এই পাকিস্তানি বৃদ্ধার বয়স কি ২১০ বছর?

Published on: [October 4,2021]

বয়স্কা এক নারীর একটি সম্প্রতি ছবি ভাইরাল হয়েছে। দাবি করা হয়েছে, তার বয়স ২১০ বছর এবং তিনি সম্প্রতি তার জন্মদিন উদযাপন করলেন । কিন্তু ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে এই দাবির কোনো সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায়নি । সামাজিক মাধ্যমে একেক জায়গায় এই মহিলার বয়স একেকভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু বিজ্ঞানের সর্বশেষ দাবি অনুযায়ী মানুষের গড় আয়ু ১২০/১২৫ বছরের বেশি হতে পারে না। ফলে ২০০ বছর বেঁচে থাকা কারো পক্ষে বৈজ্ঞানিকভাবেই অসম্ভব। সঙ্গত কারণেই এই তথ্যটিকে মিথ্যা আখ্যা দিচ্ছে ফ্যাক্টওয়াচ।

বিভ্রান্তির উৎস

১লা অক্টোবর রাত ১২টা ২৪ মিনিটে Md.Shamim নামক পেজ থেকে এই ছবি দেখা যায়। বাংলায় ক্যাপশনে লেখা হয় , পৃথিবীতে বর্তমান সবথেকে বেশী বয়সের মানুষ। পাকিস্তানের বাসিন্দা তিনি। গতকাল ২১০ তম বছর পূর্ণ হয়েছে।

এছাড়া ইংরেজি কিংবা বাংলা ক্যাপশন সহ বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি ফেসবুক পেজ , প্রোফাইলএবং গ্রুপ থেকে ১লা অক্টোবর সন্ধ্যা ৭টার পর থেকেই ছবি আপলোড করতে দেখা যায়। যেমন- এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে .

অনুসন্ধানে দেখা গেল , আন্তর্জাতিক অঙ্গণে গত ২৬শে সেপ্টেম্বর থেকেই এই ছবিটা ভাইরাল হতে দেখা গেছে। পাকিস্তানের এক বয়স্ক মহিলার উল্লেখ করা হলেও এই ছবি ভাইরাল হতে দেখা গেছে তুরস্ক,  ফিলিপাইন, ভারত, ব্রাজিলসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ফেসবুক পেজ থেকে।

এসব পোস্টে তার ২১০ তম জন্মদিন উদযাপনের কথা বলা হলেও, জন্মদিন পালন-সম্পর্কিত কোনো ছবি কোথাও দেখা যায়নি।

ছবির উৎস

যে দুইটি ছবি ভাইরাল হয়েছে, সেই ছবি দু’টি নেওয়া হয়েছে একটি ১৪ সেকেন্ডের ভিডিও থেকে । সপ্তাহখানেক ধরে এই ছবিটি ইউটিউবে এবং ফেবুকে ভাইরাল হতে দেখা গেছে। বিভিন্ন ক্যাপশন সহযোগে এসব ভিডিও বিভিন্ন একাউন্ট থেকে আপলোড করা হয়েছে। যেমন- এখানে , এখানেএখানে , এখানে

২৪ শে সেপ্টেম্ব্র,২০২১ তারিখে আপলোড করা এই ভিডিওতে একটি বয়স্ক মহিলার মুখ এবং হাতের কিছু অংশ দেখানো হয়। তবে মহিলার নাম ,কিংবা তার জন্ম সনদ/জাতীয় পরিচয়পত্র বা এ ধরনের কোনো প্রমাণাদি দেখানো হয় নি। ভিডিওতে তিনি কোনো কথাও বলেন নি। কিসের ভিত্তিতে ভিডিওর ক্যাপশনে তাকে দ্বিশতবর্ষী দাবি করা হচ্ছে, সেটাও বোঝা যাচ্ছেনা।

এছাড়া, ইউটিউবের এই ভিডিওতে তাকে ৩০০ বছর বয়স্ক বলে দাবি করা হচ্ছে। এই ছবিগুলোই ফেসবুকে এসে ২১০ বছর হয়ে গেছে।

একই মহিলার কয়েক মাস আগের অন্য কয়েকটি ক্ষুদ্র ভিডিও পাওয়া গেল ইউটিউবে, যেগুলোর ওয়াটারমার্ক থেকে বোঝা যাচ্ছে, এদেরকে টিকটক থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।  এসব ভিডিওতে এই মহিলার বয়স সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। সবগুলো ভিডিওই ১৪ সেকেন্ড কিংবা খুব কম সময়ের ।

যেমন- ৮ই সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখে আপলোড করা ইউটিউবের এই ভিডিওতে এবং ফেসবুকের এই ভিডিওতে তাকে ২২২ বছর বয়স্ক বলে দাবি করা হচ্ছে।



৯ই জুন ২০২১ তারিখে আপলোড করা এই ভিডিওতে তাকে ১৮৯ বছর বয়স্ক বলে দাবি করা হচ্ছে।

আবার, ১৪ই জুন ২০২১ তারিখে আপলোড করা অন্য একটি ভিডিওতে তাকে ১৪০ বছর বয়স্ক বলে দাবি করা হয়েছে।

অর্থাৎ , এই একই মহিলাকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বয়সী বলে দাবি করে সামাজিক মাধ্যমে ছবি কিংবা ভিডিও আপলোড করা হয়েছে। তবে কোথাও তার নাম কিংবা জন্মতারিখ বলা হয়নি।

প্রবীণতম ব্যক্তির খোজে

প্রবীণ ব্যক্তিদের নিয়ে জ্ঞানের যে শাখায় আলোচনা করা হয় তাকে GERONTOLOGY (বার্ধক্যবিদ্যা) বলে। Gerontology Research Group নামের একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা বিশ্বব্যাপী প্রবীণ ব্যক্তিদের খোঁজে গবেষণা চালায়। Supercentenarian অর্থাৎ যাদের বয়স ১০০ বছরের বেশি, তাদেরকে যাচাই বাছাই করে সংস্থাটি। জন্ম তারিখের সনদপত্র এবং রক্ত ও ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে বয়স নিশ্চিত করে থাকে তারা।  কোনো প্রবীণ ব্যক্তির বয়সের দাবির সত্যতা পেলে উক্ত ব্যক্তির নাম তালিকাভুক্ত করে। grg.org ওয়েবসাইটে যে কেউ এই তালিকা দেখতে পারবে।  এদের দেয়া তথ্যের উপর ভিত্তি করেই গিনিজ বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস, উইকিপিডিয়া এবং অন্যান্য বিভিন্ন সংস্থা প্রবীণ ব্যক্তিদের তালিকা তৈরি  করে।

২০শে সেপ্টেম্বর আপডেট করা এই তালিকা অনুযায়ী, এই মুহুর্তে বিশ্বের সবচেয়ে প্রবীণ ব্যক্তি হলেন জাপানের Kane Tanaka , যার বয়স ১১৮ বছর ২৭৩ দিন ( ২০শে সেপ্টেম্বর ২০২১ অনুযায়ী)।

অর্থাৎ, ১১৮ বছরের চেয়ে বেশি বয়স্ক কোনো জীবিত ব্যক্তি সম্পর্কে কোনো তথ্য Gerontology Research Group এর কাছে নেই।

এছাড়া, লক্ষণীয় ব্যাপার হল, উক্ত তালিকায় পাকিস্তানের কারোরই নাম নেই।

সামাজিক মাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে অনেককে বেশ প্রবীণ হিসেবে দাবি করা হয়। তবে তাদের জন্ম তারিখের সপক্ষে কোনো প্রমাণ উত্থাপন করতে দেখা যায় না। এ কারণে Gerontology Research Group বা অন্য কোনো স্বীকৃত সংস্থার তালিকায় তাদের নাম ওঠে না।

মানুষ সর্বোচ্চ কতদিন বাচতে পারে?

মানব দেহের প্রতিটি কোষ বিভাজিত হয়ে বংশবৃদ্ধি করে। এভাবে দেহের বৃদ্ধি ঘটে এবং কোনো অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্থ হলে সেখানে নতুন কোষ জন্মে ক্ষতিপূরণ করে দেয়। তবে বিজ্ঞানীরা দেখছেন, দেহকোষ অসীম সংখ্যকবার বিভাজিত হতে পারে না। কোষের ডি এন এ’র শেষ প্রান্তের Telomere নামক অংশটি প্রতিবার বিভাজনের সময় একটু একটু করে ছোট হতে থাকে। বিজ্ঞানী Leonard Hayflick ১৯৬১ সালে এক গবেষণায় দেখেছেন, মানকোষের টেলুমেয়ারগুলো ৪০ থেকে ৬০ বার বিভাজিত হতে পারে। এর চেয়ে বেশি আর সম্ভব নয়। ৬০ বার বিভাজন হওয়ার পরে মানব দেহের কোষ বিভাজন বন্ধ হয়ে যাবে। এই সীমাকে বলে বা Hayflick Limit হেফ্লিক সীমা ।

অন্যদিকে Alex Carrel এর মত কিছু বিজ্ঞানী দাবি করেন, মানব দেহকোষ অমর। অসীম সংখ্যকবার তারা বিভাজিত হতে পারে। যদিও তার গবেষণায় বিভিন্ন ত্রুটি ধরা পড়েছে এবং এই ফলাফল বিজ্ঞানীমহলে গ্রহণযোগ্য হয়নি। পক্ষান্তরে , হেফ্লিক লিমিট নিয়ে গবেষণার জন্য বিজ্ঞানী Elizabeth Blackburn এবং Carol Greider ১৯৮২ সালে চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন।

মানুষ ছাড়া অন্যান্য প্রাণীর ক্ষেত্রেও কোষ বিভাজনের এই সীমা দেখা যায়। গ্যালাপ্যাগাস দ্বীপের বিশালাকৃতির কচ্ছপের দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে । এদের ক্ষেত্রে ১১০ বার কোষ বিভাজন ঘটতে পারে এবং এদের গড় আয়ু ২০০ বছর ।

হেফ্লিক সীমাকে আমলে নিয়ে , এবং পর্যবেক্ষণলব্ধ বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের সাহায্যে বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, মানুষের সর্বোচ্চ গড় আয়ু ১২০ থেকে ১২৫ বছর

কাজেই , আমাদের আলোচ্য ছবিতে যেমনটি দাবি করা হচ্ছে, তেমনিভাবে কারো পক্ষে ২১০ বছর কিংবা ৩০০ বছর বয়স্ক প্রবীণ হওয়া সম্ভব নয়।

তবে এই সীমা নিয়ে বিজ্ঞানীরা থেমে নেই। তারা কাজ করছেন মানুষের আয়ু বাড়ানোর জন্য।  প্রকৃতিতে এ্যামিবা, টার্ডিগ্রেড,জেলিফিশ সহ কয়েকটি প্রাণী পাওয়া যায় , যাদের কোষ অমর। কোনো অসুখ, দুর্ঘটনা বা অপঘাতে মৃত্যু ছাড়া এরা বার্ধক্যজনিত কারণে মারা যায় না। এদের দেহকোষের সাথে স্তন্যপায়ী প্রাণীর জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর মাধ্যমে হেফ্লিক সীমা বাড়ানো কিংবা জেনেটিকালি মডিফাইড অমর মানব বানানো সম্ভব বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।

অন্যান্য ফ্যাক্টচেকারদের অনুসন্ধান

এই টপিকটা ভাইরাল হওয়ার পরে ভারতীয় গণমাধ্যম ‘ইন্ডিয়া টুডে’ এ বিষয়ে অনুসন্ধান করেছে এবং এই দাবির সপক্ষে কোনো সত্যতা খুঁজে পায়নি। তাদের ফ্যাক্টচেকিং রিপোর্ট এর আর্কাইভড ভার্সন দেখতে পাবেন এখানে

ফ্যাক্টওয়াচের সিদ্ধান্ত

ভাইরাল হওয়া ছবিতে উক্ত নারীর নাম ,পরিচয়, জন্মতারিখ কিংবা অন্য কোনো তথ্যই জানা যাচ্ছে না। এছাড়া , একেক জায়গায় ছড়িয়ে পড়া তথ্যে উক্ত নারীর বয়স সম্পর্কে একেক রকম তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। বিজ্ঞানসম্মতভাবেও, কারো বয়স ২০০ বা ৩০০ বছর হওয়া সম্ভব নয়। প্রবীণদের নিয়ে গবেষণাকারী সংস্থাদের কাছেও এত বেশি বয়স্ক কারো তথ্য পাওয়া যায় না। সার্বিক বিবেচনায় ফ্যাক্টওয়াচ এই দাবিটিকে ‘মিথ্যা’ সাব্যস্ত করছে।

 

আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন?
কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন?
নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?

এসবের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে জানান।
আমাদেরকে ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh

Leave a Reply