৩ দিনের জন্য অন্ধকারে ডুবে যাবে গোটা পৃথিবী- অবৈজ্ঞানিক ও মিথ্যা দাবি

Published on: June 25, 2021

৩ দিনের জন্য কালো অন্ধকারে ডুবে যাবে গোটা পৃথিবী- এমন শিরোনামে একটি খবর ফেসবুকের বিভিন্ন জায়গায় শেয়ার করতে দেখা যাচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে , এমন ভবিষ্যদ্বাণী কোনো আবহাওয়াবিদ বা জ্যোতির্বিদ করেননি। কেবলমাত্র একজন টিকটক ইউজার (timetraveler2582) নিজের একাউন্টে এমন দাবি করেছেন। নিজেকে তিনি ভবিষ্যত থেকে আসা টাইম ট্রাভেলার বলে দাবি করছেন। তার দাবির সপক্ষে কোনো প্রমাণও তিনি দেখাতে পারেননি। ফ্যাক্ট ওয়াচের অনুসন্ধানে টাইম ট্রাভেলের সপক্ষে কোনো ধরনের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। অতীতে বিভিন্ন সময়ে অনেকেই টাইম ট্রাভেলিং এর দাবি করেছেন কিন্তু তারা সবাই ‘ভণ্ড’ হিসেবে প্রমাণিত হয়েছেন। তাছাড়া,timetraveler2582 টিকটকে আরো কিছু ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যেগুলো ইতোমধ্যে মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। কাজেই, এই দাবিরও সত্য হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই বলে ফ্যাক্টওয়াচ মনে করে।

উৎস

সোশ্যাল মিডিয়া মনিটরিং সাইট থেকে দেখা গেল, গত ৩০ দিনে এই খবরটা ৩০০ বার শেয়ার করা হয়েছে এবং প্রায় ২ লাখ ইন্টার‍্যাকশন হয়েছে।

এমন কয়েকটি নিউজ দেখতে পাবেন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে।



খবরের বিস্তারিত বিবরণে ওয়েব পোর্টালগুলো বলেছে,

একজন টাইম ট্রাভেলার দাবি করেছেন ২০২৬ সালে টানা তিন দিনের জন্য গোটা পৃথিবী কালো অন্ধকারে ডুবে যাবেতিন দিনের জন্য সম্পূর্ণ গাঢ় অন্ধকারে ঢুকে যাবে গোটা পৃথিবী। পৃথিবীতে করোনাভাইরাস এর প্রভাব ইতিমধ্যেই বড় ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে আবার একজন টাইম ট্রাভেলার দাবি করলেন পৃথিবী নাকি তিনদিন সম্পূর্ণ অন্ধকারে ডুবে যাবে।

বিভিন্ন মানুষ বিশ্বে নিজেকে টাইম ট্রাভেলের হিসেবে দাবি করে থাকেন এবং সম্প্রতি একজন টিকটক ব্যবহারকারী নিজেকে টাইম ট্রাভেলার হিসেবে দাবি করে বললেন তিনি নাকি ২৫৮২ সাল পর্যন্ত ঘুরে এসেছেন। সেই টাইম ট্রাভেলের এর বক্তব্য, আগামী চার বছর বাদে একটা সময় আসবে যখন তিনদিন সারাবিশ্ব কালো অন্ধকারে ডুবে যাবে।

টিকটকে @timetraveler2582 নামের এই ব্যবহারকারী নিজেকে টাইম ট্রাভেলার হিসেবে দাবি করছে তিনি বলছেন, আগামী ২৫৮২ পর্যন্ত পৃথিবীতে যাই হচ্ছে না কেন সব তিনি জানেন। সেই টাইম ট্রাভেলের দাবি করেছে ৬ জুন ২০২৬ সালে পুরো পৃথিবী কালো অন্ধকারে ডুবে যাবে। একটা ফোটা আলোর কণা দেখা যাবে না পৃথিবীতে। ইতিমধ্যেই বহু মানুষ এরকম দাবি করে থাকেন।

তিনি আরো দাবি করেছেন আগামী বছর পাঁচেকের মধ্যে পৃথিবী পাল্টে যাবে। কিন্তু ৬ জুন ২০২৬ থেকে টানা তিন দিনের জন্য পৃথিবী এমন একটা পরিস্থিতিতে থাকবে যেখানে কোন আলোর কণা দেখা যাবে না। শুধুমাত্র ব্যবহার করা যাবে মোমবাতি।

নেটিজেনদের প্রশ্ন কেন হবে এটা? কেন আলো জালানো যাবে না?

কিন্তু এরকম কোন প্রশ্নের উত্তর সেই টাইম ট্রাভেলার দিতে পারছে না। আপাতত নেটিজেনদের চোখে এই বিষয়টি একেবারেই ভুল। ভবিষ্যদ্বাণী করে দিয়ে সেই টাইম ট্রাভেলার আবার হয়তো টাইম ট্রাভেল করতে বেরিয়ে গেছে। কিন্তু, বিজ্ঞানীরাও এরকম কোনো সদুত্তর দিতে পারছেন না।

বোঝা যাচ্ছে, ক্লিকবেইট শিরোনাম। মূল খবরের সাথে মিল নেই শিরোনামের। শিরোনামেই যদি একজন টিকটক ইউজারের দাবির কথাটা বলা হত, তাহলে বিষয়টা অধিক পরিষ্কার হত।

টিকটকে টাইম ট্রাভেলার ২৫৮২ এর মূল একাউন্ট এর সন্ধান পায় ফ্যাক্টওয়াচ। একাউন্টে এর মালিকের নিজের কোনো নাম ,পরিচয়, বয়স বা অবস্থান সম্পর্কে কোনো তথ্য নাই। কিন্তু একাউন্টে প্রায় শতাধিক ভিডিও আপলোড করা আছে। প্রতিটা ভিডিওতে কোনো না কোনো মুভির কোনো অংশের সাথে কয়েকটা বাক্য জুড়ে দেওয়া হয়।

ফ্যাক্ট ওয়াচ টিম এর প্রতিটা ভিডিও ই দেখেছে। কিন্তু আলোচিত ভিডিওটি খুজে পাওয়া গেল না। সম্ভবত ব্যবহারকারী এটা ডিলিট করে ফেলেছেন।

তবে অন্য উৎস থেকে ভিডিওটি পাওয়া যাচ্ছে এখনো। যেমন- ডেইলি সান এর ওয়েবসাইটে এবং এই ইউটিউব চ্যানেলে ভিডিওটি এখনো দেখা যাচ্ছে।

ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে,একটি হলিউডের অ্যাকশন মুভির সাথে কিছু টাইটেল যোগ করে ভিডিওটি বানানো হয়েছে। টাইটেলে বলা হয়েছে, বিশ্বাস করুন বা নাই করুন, ২০২৬ সালের ৬ই জুন এই ঘটনাগুলো ঘটেছিল। সেদিন গ্রীনিচ মান সময় রাত ১২ টা থেকে পৃথিবী ৩ দিনের জন্য অন্ধকারে ঢেকে যাবে। তাদের দিকে তাকাবেন না। পিরামিডের উপরে কোথা থেকে আলো আসছে সেটা দেখার জন্য উপরে তাকাবেন না। মোমবাতি ছাড়া অন্য কোনো কৃত্রিম আলো ব্যবহার করবেন না। বিস্তারিত আমি পরে ব্যাখ্যা করব।  (Believe or not, this has indeed happened on the June 6, 2026. Starting at 00h00 UTC on the June 6, 2026, the Earth will enter into three days of darkness. Do not look at them. Do not look up in the sky at the light coming from the pyramids. Do not use any man-made lighting except candles . I will explain more in details. )

এখানে যে ভিডিও ব্যবহার করা হয়েছে, সেটা ২০১৭ সাল মুক্তি পাওয়া হলিউড ব্লকবাস্টার The Mist সিনেমার ফুটেজ

ছবি: টিকটকে টাইম ট্রাভেলার এর ভিডিও


ছবি: দি মিস্ট সিনেমার ট্রেইলার

কি আছে টাইম ট্রাভেলার এর টিকটক চ্যানেলে ?

ফ্যাক্ট ওয়াচ টিম এই কথিত টাইম ট্রাভেলার এর আপলোড করা সবগুলো ভিডিও দেখেছে এবং ভিডিওতে বর্ণনা করা ভবিষ্যদ্বাণীগুলো খতিয়ে দেখেছে।

গত মার্চ মাসে এই চ্যানেলটি শুরু হয়। চ্যানেল থেকে মাঝে মাঝে ভবিষ্যদ্বাণী সম্বলিত বিভিন্ন ভিডিও আপলোড করা হয়। প্রতিটা ভিডিওর ফরম্যাট একই। কোনো একটা এ্যাকশন ফিল্মের সাথে নিজের যোগ করা কিছু টাইটেল- এভাবেই প্রতিটা ভিডিও তৈরি হয়।

তার ভবিষ্যদ্বাণীর অনেকগুলা রয়েছে ২০২২, ২০২৩, ২০২৪ বা আরো পরের ঘটনা নিয়ে, যেগুলো এখন প্রমাণ করা যাচ্ছে না।

তবে ২০২১ এর মার্চ,এপ্রিল,মে ,জুন মাস নিয়েই তার চ্যানেলে কিছু ভবিষ্যদ্বাণী আছে, যেগুলো ইতিমধ্যে ভুল প্রমাণিত হয়েছে।

যেমন –

১লা মে ২০২১ এ শেয়ার করা এক ভিডিওতে তিনি বলেছিলেন , ৮ই মে ২০২১ তারিখে বিজ্ঞানীরা সৌরজগতের মধ্যেই পৃথিবীর মত একটি বাসযোগ্য গ্রহ খুজে পাবেন।

তবে তার এই ভবিষ্যদ্বাণী ফলেনি। মে মাস পার হয়ে গেলেও এখনো এমন কোনো গ্রহ খুজে পাওয়া যায়নি। তার ভবিষ্যদ্বাণী না মেলায় টাইম ট্রাভেলারকে অনেকে ট্রল করা শুরু করেন

১২ই এপ্রিল প্রকাশিত এই ভিডিওতে তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন , ২০২১ এর ৯ই জুন তারিখে বিজ্ঞানীরা ৩০ ফুট লম্বা এক প্রজাতির কুমির আবিষ্কার করবেন ।

তবে ৯ই জুন পার হয়ে যাওয়ার পরেও এমন কোনো খবর কোথাও পাওয়া যায়নি।

১৮ই এপ্রিল প্রকাশিত এই ভিডিওতে তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন , ১২ই মে ২০২১ তারিখে গিজার পিরামিড থেকে ৭ জনের একটা ডাকাতের দল অনেক মূল্যবান সামগ্রী চুরি করে নিয়ে যাবে।

মে মাস পার হয়ে গেলেও এমন কিছু ঘটেনি।

তার পুরা টিকটক একাউন্টই এমন অনেক ভবিষ্যদ্বাণী দিয়ে ভর্তি ।

তবে কোনোটার সপক্ষেই কোনো যুক্তি দেননি তিনি। ছোট ছোট বাক্যে সংক্ষেপে ভবিষ্যদ্বাণী করেই ভিডিও শেষ করে দিয়েছেন তিনি।

শুধু ভবিষ্যত নয়, তিনি অতীতে ভ্রমণ করেও (তার দাবি অনুযায়ী) অনেক বিস্ময়কর তথ্য নিয়ে আসেন। যেমন এক ভিডিওতে তিনি দাবি করেছেন, ডাইনোসরেরা পিরামিড তৈরি করেছে। তিনি নিজ চোখে তাদেরকে দেখেছেন পিরামিড বানাতে।

যদিও বিজ্ঞানীরা বলছেন, ডাইনোসররা ধ্বংস হয়ে গেছে ৬৬ মিলিয়ন বছর আগে। এবং মিশরের পিরামিড তৈরি হয়েছে ৫ হাজার বছর আগে।

টাইম ট্রাভেল কি করা সম্ভব ?

সিনেমা বা সায়েন্স ফিকশনে যেমন দেখানো হয়, অতীতের ট্রাভেলার ভবিষ্যতে চলে যাচ্ছে, বা ভবিষ্যতের ট্রাভেলার অতীতে ফিরে আসছে, সেভাবে টাইম ট্রাভেল সম্ভব নয়।

নাসার ওয়েবসাইটে টাইম ট্রাভেল নিয়ে বলেছে, দ্রুতগতির বিমানে বা রকেটে সময়কে ভিন্নভাবে কাটাতে দেখা যায়। এক সেকেন্ডে এক সেকেন্ড পার না হয়ে কম বেশি পার হতে পারে। তবে সিনেমায় যেভাবে দেখানো হয়,সেভাবে টাইম ট্রাভেল সম্ভব নয়।

উচ্চ মাধ্যমিক এর ছাত্র ছাত্রীরা পদার্থবিজ্ঞান এ ‘Time Dilation’ বিষয়ক বেশ কিছু গাণিতিক সমস্যা সমাধান করে থাকেন। কোনো এ্যাস্ট্রনট মহাশূন্যে ভ্রমণ করলে তার সময় পৃথিবীর সাপেক্ষে কিভাবে পরিবর্তিত হয়, সেই বিষয়ে প্রচুর গানিতিক সমস্যা সমাধান করা হয় সেখানে।

তবে এগুলাকে কোনোটাকেই টাইম ট্রাভেল বলা যায় না। পৃথিবী এবং রকেটের সময়ের পরিবর্তন হিসাব করা যায় এ সকল অঙ্ক থেকে ।

কিছু কিছু সায়েন্স ফিকশন লেখক দাবি করেন, রকেটের বেগ আলোর বেগের চেয়ে বেশি হলে ট্রাভেলার ভুবিষ্যতে চলে যেতে পারবেন।

তবে অতীতে কিভাবে যাওয়া যায়, সে উপায় কেউ বাতলে দিতে পারেন নি।

তবে বিশ্বের বিভিন্ন সময়ে অনেকে টাইম ট্রাভেলার বলে দাবি করেচনে নিজেকে। এবং এদের অধিকাংশই মিথ্যাবাদী হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। উইকিপিডিয়াতে ফেক টাইম ট্রাভেলারদের এমন একটা লিস্ট ও আছে।

অনেককে বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতার ও করা হয়েছে

এমনকি টিকটক প্লাটফর্মেও এমন টাইম ট্রাভেলার আগেও এসেছে। Javier নামের এক টিকটকার এর আগেও ভাইরাল হয়েছিল নিজেকে টাইম ট্রাভেলার বলে দাবি করে। তবে তার দাবির সপক্ষেও কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেনি।


সিদ্ধান্ত

টিকটক, ইউটিউব বা অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়াকে অনেকে বিভিন্ন উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেন। এখান থেকে যেহেতু অর্থ উপার্জন সম্ভব, সেকারনে অনেকে যে কোনো উপায়ে ভাইরাল হয়ে, বেশি ফলোয়ার সাবস্ক্রাইবার যোগাড় করতে চান। অন্য অনেকেও বিভিন্ন কারনে আলচোওনার কেন্দ্রে থাকার জন্য মিথ্যা/বিভ্রান্তিকর তথ্য ও কন্টেন্ট আপলোড করেন সোস্যাল মিডিয়ায়।

Timetraveler2582 এর টাইম ট্রাভেল এর সপক্ষে কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি। তার করা ভবিষ্যদ্বাণীগুলোর বেশ কয়েকটাই মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। কাজেই, পৃথিবী ৩ দিন অন্ধকারে ডুবে থাকবে — এই দাবিরও কোনো সত্য হয়ে উঠার কোনো সম্ভাবনা নেই।

আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন?
কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন?
নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?

এসবের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে জানান।
আমাদেরকে ইমেইল করুনঃ contact@fact-watch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ fb.com/search.ulab

 

 

 

 

 

Leave a Reply