কাঁঠাল এবং কোকাকোলা একসাথে খেলে কি বিষক্রিয়া কিংবা মৃত্যু হতে পারে?

Published on: June 10, 2023

বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে সামাজিক মাধ্যমে একটি পোস্ট শেয়ার করে দাবি করা হচ্ছে যে, কাঁঠাল খাওয়ার পর কোকাকোলা পান করলে তা তিনটি সাপের কামড়ের সমান বিষক্রিয়া হয় এবং এর ফলে মৃত্যু হতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ে উক্ত দাবিটি সামাজিক মাধ্যমে বেশ সরব হয়েছে। তবে, ফ্যাক্টওয়াচ এই বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞের সাথে কথা বলে জানতে পেরেছে যে, কাঁঠাল এবং কোকাকোলায় এমন কোন উপাদান নেই যা একসাথে বিক্রিয়া করে বিষ উৎপন্ন করতে পারে। তবে, কাঁঠালের আঁশ এবং কোমল পানীয়ের কার্বনেশন (Carbonation) এর কারণে বদহজম বা পেট ব্যথা হতে পারে অনেকের। কাঁঠাল এবং কোকাকোলা একসাথে খেলে বড়জোর ডায়রিয়া হতে পারে, কিন্তু এতে কেউ মারা যায় না। শুধু কাঁঠাল নয় বরং, আম এবং ডুরিয়ান (কাঁঠালের মতো দেখতে সিঙ্গাপুরের জাতীয় ফল) খাওয়ার পর কোকাকোলা পান করলে মৃত্যু হতে পারে – এরকম দাবিও বিভিন্ন ভাষায় সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হচ্ছে বিগত সময়ে। ফ্যাক্টওয়াচ বেশ কয়েকটি ফ্যাক্ট-চেকিং রিপোর্ট খুঁজে পেয়েছে যেখানে বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে “আম এবং ডুরিয়ান খেয়ে কোকাকোলা পান করলে মৃত্যু হতে পারে” সংক্রান্ত দাবিগুলোকে মিথ্যা সাব্যস্ত করা হয়েছে। সুতরাং, কাঁঠাল এবং কোকাকোলা একসাথে খেলে বিষক্রিয়ায় নিশ্চিত মৃত্যু – সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল এই দাবিটিকে “মিথ্যা” সাব্যস্ত করতে গিয়ে বর্তমান ফ্যাক্ট-ফাইলটি তৈরি করা হয়েছে।

  Image: Example of a viral Facebook post

 

ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধান:

কাঁঠাল এবং কোকাকোলা একসাথে খেলে কি তিনটি সাপের কামড়ের সমান বিষক্রিয়া হতে পারে?

সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত পোস্টের দাবিটির দুর্বল অংশটি হচ্ছে কাঁঠাল এবং কোকাকোলা একসঙ্গে খেলে তিনটি সাপের কামড়ের সমান বিষক্রিয়া হয়ে নিশ্চিত মৃত্যু হতে পারে। বিষধর সাপের কামড় থেকে নির্গত বিষ (Venom) এবং খাদ্যের সাথে যে বিষ (Poison) প্রাণীদেহ বা মানবদেহে প্রবেশ করে তার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। বিষধর সাপের বিষ বা ভেনম মানবদেহে তখনই কার্যকর হয় যখন তা রক্তের সাথে মিশতে পারে। অন্যদিকে, খাদ্যের মাধ্যমে যে বিষ বা পয়জন মানবদেহে প্রবেশ করে তা পাকস্থলীতে পৌঁছে বিষক্রিয়া ঘটাতে পারে। বিষের এই ধরণ এবং তাদের কাজের পার্থক্য সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে আমরা খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী ও গবেষক সৃজনী মন্ডল এর সাথে যোগাযোগ করি। সাপের বিষ এবং এর কার্যপদ্ধতি নিয়ে সৃজনী মন্ডল বলেন, “সাপের কামড় থেকে যে বিষ নির্গত হয় তাকে বলা হয় ভেনম (Venom)। এটি একধরনের প্রোটিন জাতীয় পদার্থ যা আমাদের রক্তের প্রোটিনকে নষ্ট করে দেয়। এটা খেলে কিছু হয় না, কেবলমাত্র রক্তের সাথে মিশলেই সেটা ক্ষতিকর। অন্যদিকে, যে বিষাক্ত জিনিস খাদ্যের মাধ্যমে দেহে প্রবেশ করে বিষক্রিয়া করে তাকে বলা হয় পয়জন (Poison)। এটি সাপের বিষের থেকে আলাদা। এটি প্রোটিন বা লবণ বা অন্যান্য যেকোন রাসায়নিক পদার্থ হতে পারে। একেক পয়জন একেক ভাবে কাজ করে। যেমন: সায়ানাইড (Cyanide) একটা পয়জন, এটা ইলেক্ট্রন ট্রান্সপোর্ট চেইনে বাধা দেয়। ফলে শ্বসন প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে মানুষ মারা যায়। আবার, ওডিএপি নামক আরেকটা পয়জন স্নায়ুতন্ত্রে প্রভাব ফেলে। কিছু কিছু পয়জন আছে, যেগুলো এনজাইম ইনহিবিটর। অর্থাৎ, এনজাইম এর কাজে বাধা দেয়।” কাঁঠাল এবং কোকাকোলা একসাথে খেলে বিষক্রিয়া হয়ে মৃত্যু হতে পারে কিনা এই সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “কাঁঠাল ও সফট ড্রিঙ্কসে এমন কোন উপাদান নাই যা একসাথে বিক্রিয়া করে বিষ উৎপন্ন করতে পারে। তবে, কাঁঠালের আঁশ এবং সফট ড্রিঙ্কসের কার্বনেশনের কারণে বদহজম বা পেটে ব্যথা হতে পারে অনেকের। এতে কেউ মারা যায় না। বড়জোর ডায়রিয়া হতে পারে। অন্যথায়, আর কিছু না।”

 

ডুরিয়ান বা আম খেয়ে কোকাকোলা পান করলে কি মৃত্যু হতে পারে?

কাঁঠালের পাশাপাশি ডুরিয়ান কিংবা আম খেয়ে কোকাকোলা পান করলে মৃত্যু হতে পারে – এমন কিছু দাবি বিভিন্ন ভাষায় সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার হচ্ছে। ডুরিয়ান হচ্ছে প্রায় কাঁঠালের মতো দেখতে কাঁটাযুক্ত এবং সিঙ্গাপুরের জাতীয় ফল। ১৩ জুলাই ২০২০ এ প্রকাশিত এএফপি এর “Health experts refute misleading claim that consuming durian and cola together can be lethal” শীর্ষক একটি ফ্যাক্ট-চেকিং রিপোর্টে ডুরিয়ান এবং কোকাকোলা একসাথে খেলে মৃত্যু হতে পারে – এই দাবিটিকে নাকচ করে দেয়। এএফপির ঐ রিপোর্টটিতে থাইল্যান্ডের Chulalongkorn University এর মেডিসিন অনুষদের সহকারী অধ্যাপক ডাক্তার পিয়াপান প্রেক্ষাপানিচ (Piyapan Prueksapanich) বলেন, “ডুরিয়ান এবং কোকাকোলা একসঙ্গে খাওয়াটা বিপদজনক নয় এবং এই দুটো একসাথে খেলেও তা মানবদেহকে তীব্রভাবে বিষাক্ত করে তুলতে পারে না। তবে, স্থূলতা (Obesity) বর্জনের জন্য অন্যান্য উচ্চ শর্করাযুক্ত খাদ্যের মতো ডুরিয়ান এবং কোকাকোলা একসঙ্গে বেশি খাওয়া উচিত নয়। কিন্তু ডুরিয়ান এবং কোকাকোলা একসাথে খেতেও নিষেধ করা হয়নি।” তবে, ডাক্তার পিয়াপান ডুরিয়ান এবং অ্যালকোহল একসাথে খাওয়ার ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছেন। তিনি বলেন, “ডুরিয়ান এবং অ্যালকোহল একসঙ্গে খাওয়াটা মানবদেহের জন্য বিপদজনক হতে পারে। ডুরিয়ান খেয়ে অ্যালকোহল পান করলে তা মানবদেহে অ্যালকোহলের বিষক্রিয়ার লক্ষণকে আরও বেশি মারাত্মক করে তুলতে পারে এবং কিছুক্ষেত্রে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটাতে পারে।”

Image: Excerpt from the AFP’s fact-checking report

 

আম খেয়ে কোকাকোলা পান করলে মৃত্যু হতে পারে – এরকম একটি দাবিও খণ্ডন করেছে বেশকিছু ফ্যাক্ট-চেকিং ওয়েবসাইট। BangaloreMirror নামক একটি ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ফ্যাক্ট-চেকিং রিপোর্টে বলা হয়েছে, আম এবং কোকাকোলা একসঙ্গে মিশে কোন প্রাণঘাতী বিষ তৈরি করতে পারে না। অন্য আরেকটি ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, আম এবং কোকাকোলা খেয়ে মৃত্যু হয়েছে – এটা একটা ভুয়া খবর। যদি কেউ আম এবং কোকাকোলা খেয়ে মারা গিয়েও থাকে তাহলে তার ঐ কোকাকোলাটি মেয়াদোত্তীর্ণ ছিলো এবং তা কোনভাবে তার দেহে বিষক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিলো।

Image: Excerpt from the BangaloreMirror’s fact-checking report

 

অতএব, এই বিষয়টি এখন স্পষ্ট যে, কাঁঠাল, ডুরিয়ান কিংবা আম খেয়ে কোকাকোলা পান করলে বিষক্রিয়া বা মৃত্যু হয় না। কাঁঠাল, ডুরিয়ান কিংবা আমের আঁশ এর সাথে কোকাকোলার কার্বনেশনের কারণে পেটে গ্যাস জমে বদহজম বা ডায়রিয়া হতে পারে। তাছাড়া, কাঁঠাল এবং কোকাকোলা একসঙ্গে খেলে তিনটি সাপের কামড়ের সমান বিষক্রিয়া হতে পারে – এই দাবিটিও যৌক্তিক নয়। যেহেতু কাঁঠাল, ডুরিয়ান কিংবা আম উচ্চ শর্করাযুক্ত ফল, সেহেতু উক্ত ফলগুলো খেয়ে কার্বনেটেড কোকাকোলা বা অন্যান্য কোমল পানীয় অধিক পরিমাণে পান না করাটাই শ্রেয়। 

সুতরাং, সবকিছু বিবেচনা করে ফ্যাক্ট-ওয়াচ সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত পোস্টের দাবিকে “মিথ্যা” বলে সাব্যস্ত করছে।

এই নিবন্ধটি ফেসবুকের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রামের নীতি মেনে লেখা হয়েছে।।
এর উপর ভিত্তি করে ফেসবুক যে ধরণের বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এখানে
এছাড়া এই নিবন্ধ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন, সম্পাদনা কিংবা আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার জন্য আবেদন করতে এই লিঙ্কের সাহায্য নিন।

কোনো তথ্যের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকেঃ
ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh