মালায়ালাম অভিনেত্রীর ছবিকে লাভ জিহাদের শিকার “অংকিতা বিজয়” বলে দাবি

Published on: April 16, 2023

সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমে একটি মেয়ের মুখমণ্ডলে আঘাতের চিহ্ন সংবলিত কিছু ছবি শেয়ার হতে দেখা গেছে। শেয়ারকারীদের দাবি অনুযায়ী, মেয়েটির নাম অংকিতা বিজয়। সে তথাকথিত “লাভ জিহাদের” শিকার হয়েছে এবং আব্দুল নামে একজন মুসলিম যুবক তাকে নির্যাতন করেছে। তবে, ফ্যাক্টওয়াচ অনুসন্ধান করে দেখেছে ছবিগুলো অংকিতা বিজয় নামক কোন মেয়ের নয়, বরং আনিকা বিক্রমণ নামক একজন মালায়ালাম অভিনেত্রীর। গত ৬ই ও ৭ই মার্চ ২০২৩ এ প্রকাশিত কিছু ভারতীয় গণমাধ্যমের সংবাদ মারফত জানা গেছে যে, আনিকা বিক্রমণ তার প্রাক্তন প্রেমিকের বিরুদ্ধে মানসিক এবং শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগ এনে আঘাতের কিছু ছবি সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার করেন। সঙ্গত কারণে আনিকা বিক্রমণের ছবিকে অংকিতা বিজয়ের ছবি দাবি করে শেয়ার হওয়া পোস্টগুলোকে ফ্যাক্টওয়াচ “মিথ্যা” সাব্যস্ত করছে। 

সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত এমন কিছু পোস্টের নমুনা দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এবং এখানে

 

ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধান:

সামাজিক মাধ্যমের বিভিন্ন পেইজে শেয়ারকৃত যে ছবিগুলোকে অংকিতা বিজয়ের বলে দাবি করা হচ্ছে তার সত্যতা যাচাই করতে আমরা উক্ত ছবিগুলো ব্যবহার করে গুগল রিভার্স ইমেজ সার্চ করি। সার্চের ফলাফলে দ্য হিন্দুস্তান টাইমস, এনডিটিভি, দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, এএনআই নিউজ ইন্ডিয়া, এবং এশিয়ানেট নিউজ এ প্রকাশিত বেশকিছু সংবাদ পাওয়া যায়। সেগুলো পড়ে জানা যায়, সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত মুখমণ্ডলে আঘাতের চিহ্ন সংবলিত ছবিগুলো আনিকা বিক্রমণ নামক একজন মালায়ালাম অভিনেত্রীর। ঐ অভিনেত্রী তার প্রাক্তন প্রেমিক অনুপ পিল্লাই এর নামে মানসিক এবং শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগ আনেন এবং আঘাতের কিছু ছবি সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার করেন। গত ২৪ই মার্চ ২০২৩ এ জি নিউজ ইন্ডিয়া এর একটি সংবাদ মারফত জানা গেছে, অভিযুক্ত অনুপ পিল্লাই তার বিরুদ্ধে আনা আনিকা বিক্রমণের অভিযোগকে প্রত্যাখান করেছেন। 

 

লাভ জিহাদ কি?

কথিত “লাভ জিহাদ” পদটি হচ্ছে হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দলগুলোর তৈরি একটি ভিত্তিহীন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব (Conspiracy theory), যেখানে বিশ্বাস করা হয় যে মুসলিম যুবকরা ছলনা করে হিন্দু মেয়েদের ফাঁদে ফেলে তাদের ধর্মান্তরিত করে বিয়ে করে এবং মুসলিম আধিপত্য নিশ্চিত করে। তবে, অনেকেই “লাভ জিহাদ”কে নিছক একটি ষড়যন্ত্রতত্ত্ব বলে নাকচ করে দিয়েছেন। তাছাড়া, ২০১৮ সালে ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন অ্যাজেন্সি (এনআইএ) ভারতের কেরালায় আন্তঃধর্মীয় বিয়েগুলো তদন্ত করে দেখে এবং সেখানে কথিত “লাভ জিহাদ” অর্থাৎ, পরিকল্পনা করে ধর্মান্তরিত করে বিয়ে করার কোন প্রমাণ পায়নি। পড়ুন দ্য হিন্দুস্তান টাইমস এবং দ্য ওয়্যার এর প্রতিবেদন। 

 

ভারতে এই তথাকথিত “লাভ জিহাদ” কে দমন করার উদ্দেশ্যে ধর্মান্তর-বিরোধী (Anti-conversion) আইন প্রণয়ন করা হয় এবং এই আইনের দোহাই দিয়ে আন্তঃধর্মীয় বিয়েতে বাধা দেওয়া হয়। এমনকি যারা এই নতুন আইনের অনেক আগেই আন্তঃধর্মীয় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন তারাও হয়রানি থেকে রেহাই পাননি। পড়ুন এখানে এবং এখানে 

তাছাড়া, উক্ত ধর্মান্তর-বিরোধী আইন এবং “লাভ জিহাদ” এর দোহাই দিয়ে অনেক মুসলিম যুবককে হয়রানি করার ঘটনা দেখা গেছে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে। আল-জাজিরা এর ১৫ই মার্চ ২০২১ এ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে যে, ১৩০ কোটি হিন্দু এবং ২০ কোটি মুসলমানের দেশে আন্তঃধর্মীয় বিয়ে এবং ধর্মীয় ধর্মান্তরিতকরণ একটি বিরল ঘটনা। তবুও, ২৮ই নভেম্বর ২০২০ এ ভারতের উত্তর প্রদেশে ধর্মান্তর-বিরোধী অধ্যাদেশ ঘোষণা হওয়ার পর থেকে ৮৬ জনের নাম থানার ফার্স্ট ইনফরনেশন রিপোর্ট (এফআইআর) এ অন্তর্ভুক্ত হয়। ঐ ৮৬ জনের মধ্যে ৭৯ জন মুসলিম যুবককে হিন্দু নারী প্রলুব্ধ করে এবং জোর করে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করার অপরাধে অভিযুক্ত করা হয়।

 

“লাভ জিহাদ” তত্ত্বটি নতুন কিছু নয়। উনিশ শতক থেকেই হিন্দুত্ববাদী দলগুলো ভিত্তিহীনভাবে দাবি করে আসছে যে মুসলিম যুবকরা হচ্ছে শিকারী। তারা হিন্দু নারীদের প্রলুব্ধ করে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করছে এবং তাদের গর্ভে মুসলিম শিশু উৎপন্ন করে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশটির জনসংখ্যা পরিবর্তন করে দিতে চাচ্ছে। পড়ুন এখানে

গবেষক এবং মানবাধিকার কর্মী নশ্বর সিং (Navsharan Singh) বলেন, “ভুয়া সংবাদের উপর ভিত্তি করে ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলোর মাঝে ঘৃণা এবং সন্দেহ লালনের আবহ তৈরি করে বিভেদ সৃষ্টির অভিপ্রায়ই লাভ জিহাদ।” পড়ুন এখানে

 

“লাভ জিহাদ” নিয়ে বিস্তারিত কিছু প্রতিবেদন পড়ুন এখানে, এখানে, এবং এখানে। 

আনিকা বিক্রমণের ছবিগুলো ব্যবহার করে সামাজিক মাধ্যমের কিছু পেইজ তাকে অংকিতা বিজয় দাবি করে আব্দুল নামক একজন মুসলিম যুবকের বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ এনে একটি “লাভ জিহাদ” এর উদাহরণ তৈরি করতে চেয়েছিলো। উল্লেখ্য, ইন্টারনেটের পাবলিক ডোমেইনে অংকিতা বিজয় সম্পর্কিত কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। 

সুতরাং, সবকিছু বিবেচনা করে ফ্যাক্টওয়াচ সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত পোস্টটিকে “মিথ্যা” বলে সাব্যস্ত করছে।

সংশোধনী: পূর্বের “মালায়ালাম অভিনেত্রীর ছবিকে লাভ জিহাদের শিকার বলে দাবি” এই শিরোনামটি পরিবর্তন করে “মালায়ালাম অভিনেত্রীর ছবিকে লাভ জিহাদের শিকার অংকিতা বিজয় বলে দাবি” করা হয়েছে। এর ফলে শিরোনামটি আরও বোধগম্য হয়েছে।

আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন?
কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন?
নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?

এসবের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে জানান।
আমাদেরকে ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh