ভিসা নিষেধাজ্ঞা পাওয়া বাংলাদেশি ব্যক্তিদের ভূয়া তালিকা

Published on: September 26, 2023

সম্প্রতি ফেসবুকে বাংলাদেশের ৩৫ জন নাগরিকের সাথে নাম উল্লেখ না করা আরও ২৫ জন সাবেক ও বর্তমান সেনা অফিসারের একটি তালিকা ভাইরাল হতে দেখা যাচ্ছে। দাবি করা হচ্ছে তাদের উপর যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে জানা যায়, আসন্ন গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ণ করার জন্য দায়ী বা জড়িত থাকা বাংলাদেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, ক্ষমতাসীন দল এবং বিরোধী দলের সদস্যদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র অধিদপ্তর এই ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগ করা শুরু করেছে। তবে, সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তির নাম তারা প্রকাশ করেনি কারণ, এক্ষেত্রে নাম প্রকাশ করাটা যুক্তরাষ্ট্রের আইন বহির্ভূত। অন্যদিকে, ফেসবুকে ৩৫ জন ব্যক্তির যে তালিকা দেখা যাচ্ছে তাদের মধ্যে সবাই ‘আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, ক্ষমতাসীন দল এবং বিরোধী দল’ এই তিন বিভাগের আওতাধীন সদস্য নয়। তাছাড়া, নির্ভরযোগ্য অন্য কোনো মাধ্যম থেকেও এই নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়া বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে সুনির্দিষ্টভাবে তাদের নাম পাওয়া যায়নি। সঙ্গত কারণে ফ্যাক্টওয়াচ ভাইরাল হওয়া ভিত্তিহীন পোস্টগুলোকে “মিথ্যা” হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

ভাইরাল পোস্টগুলোতে ভিসা নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত বাংলাদেশীদের আংশিক তালিকা দাবিতে যাদের নাম প্রকাশ করা হয়েছেঃ

সাবেক প্রধান বিচারপতি এ,বি,এম খায়রুল হক, মোজাম্মেলহক সাবেক প্রধান বিচারপতি, সৈয়দ মাহমুদ হোসেন-সাবেক প্রধান বিচারপতি, হাসান ফয়েজ ছিদ্দিকী- সাবেক প্রধান বিচারপতি, শামসুদ্দিন মানিক- বিচারপতি, এনায়েতুর রহিম- বিচারপতি, মোঃ খসরুজ্জামান- বিচারপতি, কাজী রকিব উদ্দিন- সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার, নুরুল হুদা – সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার, মোঃ হেলালুদ্দিন- নির্বাচন কমিশনের সাবেক সচিব, কবিতা খানম -সাবেক নির্বাচন কমিশনার, শাহাদাত হোসেন – সাবেক নির্বাচন কমিশনার, আবু হাফিজ- সাবেক নির্বাচন কমিশনার, আবদুল মোবারক- সাবেক নির্বাচন কমিশনার, মোঃ জাভেদ আলী- সাবেক নির্বাচন কমিশনার, মোঃ শাহনেওয়াজ – সাবেক নির্বাচন কমিশনার, কাজী হাবিবুল আওয়াল – বর্তমানে প্রধান নির্বাচন কমিশনার, মোঃ আলমগীর- নির্বাচন কমিশনার, মোঃ আনিছুর রহমান- নির্বাচন কমিশনার, বেগম রাশেদা সুলতানা – নির্বাচন কমিশনার, আহসান হাবিব খান- নির্বাচন কমিশনার, সজীব ওয়াজেদ জয়, সালমান এফ রহমান, আনিছুল হক, রওশন এরশাদ, কাজী ফিরোজ রশিদ, মশিউর রহমান রাংগা, ফখরুল ইমাম, হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেনন, মজিবুল হক চুন্নু, জেনারেল অবঃ তারেক সিদ্দিকী, মেজর জেনারেল যুবায়ের, মেজর জেনারেল হামিদুল হক, মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসানসহ সাবেক ও বর্তমান ২৫ জন সেনাঅফিসার।

ফেসবুকে ভাইরাল এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে  এবং এখানে

ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধান:

বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করার উদ্দেশ্যে গত ২৪ মে যুক্তরাষ্ট্র নতুন এক ভিসা নীতি ঘোষণা করেছিল। ভিসা নীতিতে উল্লেখ ছিল যে, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে সরাসরি বাধাগ্রস্ত করা বা এর সাথে জড়িত থাকা যে কোনো বাংলাদেশি ব্যক্তির যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা বাতিল হয়ে যাবে। এই ঘোষণার প্রায় চার মাসের মাথায় গত ২২ সেপ্টেম্বর ভিসাসংক্রান্ত এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে বলে এক প্রেস বিবৃতির মাধ্যমে নিশ্চিত করেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র অধিদপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার।

এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ফেসবুকে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি যাদের উপর কার্যকর করা হয়েছে তাদের আংশিক তালিকা দাবিতে বাংলাদেশের ৩৫ জন নাগরিকের নামের সাথে নাম উল্লেখ না করা আরও ২৫ জন সাবেক ও বর্তমান সেনা অফিসারের কথা বলা হয়েছে। এই তালিকায় বাংলাদেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, ক্ষমতাসীন দল, বিরোধী দল, বিচার বিভাগ, এবং নিরাপত্তা পরিষেবার সদস্য ছাড়াও বর্তমান এবং সাবেক বাংলাদেশী সরকারি কর্মকর্তার নাম দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু, বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের অফশিয়াল ওয়েবসাইটে গত ২২ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত ম্যাথিউ মিলারের প্রেস বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়,

” ডিপার্টমেন্ট অফ স্টেট বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ণ করার জন্য দায়ী বা জড়িত থাকা বাংলাদেশি ব্যক্তিদের উপর ভিসা বিধিনিষেধ প্রয়োগের পদক্ষেপ নিচ্ছে। এর মাঝে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, ক্ষমতাসীন দল এবং বিরোধী দলের সদস্যরা অন্তর্ভুক্ত আছেন।”

এই প্রেস বিবৃতি থেকে আরও জানা যায়, কেবলমাত্র এই তিন বিভাগের সদস্য ছাড়া আর কারও উপর এখন পর্যন্ত এই ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগের পদক্ষেপ নেয়া শুরু হয়নি। তবে, ভবিষ্যতেবাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ণ করার জন্য যে কেউ দায়ী বা জড়িত বলে প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধেও একই পদক্ষেপ গ্রহণ করা হতে পারে। বিচার বিভাগের সদস্য, নিরাপত্তা পরিষেবার সদস্য এবং সদস্যরাও এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন।

অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের যে সকল নাগরিকের উপর এই ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে তাদের কোনো নাম প্রকাশ করেছে কি না এ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য প্রাসঙ্গিক কিছু কী-ওয়ার্ড ধরে অনুসন্ধান করা হয়। অনুসন্ধানে ডেইলিস্টারের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে গত ২২ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত ডোনাল্ড লু’র একটি সাক্ষাৎকার খুঁজে পাওয়া যায়। সেখানে তিনি নিশ্চিত করেন যে, বাংলাদেশের উপর আরোপ করা যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতির অধীনে যারা নিষেধাজ্ঞা পেয়েছেন তাদের নাম যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ করবে না। ব্যক্তিগত ভিসা বাতিল সহ ভিসার রেকর্ড মার্কিন আইনের অধীনে গোপন রাখা হয়।

পরবর্তীতে, ইউএনবি নিউজের অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে গত ২৩ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়। সেখানে ইউএস দূতাবাসের মুখপাত্র ব্রায়ান শিলারের বরাত দিয়ে জানানো হয় যে, “যুক্তরাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী ভিসা সংক্রান্ত যাবতীয় রেকর্ড গোপন রাখা হয়।” যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র অধিদপ্তরের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট থেকেও এই একই তথ্য পাওয়া যায়। আইনের বাইরে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যদি এই ভিসা নিষেধাজ্ঞা পাওয়া ব্যক্তিদের নাম প্রকাশ করে থাকে তাহলে স্বাভাবিক ভাবেই তার উল্লেখ মূলধারার সংবাদমাধ্যমে পাওয়া যেত।

অর্থাৎ, বাংলাদেশের যাদের উপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা শুরু হয়েছে তারা নিজে থেকে যদি নিশ্চিত না করেন, তাহলে বাইরের কারও পক্ষে এ সম্পর্কে জানা সম্ভব নয়। কিন্তু, ভাইরাল পোষ্টগুলোতে যাদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তাদের সবার পক্ষ থেকে এখনও এ সংক্রান্ত কোনো বিবৃতি পাওয়া যায়নি। সঙ্গত কারণে ফ্যাক্টওয়াচ ভাইরাল হওয়া পোস্টগুলোকে “মিথ্যা” হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

এই নিবন্ধটি ফেসবুকের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রামের নীতি মেনে লেখা হয়েছে।।
এর উপর ভিত্তি করে ফেসবুক যে ধরণের বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এখানে
এছাড়া এই নিবন্ধ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন, সম্পাদনা কিংবা আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার জন্য আবেদন করতে এই লিঙ্কের সাহায্য নিন।

কোনো তথ্যের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকেঃ
ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh