নজরুল ইসলাম “মহাভারত” লিখেছিলেন – মমতা ব্যানার্জী এই কথা বলেছেন?

Published on: September 26, 2023

গত ২৮ আগস্ট ২০২৩ এ তৃণমূল ছাত্র পরিষদের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত ছাত্র সমাবেশে একটি বক্তৃতায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীকে বলতে শোনা যায় যে, …“রবীন্দ্রনাথ পড়ুন ও জানুন, বিবেকানন্দ পড়ুন ও জানুন, নজরুল পড়ুন ও জানুন, বীরসা মুণ্ডা পড়ুন ও জানুন, রঘুনাথ মুর্মু পড়ুন ও জানুন, মতুয়া ঠাকুর পড়ুন ও জানুন, রাজবংশীদের পঞ্চানন বর্মা পড়ুন ও জানুন ভালো করে, মহাভারত (একটু থেমে) নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন, কোরান-পুরাণ, বেদ-বেদান্ত, বাইবেল-ত্রিপিটক, গ্রন্থসাহেব-জেন্দাবেস্তা পড়ে যাও যত শখ।”… উল্লেখ্য, কাজী নজরুল ইসলামের এই লেখাটি তাঁর “সাম্যবাদী” কবিতা থেকে উদ্ধৃত করা হয়েছে। পরবর্তীতে, মমতা ব্যানার্জীর ঐ বক্তৃতার একটি ভিডিও থেকে তাঁর উদ্ধৃত করা কবিতাটি কেটে বাদ দিয়ে মহাভারত ও নজরুলের পাশাপাশি উল্লেখের ফুটেজ বানিয়ে সামাজিক মাধ্যমে দাবি করা হচ্ছে যে, “মহাভারত নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন” – এই কথা মমতা ব্যানার্জী বলেছেন। তাছাড়া, বেশকিছু ভারতীয় সংবাদমাধ্যমও এই মর্মে সংবাদ প্রকাশ করেছে যে, মমতা ব্যানার্জী আদতে বলেছেন কাজী নজরুল ইসলাম মহাভারত লিখেছিলেন। মূলত, মমতা ব্যানার্জীর পুরো বক্তব্যটি না শুনে সবাই ধরে নিয়েছে যে তিনি আসলেই একথা বলেছেন। তাই সঙ্গত কারণে ফ্যাক্টওয়াচ সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত পোস্টগুলোর দাবি “বিভ্রান্তিকর” বলে সাব্যস্ত করছে।

এমন কিছু পোস্টের নমুনা দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এবং এখানে

 

শুধুমাত্র সামাজিক মাধ্যমের ব্যবহারকারীরাই দাবি করছেন যে মমতা ব্যানার্জী বলেছেন মহাভারত নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন, তা নয়। বরং, মূলধারার বেশকিছু ভারতীয় সংবাদমাধ্যম, যেমন: ফ্রি প্রেস জার্নাল, হিন্দুস্তান টাইমস বাংলা, রিপাবলিক ওয়ার্ল্ড প্রভৃতি এই মর্মে সংবাদ প্রকাশ করেছে যে মমতা ব্যানার্জী বলেছেন, নজরুল ইসলাম মহাভারত লিখেছিলেন। 

 

তাছাড়া, পশ্চিমবঙ্গের ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) এর নেতা শুভেন্দু অধিকারী এবং বিজেপির মুখপাত্র শেহজাদ পুনাওয়ালা তাদের টুইটার হ্যান্ডেল থেকে সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ছোট ভিডিও ক্লিপটি শেয়ার করে মমতা ব্যানার্জীর বক্তব্যের জন্য তার প্রতি নিন্দা জানিয়েছেন। শুভেন্দু অধিকারী তার টুইটে বলেন, “সে (মমতা ব্যানার্জী) ভালো করে জানে যে মহাঋষি বেদ ব্যাস মহাভারত লিখেছেন। কিন্তু, সে জেনেশুনেও বলেছে যে কাজী নজরুল ইসলাম মহাভারত এর লেখক।”

 

ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধান:

“মহাভারত নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন” – এই কথা মমতা ব্যানার্জী আদতে বলেছেন কিনা তা যাচাই করতে আমরা সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত ছোট ভিডিও ক্লিপটির উপরে ডানপাশের ‘RNFnews.in’ লোগোটিকে সূত্র ধরে অনুসন্ধান করি। RNF (Regional News Feed)  বা RNFnews.in হচ্ছে নর্থ বেঙ্গলের একটি ডিজিটাল নিউজ পোর্টাল। আমাদের অনুসন্ধানে Regional News Feed বা RNF এর ‘RNF News’ নামক একটি ইউটিউব চ্যানেল খুঁজে পাওয়া গেছে। পরবর্তীতে, সামাজিক মাধ্যমে যে ভিডিও ক্লিপটি ভাইরাল হয়েছে তার অনুরূপ কোন ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায় কিনা তা দেখতে  RNF এর ইউটিউব চ্যানেলটি ঘেঁটে আমরা ২৮ আগস্ট ২০২৩ এ প্রকাশিত একটি ভিডিও খুঁজে পেয়েছি। উক্ত ভিডিওতে দেখা গেছে, মমতা ব্যানার্জী যে পোডিয়ামের (Podium) সামনে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন তার উপর তৃণমূল কংগ্রেসের একটি নির্বাচনী প্রতীক দৃশ্যমান। ঐ একই পোডিয়ামটি সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত ভিডিও ক্লিপটিতেও লক্ষ্য করা গেছে। তাছাড়া, দুটো ভিডিওতেই উপরে ডানপাশে RNFnews.in এর লোগোটি দেখতে পাওয়া গেছে। প্রাথমিকভাবে আমরা ধারণা করে নিচ্ছি যে ভিডিও দুটো একই অনুষ্ঠানের সময় ধারণ করা হয়েছিলো। RNF এর ইউটিউব চ্যানেল থেকে প্রাপ্ত ২৮ আগস্ট ২০২৩ এ প্রকাশিত ভিডিওটির বর্ণনা পড়ে জানা গেছে যে, ভিডিওটি তৃমূল ছাত্র পরিষদের একটি ছাত্র সমাবেশ থেকে ধারণ করা হয়েছে। পরে, তৃণমূল ছাত্র পরিষদের ছাত্র সমাবেশকে সূত্র হিসেবে ধরে অনুসন্ধান করে সর্ব ভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেস (AITC) এর অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলে ২৮ আগস্ট ২০২৩ এ প্রকাশিত “TMCP Foundation Day, 2023 | গান্ধী মূর্তির পাদদেশে, ২০২৩-এর তৃণমূল ছাত্র পরিষদের ছাত্র সমাবেশে” – শীর্ষক শিরোনাম সংবলিত একটি ভিডিও খুঁজে পাওয়া গেছে। উক্ত ভিডিওটির ২:৪৬:৪৮ মিনিটে মমতা ব্যানার্জীকে বলতে শোনা গেছে: “আপনারা জানেন যে ইন্দিরা গান্ধী চাঁদে মানুষ পাঠিয়েছিলেন। সালটা (১৯)৬৯-৭০ এই সময়ই হবে। আমি তখন খুব ছোট ছিলাম। আমার মনে আছে আমি কাগজ পড়তাম তখন। আনন্দবাজার পড়তাম, এখন পড়িনা।”… এখন, RNF এর ইউটিউব চ্যানেল থেকে প্রাপ্ত ঐ ভিডিওটিতেও মমতা ব্যানার্জীকে হুবহু একই বক্তৃতা দিতে দেখা গেছে। অর্থাৎ, বিষয়টি ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে যে, সবগুলো ভিডিওই একটি নির্দিষ্ট অনুষ্ঠান থেকে ধারণ করা হয়েছিলো।

       

 

এখন, “মহাভারত নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন” – এই কথাটি মমতা ব্যানার্জী আদতে তার বক্তৃতায় বলেছেন কিনা তা খুঁজে দেখার চেষ্টা করবো। সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত ভিডিও ক্লিপটির উপরে ডানপাশের RNFnews.in লোগোটির নিচে দেখা যাচ্ছে তখন সময় দুপুর দুইটা বেজে সাত মিনিট এবং চুয়ান্ন সেকেন্ড। অর্থাৎ, সামাজিক মাধ্যমের দাবি অনুযায়ী ঐ ক্ষণটিতেই মমতা ব্যানার্জী বলেছেন, মহাভারত নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন। অন্যদিকে, RNF News এ ২৮ আগস্ট ২০২৩ এ প্রকাশিত এই ভিডিওটির উপরে ডানপাশের RNFnews.in লোগোটির নিচে দেখা যাচ্ছে তখন সময় দুপুর দুইটা বেজে দুই মিনিট এবং ছত্রিশ সেকেন্ড। ঐ ক্ষণটিতে মমতা ব্যানার্জীকে বলতে শোনা যায় ইন্দিরা গান্ধী ১৯৬৯-৭০ সালে চাঁদে মানুষ পাঠিয়েছিলেন। যেহেতু দুটো ভিডিও এর সময়ের মাঝে পাঁচ মিনিটের পার্থক্য লক্ষ্য করা গেছে এবং আমরা আগেই জেনেছি যে মমতা ব্যানার্জী ইন্দিরা গান্ধীর চাঁদে মানুষ পাঠানোর কথা তৃণমূল ছাত্র পরিষদের ছাত্র সমাবেশে বক্তৃতা প্রদানকালে বলেছিলেন, সেহেতু ধরে নেয়া যেতে পারে যে নজরুল ইসলাম এবং মহাভারত এর প্রসঙ্গ মমতা ব্যানার্জী ঐ একই ছাত্র সমাবেশে উঠিয়েছিলেন। তাই, আমরা বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার জন্য সর্ব ভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেস (AITC) এর ইউটিউব চ্যানেল থেকে প্রাপ্ত তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সমাবেশের ভিডিওটি ২:৪৬:৪৮ মিনিট থেকে পাঁচ মিনিট এগিয়ে গিয়ে ২:৫১:৪৬ মিনিটে এসে দেখার চেষ্টা করেছি ঐ ক্ষণটিতে মমতা ব্যানার্জী তার বক্তৃতায় কি বলছিলেন। ভিডিওটির ২:৫১:৪৬ মিনিটে এসে মমতা ব্যানার্জীকে সমাবেশে উপস্থিত ছাত্র এবং কর্মীদের উদ্দেশ্যে বলতে শোনা গেছে, “রবীন্দ্রনাথ পড়ুন ও জানুন, বিবেকানন্দ পড়ুন ও জানুন, নজরুল পড়ুন ও জানুন, বীরসা মুন্ডা পড়ুন ও জানুন, রঘুনাথ মুর্মু পড়ুন ও জানুন, মতুয়া ঠাকুর পড়ুন ও জানুন, রাজবংশীদের পঞ্চানন বর্মা পড়ুন ও জানুন ভালো করে, মহাভারত (একটু থেমে) নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন, কোরান-পুরাণ, বেদ-বেদান্ত, বাইবেল-ত্রিপিটক, গ্রন্থসাহেব-জেন্দাবেস্তা পড়ে যাও যত শখ।”… এখানে উল্লেখ্য যে, মমতা ব্যানার্জী কবি কাজী নজরুল ইসলামের এই লেখাটি তাঁর “সাম্যবাদী” কবিতা থেকে উদ্ধৃত করেছেন। মমতা ব্যানার্জীর বক্তৃতার এই অংশটি ভালো করে শুনলে বুঝা যাবে যে তিনি আদতে মহাভারত নজরুল ইসলাম লিখেছেন – এই কথা বলেননি বা বলার চেষ্টা করেননি। বরং, তিনি ছাত্রদের উদ্দেশ্য করে রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, বীরসা মুন্ডা, রঘুনাথ মুর্মু, পঞ্চানন বর্মা, এবং মহাভারত ভালো করে পড়া এবং জানার চেষ্টা করতে বলেছিলেন। সেই সাথে তিনি কাজী নজরুল ইসলামের “সাম্যবাদী” কবিতা থেকে কিছু পঙক্তি উদ্ধৃত করে ছাত্রদের অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরির আহ্বান করেছেন। মূলত, মমতা ব্যানার্জী ছাত্র পরিষদের সমাবেশে যে বক্তৃতাটি দিয়েছিলেন সেই বক্তৃতার ভিডিও থেকে কিছু অংশ কেটে একটি ছোট ভিডিও ক্লিপ বানিয়ে সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার করা হচ্ছে। যার ফলে তিনি বক্তৃতায় মহাভারত এবং নজরুল ইসলাম প্রসঙ্গ উত্থাপনের আগে এবং পরে কি বলেছিলেন তা শোনার অবকাশ ছিলো না। মমতা ব্যানার্জীর পুরো বক্তব্যটি না শুনে সবাই ধরে নিয়েছে যে তিনি আসলেই বলেছেন, মহাভারত নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন।

 

দি কুইন্ট, বুম ইন্ডিয়া, অল্ট নিউজ, এবং নিউজচেকার এর মতো ভারতীয় ফ্যাক্ট-চেকিং সংস্থাগুলো সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত ছোট ভিডিও ক্লিপটির সাথে সংশ্লিষ্ট দাবিটি যাচাই করে দেখেছে এবং জানিয়েছে যে, মমতা ব্যানার্জী “মহাভারত নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন” – এই কথাটি বলেননি। 

 

অতএব, উপরের আলোচনা থেকে বিষয়টি স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে যে, মমতা ব্যানার্জীর বক্তৃতার ভিডিওটি থেকে কিছু অংশ কেটে বাদ দিয়ে একটি ছোট ভিডিও ক্লিপ বানিয়ে সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার করা হচ্ছে। বক্তৃতার আগের এবং পরের অংশটি শোনার অবকাশ ছিলো না বিধায় অনেকেই সেই ভিডিও ক্লিপটি দেখে বিশ্বাস করে ফেলেছে যে মমতা ব্যানার্জী আদতেই বলেছেন, মহাভারত নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন। 

সুতরাং, সবকিছু বিবেচনা করে ফ্যাক্টওয়াচ সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত পোস্টের দাবিটিকে “বিভ্রান্তিকর” সাব্যস্ত করছে।

এই নিবন্ধটি ফেসবুকের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রামের নীতি মেনে লেখা হয়েছে।।
এর উপর ভিত্তি করে ফেসবুক যে ধরণের বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এখানে
এছাড়া এই নিবন্ধ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন, সম্পাদনা কিংবা আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার জন্য আবেদন করতে এই লিঙ্কের সাহায্য নিন।

কোনো তথ্যের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকেঃ
ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh