মেয়েদের এই ৮টি ভুলের কারণে হচ্ছে স্তন ক্যান্সার – আংশিক মিথ্যা

Published on: March 28, 2022

‘মেয়েদের এই ৮টি ভুলের কারণে হচ্ছে স্তন ক্যান্সার’ – এমন একটি পোস্ট ভাইরাল হয়েছে ফেসবুকে। ৮টি কাজ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে বক্ষবন্ধনীর ব্যবহার, প্লাস্টিকের বক্সে খাবার সংরক্ষণ, ডিওডোরেন্ট ব্যবহার, চুলের রঙ, এয়ার ফ্রেশনার ও গৃহস্থালি কাজে রাসায়নিক ক্লিনারের ব্যবহার এবং ন্যাপথালিনের ব্যবহার। ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধান বলছে,  এর মধ্যে বক্ষবন্ধনী ও ডিওডোরেন্ট ব্যবহার স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায় — এ দাবিটি ভিত্তিহীন। 

 

বিভ্রান্তির উৎস

২০২১ সালের মার্চ মাস থেকে এই পোস্ট ছড়িয়ে পড়ে ফেসবুকে। বেশকিছু অনলাইন নিউজ পোর্টাল এই আর্টিকেলটি শেয়ার করে। এছাড়া কথিত পুষ্টিবিদের পেইজ, রূপচর্চা এবং জীবনধর্মী বিভিন্ন পেইজ থেকে এই পোস্ট শেয়ার করা হয়। এরকম কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানেএখানে  , এখানে


ফ্যাক্টওয়াচ অনুসন্ধান

উক্ত পোষ্টের প্রথম পয়েন্ট হলো – স্তনের আকার অনুযায়ী সঠিক মাপের বক্ষবন্ধনী ব্যবহার না করার অভ্যাস স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। স্তনের আকারের চেয়ে বড় মাপের বক্ষবন্ধনী স্তনের টিস্যুগুলোকে ঠিকমত সাপোর্ট দিতে পারে না, এবং অতিরিক্ত ছোট বা টাইট বক্ষবন্ধনী দ্বারা স্তনের তরলবাহী লসিকাগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

দ্বিতীয় পয়েন্ট হলো – সারাক্ষণ বক্ষবন্ধনী পরে থাকার কারণে সৃষ্ট ঘাম ও আর্দ্রতা ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।

ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে BreastCancer.org-এর ওয়েবসাইটে স্তন ক্যান্সার বিষয়ক মিথ সম্পর্কিত এই আর্টিকেলটিতে পাওয়া যায়, বক্ষবন্ধনী ব্যবহারের সাথে স্তন ক্যান্সারের সম্পর্ক আছে – এটি একটি মিথ বা কুসংস্কার। যেসব বক্ষবন্ধনীতে ফ্রেম রয়েছে, সেগুলো স্তন থেকে তরল লসিকার প্রবাহকে বাধাপ্রাপ্ত করে স্তনের টিস্যুতে বিষাক্ত পদার্থ তৈরি করে থাকে – এমন একটি ধারণা প্রচলিত আছে, যেটি সম্পূর্ণ ভুল। ২০১৪ সালের একটি গবেষণায় দেখা যায়, বক্ষবন্ধনী ব্যবহারের সাথে স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকির কোনো সম্পর্ক নেই।

হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের এই ব্লগ সাইটটিতে বলা হয়েছে, স্তন ক্যান্সারের সাথে বক্ষবন্ধনী ব্যবহার করা সংক্রান্ত কোনো বিষয় – বক্ষবন্ধনীর কাপের আকার, ফ্রেমযুক্ত বক্ষবন্ধনী, বক্ষবন্ধনী ব্যবহার শুরু করার বয়স এবং প্রতিদিন গড়ে কতো ঘণ্টা ব্যবহার করা হচ্ছে এর কোনো সম্পর্ক নেই।

 

অস্ট্রেলিয়ার ক্যান্সার কাউন্সিলের এই প্রশ্নোত্তর ফোরামে ‘ঘুমানোর সময় ব্রা ব্যবহার করা স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায় কিনা’-এ প্রশ্নের উত্তরে বলা হয়েছে, ব্রা ব্যবহার করা বা না করার সাথে স্তন ক্যান্সারের সম্পর্ক আছে এমন কোনো নির্ভরযোগ্য গবেষণা নেই।

ইন্টারনেটে ভুল মাপের বক্ষবন্ধনী ব্যবহার করার সাথে স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি থাকা সম্পর্কিত কোনো গবেষণা পাওয়া যায় না।

 

তৃতীয় পয়েন্ট – প্লাস্টিকের বক্সে খাবার সংরক্ষণ করা এবং সেটি ওভেনে গরম করার অভ্যাস স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।

Healthline, MedicalNewsTodayNational Geographic-এর এই আর্টিকলগুলো থেকে জানা যায়, খাবার সংরক্ষণের জন্য BPA(Bisphenol A) যুক্ত প্লাস্টিক কন্টেইনার ব্যবহার ব্রেস্ট ক্যান্সার, প্রোস্টেট ক্যান্সার, টাইপ-২ ডায়াবেটিস, হৃদরোগ এবং বিভিন্ন প্রজনন-সংক্রান্ত রোগব্যাধির ঝুঁকি বাড়ায়। তবে BPA-মুক্ত ওভেন সেইফ প্লাস্টিক ব্যবহারে এসব ঝুঁকি থাকে না।

তবে মাইক্রোওয়েভ ওভেনের রেডিয়েশন থেকে ক্যান্সার হবার ঝুঁকি নেই

চতুর্থ পয়েন্ট –  অ্যালুমিনিয়ামযুক্ত ডিওডোরেন্ট স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।

Healthline-এর মতে, ডিওডোরেন্টে অ্যালুমিনিয়াম উপাদানটি ব্যবহার করা হয় না, বরং অ্যান্টিপার্সপায়ারেন্টে  (antiperspirant) ব্যবহৃত হয়। ডিওডোরেন্ট ঘামের দুর্গন্ধ লুকাতে সাহায্য করে, আর অ্যান্টিপার্সপায়ারেন্ট ঘাম উৎপন্ন রোধ করতে সাহায্য করে। এই অ্যান্টিপার্সপায়ারেন্ট ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায় এমন কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ পাওয়া যায় না।

 

BreastCancer.org অ্যান্টিপার্সপায়ারেন্টের সাথে ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকিকে মিথ বলে আখ্যায়িত করেছে

MedicalNewsToday-ও এই দাবির সপক্ষে যথেষ্ট বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই বলে জানাচ্ছে।


পঞ্চম
পয়েন্ট – চুলের রঙ  স্তন ক্যান্সারের কারণ হতে পারে।

American Cancer Society এবং Harvard Medical School-এর মতে, চুলের রঙের সাথে স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি নির্ণয়ে এখন পর্যন্ত চালানো বিভিন্ন গবেষণার ফলাফল সাংঘর্ষিক। American Cancer Society-এর এই আর্টিকেল অনুযায়ী, কয়েকটি গবেষণায় চুলের রঙের সাথে স্তন ক্যান্সারের সাথে সম্পর্ক পাওয়া গেলেও, আবার কয়েকটি গবেষণায় তেমনটা পাওয়া যায় না।

Harvard Medical School-এর আর্টিকল বলছে, চুলের রঙের সাথে স্তন ক্যান্সার ও ডিম্বাশয়ের ক্যান্সারের (ovarian cancer) সম্পর্ক পাওয়া গেছে।

BreastCancer.org এবং যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক National Instititutes of Health (NIH) বলছে, আগের গবেষণা সাংঘর্ষিক ফলাফল দিলেও, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত একটি গবেষণা থেকে দেখা যাচ্ছে, যেসব মহিলারা চুলে রঙ এবং কেমিক্যাল স্ট্রেইটনার ব্যবহার করেছেন, তাদের স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি চুলে রঙ ব্যবহার করেন না এমন মহিলাদের চেয়ে বেশি পাওয়া গেছে।

ষষ্ঠ অষ্টম পয়েন্ট – এয়ার ফ্রেশনার ও গৃহস্থালি কাজে ব্যবহৃত রাসায়নিক ক্লিনার স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।

২০১০ সালে প্রকাশিত এই গবেষণা থেকে দেখা গেছে, এয়ার ফ্রেশনার ও রাসায়নিক ক্লিনারের ব্যবহার স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।

Endocrine disrupting chemicals (EDC), এই রাসায়নিক পদার্থগুলো স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। এয়ার ফ্রেশনারে ব্যবহৃত Phthalates এবং রাসায়নিক ক্লিনারে ব্যবহৃত Cyclosiloxane, Glycol Ethers, Phthalates, Paraben, Ethanolamides, BPA এগুলো EDC-এর অন্তর্ভুক্ত।

সপ্তম পয়েন্ট – ন্যাপথালিন স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়।

যুক্তরাষ্ট্রের Enviorenment Protection Agency ন্যাপথালিনকে সম্ভাব্য ক্যান্সার সৃষ্টিকারী পদার্থ (carcinogen) হিসেবে আখ্যা দিয়েছে।  ২০২০ সালে নেচার সায়েন্টিফিক রিপোর্টে প্রকাশিত গবেষণা বলছে, ন্যাপথালিন ব্রেস্ট ক্যান্সারের জন্য দায়ী হতে পারে।

 

ফ্যাক্টওয়াচের সিদ্ধান্ত

ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায় এমনটা দাবি করা ৮টি কাজের মধ্যে ২ টিই (বক্ষবন্ধনী এবং ডিওডোরেন্ট) সম্পূর্ণ মিথ/ভুল ধারণা এবং একটির ব্যাপারে (চুলের রঙ) গবেষণা এখন পর্যন্ত জোরালোভাবে সিদ্ধান্ত দিতে পারে নি (inconclusive)।

 

আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন?
কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন?
নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?

এসবের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে জানান।
আমাদেরকে ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh

Leave a Reply