ধর্মীয় পদ্ধতিতে গরু জবাই করলে গরু কি ব্যথা পায় না ?

Published on: June 29, 2023

ইসলামিক পদ্ধতিতে গরু জবাইয়ের সময় প্রাণিটা কোনো ব্যথা অনুভব করে না- এমন একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। দাবি করা হচ্ছে, জার্মানির হ্যানোভার বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন গবেষক গরুর উপরে করা একটি পরীক্ষার মাধ্যমে এই ফলাফলটি পেয়েছেন। অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, ১৯৭৮ সালের এই পরীক্ষায় মূলত ইহুদিদের প্রচলিত ধর্মীয় পদ্ধতিতে পশু জবাই এবং জার্মানিতে ক্যাপ্টিভ বোল্ট এর মাধ্যমে পশুর জীবানাবসান এর তুলনা করা হয়েছে। এই গবেষণায় কোনো প্রাপ্তবয়স্ক গরু ব্যবহার করা হয়নি বরং কিছু ভেড়া এবং বাছুর ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়া, এখানে EEG মেশিনের ডাটা ব্যবহার করে পশুর ব্যথা পরিমাপের যে দাবি করা হয়েছে, তার সাথে পরবর্তী সময়ের গবেষকরা দ্বিমত পোষণ করেছেন। ফ্যাক্টওয়াচ সঙ্গত কারণে এই দাবিকে বিভ্রান্তিকর সাব্যস্ত করছে।

গুজবের উৎস

কয়েকটি পোস্ট দেখুন এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে

এসব পোস্টে বলা হচ্ছে,

ইসলামিক পদ্ধতিতে গরু জবাইয়ের সময় গরু ব্যাথা অনুভব করে কি না এ নিয়ে একটা পরীক্ষা করা হয়েছিল।। গরু

জবাইয়ের সময়ে EEG পরীক্ষা করে গরুর মস্তিষ্ক এবং ECG করে গরুর হার্ট দেখা হয়।

পরীক্ষায় দেখা যায়,

*জবাইয়ের প্রথম ৩সেকেন্ডে EEG গ্রাফে কোনো পরিবর্তন দেখা যায় না, অর্থাৎ গরু কোনো ব্যাথা পায় না।

*পরের ৩ সেকেন্ডের EEG রেকর্ডে দেখা যায়, গরু গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকার মতো অচেতন হয়ে থাকে,শরীর হতে প্রচুর রক্ত বের হয়ে যাওয়ায় ব্রেইনে রক্ত সরবরাহ হয় না বলে এই অচেতন অবস্থা হয়।

*এই  প্রথম ৬ সেকেন্ড পরে EEG গ্রাফে Zero level দেখাচ্ছিলো, তার মানে গরু কোনো ব্যাথা পাচ্ছিলো না।

*গরুর যে খিচুনি আমরা দেখি সেটা Spinal cord এর একটি Reflex Reaction, এটা মোটেও ব্যাথার জন্য হয় না।

(এই পরীক্ষাটি করেন জার্মানির হ্যানোভার বিশ্ববিদ্যালয়ের

প্রফেসর শুলজ এবং ডক্টর হাজিম।)


অনুসন্ধান

জার্মানির হ্যানোভার বিশ্ববিদ্যালয় এর প্রফেসর উইলহেলম শুলজ এর এ সম্পর্কিত একটি গবেষণাপত্র খুজে পাওয়া গেল। এটি ১৯৭৮ সালে Dtsch Tierarztl Wochenschr জার্নালের ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় (ভলিউম ৮৫, পৃষ্ঠা ৬২-৬৬) প্রকাশিত হয়েছিল। জার্মান ভাষায় প্রকাশিত  গবেষণাপত্রের ইংরেজি শিরোনাম ছিল- Objectivization of pain and consciousness in the conventional (dart-gun anesthesia) as well as in ritual (kosher incision) slaughter of sheep and calf

১৯৭৮ সালে প্রকাশের পর আজ পর্যন্ত এই পেপার এর সাইটেশন মাত্র ৩ । অর্থাৎ ৩ জন গবেষক তাদের গবেষণায় উইলহেলম শুলজ এর এই গবেষণাকে উদ্ধৃত করেছেন ।

এবং Dtsch Tierarztl Wochenschr জার্নালের ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর মাত্র ০.৫১২ । অর্থাৎ , এই গবেষণাপত্রের গ্রহণযোগ্যতা খুব বেশি নয়।

গবেষণাপত্রটির ইংরেজি ভাষান্তর পাওয়া যাবে এখানে

জার্মানির Animal Welfare Act এর 4(a) ধারা অনুযায়ী, উষ্ণ রক্তবিশিষ্ট সকল প্রাণীকেই হত্যা করার পূর্বে অজ্ঞান করে নিতে হবে। তবে ধর্মীয় কারণে যেসব পশু হত্যা করা হয়, তাদের ক্ষেত্রে এই আইন শিথিলযোগ্য এবং সেক্ষেত্রে পশুকে অজ্ঞান না করেও জবাই করা যাবে।

ইউরোপের ২১টা দেশের মধ্যে ২০১৮ সালে চালানো একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, ৫ টি দেশে ( সুইডেন, দেনমার্ক, আইসল্যান্ড, স্লোভেনিয়া , নরওয়ে তে ) কোনো অবস্থাতেই অজ্ঞান না করে জবাই করার অনুমতি নেই। বাকি দেশগুলিতে ধর্মীয় কারণে এভাবে জবাই করার অনুমতি আছে।

সাধারণত, একটি ক্যাপটিভ বোল্ট পিস্তল দিয়ে পশুর কপালে খুব কাছ থেকে আঘাত করার মাধ্যমে তার জীবনাবসান করে  তারপরে তার শরীর কাটাকাটি করা হয়। একেই Captive Bolt stunning System বলে।

আমাদের আলোচ্য গবেষণাপত্রে captive bolt stunning এবং ইহুদি ধর্মে প্রচলিত ritual cut এর তুলনা করা হয়েছে। মোট ২৭টা পশুকে (১৭ টা ভেড়া ও ১০ টা বাছুর) ধর্মীয় পদ্ধতিতে এবং ১১ টা পশুকে (৬ টা ভেড়া ও ৫ টা বাছুর)কে ইলেক্ট্রিক শক দিয়ে এবং পরে রক্তপাত করিয়ে জীবনাবসান করা হয়।  এক নজরে এই দুই পদ্ধতির তুলনা দেখে নেয়া যাক এখানে-

এখান থেকে দেখা যাচ্ছে, ক্যাপটিভ বোল্ট দিয়ে আঘাতের ২৮ সেকেন্ড পর পশুটির ই ই জি রেখা শূন্য হয়ে যাচ্ছে (অর্থাৎ সে মারা যাচ্ছে)। অন্যদিকে ধর্মীয় পদ্ধতিতে জবাই করার ১৩ থেকে ২৩ সেকেন্ড পর পশুটি মারা যাচ্ছে। ( অর্থাৎ ধর্মীয় পদ্ধতিতে জবাই করলে পশুটি দ্রুত মারা যাচ্ছে)

ক্যাপ্টিভ বোল্ট দিয়ে আঘাত করার পর পশুর মস্তিষ্কে ১ থেকে ২ হার্জ কম্পাঙ্কের আলোড়ন দেখা যায় , যেখানে ধর্মীয় পদ্ধতিতে জবাই এর ক্ষেত্রে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা সম্ভব হয়নি ( A clear reaction to the cut could not be detected in any animal )

এই তথ্য প্রমাণ থেকেই এই গবেষণাপত্রে দাবি করা হচ্ছে, সরাসরি ধর্মীয় পদ্ধতির ( যদি সঠিকভাবে পালন করা হয়)  মাধ্যমে পশু জবাই করা হলে, EEG গ্রাফ অনুসারে এবং রক্ষণাত্মক প্রতিক্রিয়ার অনুপস্থিতি দেখে বলা যায় সেটি ভেড়া ও বাছুরের ক্ষেত্রে ব্যথাহীন।  (The slaughter in the form of ritual cut is, if carried out properly, painless in sheep and calves according to the EEG recordings and the missing defensive actions.)

আলোচ্য গবেষণাপত্রের সাথে ফেসবুক পোস্টের অসংগতি

১। ফেসবুক পোস্টে দাবি করা হয়েছে, ইসলামিক পদ্ধতিতে গরু জবাইয়ের সময় গরু ব্যাথা অনুভব করে কি না এ নিয়ে একটা পরীক্ষা করা হয়েছিল।।

তবে গবেষণাপত্র থেকে দেখা যাচ্ছে, এখানে ইসলামিক পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা করা হয়নি, বরং ইহুদিদের পশু জবাইয়ের প্রচলিত পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা করা হয়েছে (যার সাথে ইসলামিক রীতির মিল আছে)

২। ফেসবুক পোস্টে গরুর গবেষণার কথা দাবি করা হলেও আলোচ্য গবেষণায় ২৩টা ভেড়া এবং ১৫টি বাছুর ছিল । অর্থাৎ, ছোট আকৃতির পশু নিয়ে জার্মানির এই গবেষকদল গবেষণা করেছিলেন। পূর্ণবয়স্ক গরুর মত বড় আকৃতির কোনো পশু নিয়ে তারা গবেষণা করেন নি।

৩। জবাইয়ের পর ৩ সেকেন্ড এবং ৬ সেকেন্ড এর বিভিন্ন হিসাব ফেসবুক পোস্টে জানানো হলেও মূল গবেষণাপত্রে এমন কোনো হিসাব বা গ্রাফ দেখা যায়নি। বরং ভেড়া এবং বাছুরের বিভিন্ন প্রযুক্তিতে হত্যা করার ক্ষেত্রে আলাদা প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছে তাদের মধ্যে এবং এদের সময়কালও ভিন্ন ভিন্ন ছিল।

নতুন গবেষণা

২০০৯ সালে New Zealand Veterinary Journal, Volume 57, Issue 2 এ প্রকাশিত A re-evaluation of the need to stun calves prior to slaughter by ventral-neck incision : An introductory review শীর্ষক গবেষণাপত্র থেকে জানা যাচ্ছে , ধর্মীয় রীতি মেনে পশু জবাই করলে পশু ব্যথা অনুভব করে। এই রিভিউ গবেষণাপত্রে প্রকৃতপক্ষে একগুচ্ছ অন্যান্য গবেষণাপত্রের পরীক্ষালব্ধ ফল ব্যবহার করা হয়েছে। এই সবগুলো গবেষণাপত্রই প্রকাশিত হয়েছে নিউজিল্যান্ড ভেটেরেনারি জার্নাল এর উক্ত সংখ্যায়। এসব গবেষণাপত্রের সাইটেশন ৩০ থেকে ৪০ । উল্লেখ্য, নিউজিল্যান্ড ভেটেরেনারি জার্নাল এর ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর ১.৪৭ , যা জার্মানির Dtsch Tierarztl Wochenschr থেকে তুলনামূলকভাবে ভাল।

এসব পরীক্ষায় কমপক্ষে ১৭টি বাছুর এবং ১০ টি ষাড় ব্যবহার করা হয়, যাদের মধ্যে সর্বোচ্চ ওজন ছিল ২০২ কেজি। ব্যথা নিরুপণের জন্য ইইজি ছাড়াও ইসিজি, রক্তচাপ, হৃদকম্প, রক্তপ্রবাহ সব বিভিন্ন একক পরিমাপ করা হয়েছে এসব পরীক্ষায়।  ই ই জি রেখাচিত্রের মধ্যে F50 অর্থাৎ Median frequency , F95 ( 95% Spectral edge frequency) এবং ptot (Total power of the electroencephalogram) কে পরিমাপ করা হয়েছে।

TJ Gibson এবং তাঁর দলের গবেষণালব্ধ ফলাফল থেকে এখানে দাবি করা হচ্ছে, ধর্মীয় পদ্ধতি মেনে পশু জবাই করলে তারা অচেতন হওয়ার আগ পর্যন্ত ব্যথা অনুভব করে, যা ৬০ সেকেন্ড পর্যন্ত দীর্ঘ হতে পারে।জবাই করার আগের এবং পরের ই ই জি গ্রাফ থেকে এই সিদ্ধান্তে পৌছেছেন তারা ।


এই গ্রাফে 0 তম সেকেন্ড হল যে মুহুর্তে জবাই কার্যকর করা হচ্ছে। ০ এর আগের সেকেন্ডগুলোয় দেখা যাচ্ছে, পশুর মস্তিষ্কের তরঙ্গ প্রায় সমান, কিন্তু ০ এর পরের সেকেন্ডগুলোতে তরঙ্গগুলোর ওঠানামা অনেক বেশি , এবং ঠিক ০ তম সেকেন্ডে বা তার একটু পরে ( অর্থাৎ জবাই এর পর পর) তরঙ্গের মান এত বেশি হয় যে সেটা গ্রাফে প্লট করা সম্ভব হয়নি। গবেষকরা এই সময়টাকে অসহনীয় ব্যথা হিসেবে অভিহিত করছেন।

কিন্তু ক্যাপ্টিভ বোল্ট পদ্ধতি প্রয়োগ করা হলে প্রয়োগের কয়েক সেকেন্ড পরেই পশুদের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যায় হয়ে যায় এবং ইইজি গ্রাফে মস্তিষ্কের কার্যক্রম খুব কম দেখা যায় (অর্থাৎ তারা ব্যথা অনুভব করে না বলে ধরা যায়) ।

এই গ্রাফ থেকে দেখা যাচ্ছে, স্টানিং এর আগে তাদের মস্তিষ্কের তরঙ্গ ১০০ একক এর আশেপাশে ছিল (যা আগের পরীক্ষার পশুদের ক্ষেত্রেও দেখা গিয়েছে)। স্টানিং এর পর এই মান কখনোই বাড়েনি, বরং ধীরে ধীরে কমেছে। প্রথম স্যাম্পল (a) এর ক্ষেত্রে এই মান ২০ এর কাছাকাছি ছিল এবং তেমন ওঠানামা করেনি। দ্বিতীয় পরীক্ষায় (b) এই মান ৬০ থেকে ৮০ এর কাছাকাছি ছিল । a এবং b , কোনো ক্ষেত্রেই এই মান স্টানিং এর পূর্বের মানের চেয়ে উপরে ওঠেনি , যেমনটা উঠেছিল জবাই এর ক্ষেত্রে ।

TJ Gibson এর নেতৃত্বে নতুন একটি পরীক্ষায় গবেষকদল ধর্মীয় পদ্ধতিতে জবাই করার ৫ সেকেন্ডের মধ্যেই আবার স্টানিক বোল্ট ব্যবহার করা হয়েছে, এবং দেখা গিয়েছে পশুদের মস্তিষ্কে কোনো ব্যথার প্রতিক্রিয়া তৈরি হওয়ার আগেই তারা অচেতন হয়ে যাচ্ছে।

অন্যান্য ফ্যাক্টচেকারদের প্রতিক্রিয়া

২০২১ সালে প্রকাশিত ইসলামিক পদ্ধতিতে জবাইতে পশু ব্যথা অনুভব করে না — এই ভাইরাল পোস্টের সত্যতা কতটুকু?  শীর্ষক নিবন্ধে যাচাই ডট কম জানাচ্ছে, এই দাবিটা বিমিশ্রিত

বিজ্ঞানভিত্তিক জনপ্রিয় গ্রুপ সায়েন্স বি এবং ব্যাঙের ছাতার বিজ্ঞান থেকে ফেসবুক ব্যবহারকারীদের সচেতন করা হচ্ছে। তারা জানাচ্ছে, ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া এই পোস্টটি একটি গুজব।



ফ্যাক্টওয়াচের সিদ্ধান্ত

জবাই এর সময় পশু কতটুকু ব্যথা পায়, এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। এর সাথে ধর্মীয় ও নৈতিক ইস্যু যুক্ত হওয়ায় বিতর্কে বিভিন্ন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। পশু জবাইয়ের বিভিন্ন পদ্ধতির পক্ষে এবং বিপক্ষেও বিভিন্ন পক্ষের বিশেষজ্ঞরা মতামত দিচ্ছেন। এ বিষয় নিয়ে এখন পর্যন্ত যা যা গবেষণা হয়েছে, তার আলোকে ফ্যাক্টওয়াচের পক্ষে কোনো একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতিকে নিশ্চিতভাবে ‘ব্যথামুক্ত’ বলে রায় দেওয়া সম্ভব নয়।

তবে  ‘ইসলামিক পদ্ধতিতে গরু জবাই করলে গরু ব্যথা পায়না’ -এমন দাবিতে  ফেসবুকে যে পোস্ট ভাইরাল হয়েছে, তাতে বিভিন্ন অসংগতি দেখা যাচ্ছে। তাই ফ্যাক্টওয়াচ এই পোস্টগুলোকে ‘বিভ্রান্তিকর’ সাব্যস্ত করছে।

এই নিবন্ধটি ফেসবুকের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রামের নীতি মেনে লেখা হয়েছে।।
এর উপর ভিত্তি করে ফেসবুক যে ধরণের বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এখানে
এছাড়া এই নিবন্ধ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন, সম্পাদনা কিংবা আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার জন্য আবেদন করতে এই লিঙ্কের সাহায্য নিন।

কোনো তথ্যের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকেঃ
ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh