বঙ্গবাজারের ধ্বংসস্তুপ থেকে অক্ষত কোরআন এবং গীতা উদ্ধারের ভুয়া দাবি

Published on: April 6, 2023

গত মঙ্গলবার ৬ই এপ্রিল সকালে ঢাকার বঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ডের পর এই বিপণীকেন্দ্রের অধিকাংশ মালামাল পুড়ে ভস্মীভূত হয়ে যায়। এরই পটভূমিতে একটি অক্ষত কোরআন শরীফ এবং একটি অক্ষত শ্রীমদ্ভগবতগীতার ছবি ভাইরাল হয়েছে। দাবি করা হয়েছে, ভয়াবহ আগুনের পরেও অলৌকিক কারণে এরা ভস্মীভূত হয়নি। তবে ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, গীতার কপিটি বঙ্গবাজারের ঘটনাস্থলে ছিল না, বরং এটি সম্পূর্ন ভিন্ন একটি ঘটনার ছবি। এছাড়া ‘কোরআন শরীফ’ দাবীতে যে বইটি দেখানো হচ্ছে, সেটি কোরআন শরীফ নয়, বরং ভিন্ন একটি আরবি বই ।

গুজবের উৎস

অক্ষত কোরআন উদ্ধারের কয়েকটি গুজবের পোস্ট দেখুন এখানে , এখানে , এখানে , এখানে

অক্ষত গীতা উদ্ধার গুজবের কয়েকটা পোস্ট দেখুন এখানে , এখানে , এখানে , এখানে


ফ্যাক্টওয়াচ অনুসন্ধান : কোরআন শরীফ উদ্ধার

এস এম বাশার মাহমুদ একটি ভিডিও আপলোড করে জানাচ্ছেন, বঙ্গবাজারে ছাই থেকে অক্ষত অবস্থায় কোরআন পেলেন এক ব্যবসায়ী। ব্যবসায়ী জানান যখন সে কোরআন টা হাতে তুলেনেন  তখনও গরম ছিল সুবাহানআল্লাহ।

নাজিম টেইলার্স এর এক কর্মচারী এই বইটি উদ্ধারের দাবি করে জানান , আমাদের  অফিসে একটি মসজিদ ছিল ছোটখাট, ওখানে নামাজ পড়া হয়।  আমি ওটার মধ্যে ঢুকেছি , কিন্তু ঢোকার সাথে সাথে আমার জুতা এত গরম হইছে যে পুরা শরীর পুড়ে ঘাম বয়ে গেছে। আমি ঢুকে দেখি একটা তাকে  রইছে এভাবে ,পড়ে আছে ।  আমি দেখি যে ওটা কোরান শরীফ , তারপর আমি ওটা বুকে নিয়ে বেরিয়ে আসছি।

কাছাকাছি ধরনের ক্যাপশনসহ অনেকে ছবি বা ভিডিও আপলোড করেছেন । তবে এই বইটির প্রচ্ছদের ছবি দেখে অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।

গবেষক জুম্মা খান এক ফেসবুক স্ট্যাটাসের মাধ্যমে জানান , এটি কোরআন শরীফ নয় । বরং এটি হল এইটা সহিহ বুখারি (একটি হাদিস) এর ব্যাখ্যাগ্রন্থ। আল্লামা বদরউদ্দিন আইনি হানাফি রচিত কিতাব ‘উমদাতুল কারি শরহে সহিহুল বুখারি’ হল এই বইয়ের নাম।

আমির হামজা নাটোরী নামক ফেসবুক একাউন্ট থেকে এই পোস্টে বলা হয়,  ঐ লোকের হাতে দেখা যাচ্ছে ( উমদাতুল কারি) এটা একটা আরবী কিতাব কুরআন শরীফ নয় ।

জনৈক শিবলী আহমেদ জানাচ্ছেন, বঙ্গবাজারে মিডিয়াকর্মীরা কুরআন শরীফ অক্ষত রয়েছে বলে যে নিউজটি প্রচার করছে! মূলত সেটি কুরআন শরীফ নয় সেটি বুখারী শরীফের শরাহ {ব্যাখ্যা গ্রন্থ}।

বাংলাভিশন এর ফেসবুক পেজ থেকে প্রথমে এই বইকে ‘কোরআন শরীফ’ দাবি করা হলেও, পরে একে সংশোধন করে ‘আরবি কিতাব’ বলা হয়।


অপরাপর সংবাদমাধ্যম থেকেও এই খবরটি সংশোধন করা হয়।

ফ্যাক্টওয়াচ অনুসন্ধান : শ্রীমদ্ভগবতগীতা উদ্ধার

‘বৈশাখী মিডিয়া’ নামক ফেসবুক পেজে ৫ই এপ্রিল দুপুর ১টা ৩৫ মিনিটের এই পোস্টে বলা হয়েছে, বঙ্গবাজারে একজন হিন্দুর দোকান অক্ষত গীতা উদ্ধার! লক্ষ লক্ষ টাকা পুড়ে গেছে কিন্তু শ্রীমদ্ভগবদগীতা রয়ে গেছে।

এই ক্যাপশনের সাথে আংশিক পুড়ে যাওয়া শ্রীমদ্ভগবতগীতার একটি কপির প্রথম পৃষ্ঠা দেখতে পাওয়া যায় যেখানে সম্পাদক হিসেবে শ্রী ববি চক্রবর্তী এবং রংপুরের একটি প্রকাশনীর নাম উল্লেখ করা ছিল।

পরবর্তী কয়েক ঘণ্টায় এই ছবি ভাইরাল হয়ে যায়। তবে কেউই বঙ্গবাজারের উক্ত ব্যবসায়ীর নাম কিংবা তার দোকানের নাম জানাতে পারেন নি।

তবে অনেকে এই ছবিকে ভিন্ন একটি ঘটনার পুরনো ছবি বলে দাবি করেন। অনুসন্ধানে দেখা যায়, জনৈক সৌরভ মোহন্ত হীরা গত ২রা এপ্রিল দুপুর  ১টা ১৬ মিনিটে হিন্দু_প্রেম_ক্যানভাস_গ্রুপ নামক পাবলিক গ্রুপে এই ছবিটি আপলোড করেছিলেন। সেখানে তিনি ক্যাপশনে লিখেছিলেন, নিজের সাথে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা শেয়ার করছি।আমাদের বাড়িতে একবার আগুন লেগেছিল,, সেই আগুনে পুরো ঘর পুড়ে ছাই হয়ে গেলেও পুরে যায়নি গীতা টি🥰

#জয়_গীতা

#হরে_কৃষ্ণ

একই গ্রুপে জনৈক নয়ন চক্রবর্তীও একই ক্যাপশনে একই ছবি পোস্ট করেন ৩রা এপ্রিল তারিখে ।

২রা এপ্রিল দুপুরের পরে এই ছবিটা একটু ভিন্ন ক্যাপশনে বিভিন্ন গ্রুপে এবং পেজে শেয়ার হতে থাকে। এসব পোস্টে দাবি করা হয়, একটি বাড়িতে একবার আগুন লেগেছিল,, সেই আগুনে পুরো ঘর পুড়ে ছাই হয়ে গেলেও পুরে যায়নি গীতা টি🥰

৪ঠা এপ্রিল সকাল ৬টা ১০ মিনিটে বঙ্গবাজারে আগুনের সূত্রপাত হয়। এই পটভূমিকায় ৫ই এপ্রিল থেকে বঙ্গবাজারে ‘অক্ষত শ্রীমদ্ভগবতগীতা’ উদ্ধারের খবরটি পুরনো ছবিসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হতে দেখা যায়।

এছাড়া এসব পোস্টে উক্ত গীতা বা কোরআন শরীফ ছাড়া ‘সবকিছু পুড়ে ছাই’ হয়ে যাওয়ার দাবি করছেন অনেকে। তবে আক্ষরিক অর্থে এমনটা ঘটেনি। বরং কমপক্ষে ২৫টি ট্রাকে করে অক্ষত মালামাল সরিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়েছিল বলে সংবাদমাধ্যম থেকে জানা যাচ্ছে। এছাড়া ধ্বংসস্তুপে প্রচুর আধপোড়া কাপড় রয়েছে, সেসব থেকে ব্যবসায়ীরা ব্যবহারযোগ্য কাপড় খোজার চেষ্টা করছেন। বিদ্যানন্দ ফাউন্দেশন এর মত কিছু দাতব্য সংগঠন  দাতব্য কাজের অংশ হিসেবে এসব আধপোড়া কাপড় কিনে নেওয়ার আহবান জানাচ্ছে । তাদের ফেসবুক পেজের ছবিগুলো থেকে বোঝা যাচ্ছে, ‘সবকিছু পুড়ে ছাই’ হয়নি, বরং উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কাপড়চোপড় অদগ্ধ অবস্থায় রয়েছে।

সারমর্ম

বঙ্গবাজারের আলোচিত অগ্নিকাণ্ডের পরে কোরআন শরীফ এবং শ্রীমদ্ভগবতগীতা’র দুইটি কপি অক্ষত অবস্থায় উদ্ধারের গুজব ভাইরাল হয়েছে। এই দুইটি গ্রন্থের সাথে ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে অনেকে একে ‘অলৌকিক ঘটনা’ হিসেবে দাবি করছেন। তবে অনুসন্ধানে দেখা যায়, বঙ্গবাজারে এই দুইটা বইয়ের কোনোটাই উদ্ধার হয়নি। গীতার ছবিটা ফেসবুকে পূর্ব থেকেই পাওয়া যাচ্ছিল । কোরআন দাবিতে একটি বই উদ্ধার হয়েছিল ঠিকই, তবে সেটি কোরআন শরীফ ছিল না, বরং সেটি আরবি ভাষায় রচিত একটি হাদিসের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ছিল। উদ্ধারকারীরা তাৎক্ষণিকভাবে একে কোরআন শরীফ ভাবলেও বিশেষজ্ঞরা একে বুখারী শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন ।

সার্বিক বিবেচনায় ফ্যাক্টওয়াচ এই দাবিগুলোকে ‘মিথ্যা’ সাব্যস্ত করেছে।

আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন?
কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন?
নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?

এসবের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে জানান।
আমাদেরকে ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh