মায়ের কবরে ক্রন্দনরত শিশুটি ইরাকি, ফিলিস্তিনি নয়

Published on: December 17, 2023

সম্প্রতি হামাস এবং ইসরায়েলের সংঘাতকে কেন্দ্র করে সামাজিক মাধ্যমে একটি ভিডিও বেশ ভাইরাল হয়েছে। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে একটি মেয়ে কবরের উপর মাথা রেখে কাঁদছে। ভিডিওটির ক্যাপশন এমন ধারণা দেয় যেন মেয়েটি একজন ফিলিস্তিনি এবং যুদ্ধে সে তাঁর মাকে হারিয়েছে। তবে অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, উক্ত ভিডিওটি সাম্প্রতিক সময়ের নয়। বরং ভিডিওতে যে মেয়েটি কবরের উপর মাথা রেখে কান্না করছিলো তাঁর নাম ফাতিমা সালাম শালান আল-মৌছাওয়ী (Fatima Salam Shaalan Al-Moussawi) এবং সে একজন ইরাকি। ২০২০ সালের আগস্ট মাসে তাঁর মা করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যান এবং তাঁকে ইরাকের নাজাফ (Najaf) শহরে অবস্থিত ‘ভ্যালি অব নাজাফ’ নামক সমাধিক্ষেত্রে সমাধিস্থ করা হয়। আলোচিত ভিডিওটি সেই সমাধিক্ষেত্র থেকে ধারণ করা হয়েছিল। ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন তথ্যপ্রমাণের উপর ভিত্তি করে বিষয়গুলো নিশ্চিত হওয়া গেছে। তাই সঙ্গত কারণে ফ্যাক্টওয়াচ সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত ভিডিওটির দাবিকে “বিভ্রান্তিকর” বলে সাব্যস্ত করছে। 

এমন কয়েকটি ভিডিওর নমুনা দেখুন এখানে, এখানে, এবং এখানে

 

ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধান:

সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত ভিডিওটিতে দৃশ্যমান কবরের উপর কান্নারত মেয়েটি একজন ফিলিস্তিনি কিনা তা যাচাই করতে আমরা উক্ত ভিডিও থেকে কিছু স্ক্রিনশট নিয়ে রিভার্স ইমেজ সার্চ পদ্ধতিতে অনুসন্ধান করি। আমাদের অনুসন্ধানে ‘Raed Al-Mohammadawi Media’ নামক একটি ইউটিউব চ্যানেলে গত ১২ অক্টোবর ২০২০ এ প্রকাশিত দুটো ভিডিও খুঁজে পাওয়া গেছে ভিডিওগুলোর মাঝে একটি ভিডিওর সাথে সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত ভিডিওটির বেশ মিল লক্ষ্য করা গেছে। উক্ত ভিডিওর শিরোনাম থেকে জানা গেছে, মেয়েটির নাম ফাতিমা সালাম শালান আল-মৌছাওয়ী। 

‘Raed Al-Mohammadawi Media’ নামক ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশিত অপর ভিডিওটিতে দেখা যাচ্ছে, দুটো শিশু (একজন মেয়ে এবং অন্যজন ছেলে) এবং একজন যুবক একটি সমাধিক্ষেত্রের ভিতর দিয়ে কিছুক্ষণ হেঁটে একটি সমাধির কাছে এসে উপস্থিত হয়েছেন। হলুদ রঙের কাগজের ফুল দিয়ে তাঁদেরকে সমাধিটি চিহ্নিত করতে দেখা যায়। সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত ভিডিওটিতে দৃশ্যমান মেয়েটিই এই ভিডিওর মেয়েটি কিনা তা যাচাই করার জন্য আমরা সমাধিটির পারিপার্শ্বিক পরিবেশ নিবিড়ভাবে খুঁটিয়ে দেখেছি। দুটো ভিডিও ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ধারণ করা হলেও সমাধির আশেপাশে যে স্থাপনা এবং সমাধিফলক রয়েছে – সেগুলো দেখে নিশ্চিত হওয়া গেছে দুটো ভিডিও একই সময় এবং স্থানে ধারণ করা হয়েছিল। 

তাছাড়া, উক্ত ভিডিওটির ৪৪ সেকেন্ডে গিয়ে একটি ইরাকি পতাকাও আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। 

এরপর আমরা এই ভিডিওটির বিস্তারিত বর্ণনা অংশ পড়ে দেখেছি এবং জানতে পেরেছি যে, ভিডিওতে যে মেয়েটিকে দেখা যাচ্ছে তাঁর নাম ফাতিমা সালাম শালান আল-মৌছাওয়ী। সে ইরাকের নাজাফ শহরে বাস করে। ২০২০ সালের আগস্ট মাসের আট তারিখে তাঁর মা করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে নাজাফ শহরের একটি হাসপাতালে মারা যান। ভিডিওটিতে ফাতিমাকে তাঁর মায়ের কবরের উপর কাঁদতে দেখা যায়। তাঁর মাকে ‘ভ্যালি অব নাজাফ’ নামক ইরাকের একটি সমাধিক্ষেত্রে সমাধিস্থ করা হয়েছিল। 

ভিডিওটি ফাতিমা সালাম শালানের তাঁর মায়ের সমাধি পরিদর্শন করতে যাওয়ার সময় ধারণ করা হয়েছিল কিনা তা নিশ্চিত হতে আমরা ‘ভ্যালি অব নাজাফ’ সম্পর্কে অনুসন্ধান করি। ভ্যালি অব নাজাফ, যা ভ্যালি অব পিস (ওয়াদি আল-সালাম) নামেও পরিচিত, পৃথিবীর একটি সর্ববৃহৎ এবং প্রাচীন সমাধিক্ষেত্র। ইরাকে শিয়াদের পবিত্র শহর নাজাফে এটি অবস্থিত। গেটি ইমেজেস নামক ইন্টারনেট ফটো লাইব্রেরি থেকে প্রাপ্ত ইরাকের ভ্যালি অব পিসের এই ছবিটির বর্ণনা অংশ থেকে জানা গেছে, ভ্যালি অব পিসে কিছু সমাধি রয়েছে যেগুলো সাধারণ ঘর, চতুর্ভুজাকৃতির ছাদের উপর স্থিত গম্বুজ, বা মিনিয়েচার মসজিদের আদলে সাজানো হয়েছে। ইউটিউব থেকে প্রাপ্ত ভিডিওতে আমরা যে সমাধিক্ষেত্রটি দেখেছি সেখানেও কিছু গম্বুজ বা ছোট মসজিদের আদলে তৈরি করা সমাধি লক্ষ্য করা গেছে। তাছাড়া, ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত ভ্যালি অব নাজাফের বিভিন্ন ছবির সাথে এই ইউটিউব ভিডিওটিতে দৃশ্যমান সমাধিক্ষেত্রটির পারিপার্শ্বিক অবস্থা, যেমন: সমাধিফলক, গম্বুজ, ছোট ঘর, প্রভৃতির মিল পাওয়া গেছে। অর্থাৎ, ফাতিমা সালাম শালানের ভিডিওটি ভ্যালি অব নাজাফেই ধারণ করা হয়েছিল। ইরাকের ভ্যালি অব নাজাফের কিছু ছবি দেখুন এখানে, এখানে, এবং এখানে। 

Aerial view of Iraq’s Valley of Peace/Photo credit: AFP.

উল্লেখ্য, গত সেপ্টেম্বর ২০২৩ এ লিবিয়ায় বন্যা হওয়ার পর মায়ের কবরের উপর মাথা রেখে কান্নারত মেয়েটির ভিডিও শেয়ার করে দাবি করা হয়েছিল যে, তাঁর মা বন্যার কবলে পড়ে মারা গেছে। তবে ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩ এ আল-আরাবিয়া কর্তৃক প্রকাশিত “Her tears filled the grave.. A video of a little girl crying for her mother in Libya confuses communication!” –  শিরোনাম সংবলিত প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, ভিডিওটিতে যে মেয়েটিকে দেখা যাচ্ছে তাঁর সাথে লিবিয়ার বন্যার কোন সম্পর্ক নেই। সে একজন ইরাকি এবং তাঁর মা ২০২০ সালে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। 

অতএব, উপরের আলোচনা থেকে এই বিষয়টি স্পষ্ট যে, সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত ভিডিওটি ফিলিস্তিন কিংবা সাম্প্রতিক সময়ের নয়। বরং সেটা ইরাকের নাজাফ শহরে অবস্থিত একটি সমাধিক্ষেত্র থেকে ২০২০ সালে ধারণ করা হয়েছিল।

সুতরাং, সবকিছু বিবেচনা করে ফ্যাক্টওয়াচ সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত ভিডিওটির দাবিকে “বিভ্রান্তিকর” বলে সাব্যস্ত করছে।

এই নিবন্ধটি ফেসবুকের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রামের নীতি মেনে লেখা হয়েছে।।
এর উপর ভিত্তি করে ফেসবুক যে ধরণের বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এখানে
এছাড়া এই নিবন্ধ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন, সম্পাদনা কিংবা আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার জন্য আবেদন করতে এই লিঙ্কের সাহায্য নিন।

কোনো তথ্যের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকেঃ
ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh