্ষমা চেয়ে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন?

Published on: December 14, 2023

যা দাবি করা হচ্ছেঃ ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া এই ভিডিওতে দাবি করা হচ্ছে ক্ষমাচেয়ে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন ডিবিপ্রধান হারুন অর রশিদ।

অনুসন্ধানে যা পাওয়া যাচ্ছেঃ দাবিটি মিথ্যা। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) এর প্রধান হারুন অর রশিদ পদত্যাগের কোনো ঘোষণা দেননি। ভাইরাল ভিডিওতে এই দাবিটির সমর্থনে প্রমাণ হিসেবে যে আলাদা আলাদা চারটি ভিডিও ফুটেজ ব্যবহার করা হয়েছে তা সম্পুর্ণ ভিন্ন প্রেক্ষাপটের। এগুলোকে নানান কায়দায় জোড়া লাগিয়ে আলোচিত ভিডিওটি বানানো হয়েছে। অন্যদিকে, মূলধারার সংবাদমাধ্যম বা নির্ভরযোগ্য কোনো উৎস থেকে এমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি যার মাধ্যমে এটা নিশ্চিত হওয়া যায় যে, ডিবিপ্রধান হারুন পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন।

 ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া এমন কিছু পোষ্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে

ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধান:

ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওটি সত্যিই ডিবি প্রধান হারুন অর রশিদের ক্ষমাচেয়ে পদত্যাগের ঘোষণা সংক্রান্ত কি না — এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার জন্য শুরুতেই ভিডিওটি বিশ্লেষণ করে দেখে ফ্যাক্টওয়াচ টিম। ভিডিওর শুরু থেকে ৯ সেকেন্ড পর্যন্ত হারুন অর রশিদকে কান্না করতে দেখা যায়। এরপরে ৯ থেকে ২১ সেকেন্ড পর্যন্ত অংশে এনটিভি নিউজের একটি ভিডিও প্রতিবেদনের ক্লিপ দেখা যায়। সেখানে এনটিভির একজন সংবাদ উপস্থাপিকাকে বলতে শোনা যায় “হারুন অর রশিদকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। রবিবার রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের পুলিশ-১ অধিশাখার উপসচিব ধনঞ্জয়কুমার দাস স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে এই আদেশ দেয়া হয়।” কিন্তু, সেখানে নির্দিষ্ট কোনো সময়ের উল্লেখ পাওয়া যায়নি। আবার, ২১ থেকে ২৭ সেকেন্ড অন্য আরেকজন সংবাদ উপস্থাপিকাকে হারুন অর  রশিদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের তদন্তের ব্যাপারে বলছিলেন। পরবর্তীতে, ২৭ সেকেন্ড থেকে ৫০ সেকেন্ড পর্যন্ত অংশে  স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর একটি বক্তব্য দেখা যায়। সেখানে তিনি বলছিলেন যে, তদন্তে অপরাধ প্রমাণিত হলে হারুনের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে। ৫০ সেকেন্ড থেকে শেষ পর্যন্ত হারুন অর রশিদের কান্নার ফুটেজটির পুনরাবৃত্তি করে তার শেষে ফুটেজগুলো থেকে নেয়া কিছু স্ক্রিনশট যোগ করা হয়। অর্থাৎ, ভিডিওর কোথাও ডিবিপ্রধানের পদত্যাগের ব্যাপারে নিশ্চিত  কোনো প্রমাণের উল্লেখ নেই।

পরবর্তিতে ইউটিউবে প্রাসঙ্গিক কিছু কী-ওয়ার্ড ধরে অনুসন্ধান করে ভিডিও ফুটেজগুলোর উৎস খুঁজে পায় ফ্যাক্টওয়াচ টিম। সেখানে দেখা যায় যে, ভিন্ন ভিন্ন সংবাদমাধ্যমের চারটি আলাদা আলাদা ভিডিও প্রতিবেদনের ফুটেজ বিভিন্ন ভাবে জোড়া লাগিয়েই আলোচিত ভিডিওটি বানানো হয়েছে।

ভাইরাল ফুটেজগুলো সম্পর্কে ফ্যাক্টওয়াচের গবেষণা থেকে যা জানা গেছে:

ফুটেজ এক

হারুন অর রশিদের কান্নার ফুটেজটি একুশে টেলিভিশনের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলে ২০১৯ সালের ৭ নভেম্বর “ছেলের প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে অঝোরে কাঁদলেন এসপি হারুন” শিরোনামে আপলোড করা একটি ভিডিও প্রতিবেদনের অংশ। মূলত ২০১৯ সালের ৪ নভেম্বর হারুন অর রশিদকে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার (এসপি) পদ থেকে বদলি করে পুলিশ সদর দফতরের পুলিশ সুপার (টিআর) হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছিল। ২০১৯ সালের ৭ নভেম্বর যখন তাকে বিদায়ী সংবর্ধনা দেয়া হয় তখন সেই অনুষ্ঠানে অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে কেঁদে ফেলেছিলেন হারুন অর রশিদ। এই কান্নার অংশটুকুই আলোচিত ভিডিওতে ব্যবহার করা হয়েছে।

ফুটেজ দুই

আলোচিত ভিডিওতে এনটিভির যেই ভিডিও প্রতিবেদনের ফুটেজ ব্যবহার করা হয়েছে সেটা হচ্ছে এনটিভির অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলে ২০১৯ সালের ৪ নভেম্বর “প্রত্যাহার করা হলো পুলিশ সুপার হারুন অর রশিদকে” শীর্ষক শিরোনামে আপলোড করা একটি ভিডিও প্রতিবেদনের অংশ। এই প্রতিবেদনটিও ছিল হারুনকে নারায়ণগঞ্জ পুলিশ সুপার কার্যালয় থেকে পুলিশ সদর দফতরে বদিল করা সম্পর্কিত।

ফুটেজ তিন

হারুন অর  রশিদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের তদন্ত সম্পর্কিত যেই ফুটেজটি দেখা যাচ্ছে সেটা হচ্ছে চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলে ২০১৯ সালের ৭ নভেম্বর আপলোড করা একটি ভিডিও প্রতিবেদনের অংশ। প্রতিবেদনটির শিরোনাম হচ্ছে “এসপি হারুনের বিষয়ে তদন্ত চলছে, অপরাধ প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী”। এই প্রতিবেদনটির মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার (এসপি) থাকাকালীন সময়ে হারুনের বিরুদ্ধে যে চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠেছিল সেই বিষয়েই তদন্তের ব্যাপারে বলছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

ফুটেজ চার

এই ফুটেজটিও হচ্ছে যমুনা টেলিভিশনের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলে এসপি হারুনকে নারায়ণগঞ্জ থেকে প্রত্যাহার সংক্রান্ত একটি ভিডিও প্রতিবেদনের অংশ। এই প্রতিবেদনটি ২০১৯ সালের ৭ নভেম্বর প্রকাশিত হয়েছিল।

 

উল্লেখ্য, মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার (এসপি) থাকাকালীন ২০১৯ সালে তার বিরুদ্ধে পারটেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান এম এ হাসেমের ছেলে ও আম্বার গ্রুপের চেয়ারম্যান শওকত আজিজ রাসেলের কাছ থেকে চাঁদা দাবির অভিযোগ  উঠেছিল।

অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে যে, আলোচিত ভিডিওর ফুটেজগুলো চার বছর আগের। কিন্তু মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ ২০২২ সালের ১৩ জুলাই ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি)  প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। তার পদবী হচ্ছে “অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (গোয়েন্দা), ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ”, এবং আজ পর্যন্ত তিনি এই পদেই বহাল আছেন। নির্ভরযোগ্য কোনো সোর্স বা মূলধারার কোনো সংবাদমাধ্যমে ডিবিপ্রধান হারুন অর রশিদের ক্ষমাচেয়ে পদত্যাগের ঘোষণা সংক্রান্ত কোনো তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি।

সুতরাং, সবকিছু বিবেচনা করে ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া পোস্টগুলোকে ফ্যাক্টওয়াচ মিথ্যা হিসেবে সাব্যস্ত করেছে। 

এই নিবন্ধটি ফেসবুকের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রামের নীতি মেনে লেখা হয়েছে।।
এর উপর ভিত্তি করে ফেসবুক যে ধরণের বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এখানে
এছাড়া এই নিবন্ধ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন, সম্পাদনা কিংবা আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার জন্য আবেদন করতে এই লিঙ্কের সাহায্য নিন।

কোনো তথ্যের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকেঃ
ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh