মীরসরাইয়ের স্কুলে হিজাবের কারণে ছাত্রীকে মারধর – গুজব

Published on: April 11, 2022

‘‘চট্টগ্রামে হিজাব পরায় ছাত্রীকে হেনস্থা ও বেত্রাঘাত করেছে হিন্দু শিক্ষক তুষার কান্তি বড়ুয়া’’ -এই মর্মে একটি খবর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল। তবে এই ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, চট্টগ্রামের মীরসরাইয়ে জোরারগঞ্জ বৌদ্ধ উচ্চ বিদ্যালয়ে হিজাব পরার কারণে কোনো ছাত্রীকে বেত্রাঘাত এর কোন ঘটনা ঘটেনি।

গুজবের উৎস

গত ২৯শে মার্চ নয়া দিগন্তে এই সংবাদটি প্রথম দেখা যায় । মূলত নয়া দিগন্তের সংবাদ , এবং এর স্ক্রিনশটের মাধ্যমেই ফেসবুকে এই খবরটি ছড়িয়ে পরে। যেমন দেখুন এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে

পরে অন্য কয়েকটি ওয়েব পোর্টালেও এই সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছিল। যেমন- চট্টগ্রাম নিউজ ,অধিকার নিউজ , বাঙ্গি নিউজ ,জাতির বার্তা ইত্যাদি ।

নয়া দিগন্তে ২৯শে মার্চ তারিখে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে,  চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের জোরারগঞ্জ বৌদ্ধ উচ্চ বিদ্যালয়ে (জেবি) হিজাব নিষিদ্ধ করেছেন প্রতিষ্ঠানটির প্রধান শিক্ষক তুষার কান্তি বড়ুয়া। মঙ্গলবার (২৯ মার্চ) হিজাব পরিধান করে এক ছাত্রী স্কুলে গেলে তাকে হেনস্থা ও বেত্রাঘাতের অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে।

অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, প্রতিদিনকার মতো মঙ্গলবার সকালে হিজাব পরে বিদ্যালয়ে আসে অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থী লামিয়া বিনতিহাসহ আরো ৩ শিক্ষার্থী। সকাল ১১টার দিকে অ্যাসেম্বলি শেষে ক্লাস শুরুর আগে প্রধান শিক্ষক তুষার কান্তি বড়ুয়া তাদের ডেকে হিজাব খুলে ফেলতে বাধ্য করার চেষ্টা করেন। এ সময় অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী বিনতিহা হিজাব খোলার ব্যাপারে অস্বীকৃতি জানালে তাকে বেত্রাঘাত করেন প্রধান শিক্ষক।

এরপর মুহূর্তেই ঘটনাটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী ও বিনতিহার অভিভাবকরা স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে নালিশ করেন। এতে কোনো প্রতিকার না পেয়ে পরে বিনতিহা উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছে


লক্ষনীয়, এই লিখিত অভিযোগে বলা হয়েছে, আজ (২৯/০৩/২০২২) এসেম্বলির পরে আমাকে  (লামিয়া বিনতিহা ) প্রধান শিক্ষক কর্তৃক হিজাব পড়ার (পরার) কারনে সকলের সম্মুখে খোলা মাঠে শারীরিক নির্যাতন ও মানসিকভাবে হেনস্তার (হেনস্থার) শিকার হতে হয়েছে ।

অনুসন্ধান

জোরারগঞ্জ বৌদ্ধ উচ্চ বিদ্যালয় সম্পর্কে উইকিপিডিয়ায় বলা হয়েছে, জোরারগঞ্জ এলাকার জমিদার প্রয়াত যুবরাজ বড়ুয়ার চার সন্তান সমীর কান্তি বড়ুয়া, তুষার কান্তি বড়ুয়া, প্রসার কান্তি বড়য়া ও মিহির কান্তি বড়ুয়া এই বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁরা ১.৪৯ একর জমি এই প্রতিষ্ঠানকে দান করেন। ১৯৮৮ সালে বিদ্যালয়ের প্রাথমিক শাখা চালুর পর এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের অনুরোধে তাঁরা ১৯৯২ সালে ৬ষ্ঠ শ্রেণীর চালুর মধ্য দিয়ে মাধ্যমিক শাখা চালুর কার্যক্রম শুরু করেন। প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তুষার কান্তি বড়ুয়া।

স্পষ্টতই , তুষার কান্তি বড়ুয়া হিন্দু নন ,বরং বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। তার নামের ‘বড়ুয়া’ পদবীটা সে কথাই সাক্ষ্য দেয়।

ফেসবুকে অনেকেই তার বৌদ্ধ ধর্মের কথা উল্লেখ করছেন। যেমন –এখানে , এখানে , এখানে

তবে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া নয়া দিগন্ত পত্রিকার স্ক্রিনশটে তুষার কান্তি বড়ুয়াকে হিন্দু শিক্ষক হিসেবে দাবি করা হলেও,  নয়া দিগন্তের অনলাইন ভার্সনে পাওয়া বর্তমান ভার্সনে ‘হিন্দু শিক্ষক’ কথাটার উল্লেখ নেই। কেবলমাত্র মিরসরাইয়ে হিজাব পরায় স্কুলছাত্রীকে হেনস্থা ও বেত্রাঘাতের অভিযোগ শিরোনামটি দেখা যাচ্ছে।

অন্যদিকে , ১০ই এপ্রিল ঢাকা ট্রিবিউন মীরসরাইয়ে হিজাব পরায় মারধর: বানোয়াট কাহিনি, মেলেনি প্রমাণ শীর্ষক একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

এই প্রতিবেদনে বলা হয়,

গত মাসের শেষদিকে চট্টগ্রামের এক স্কুলছাত্রী অভিযোগ করে, হিজাব খুলতে রাজি না হওয়ায় প্রধান শিক্ষক তাকে গালমন্দ ও মারধর করেছেন। তবে ওই স্কুলছাত্রী এ দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ হাজির করতে পারেনি। ঢাকা ট্রিবিউনের অনুসন্ধানেও তার অভিযোগের সত্যতা মেলেনি।

ঘটনার দিন পিটি সেশনের পর তাকে মারধর করা হয় বলে ওই ছাত্রী অভিযোগ তুলেছিল। কিন্তু স্কুলের সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ ঘেঁটে দেখা গেছে, সেদিন সে পিটিতে অংশই নেয়নি। ওইদিন সে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে দেরিতে স্কুলে আসে। অভিযোগকারী ছাত্রী তার দুই সহপাঠীকে ঘটনার সাক্ষী হিসেবে দাবি করেছিল। তারা জানায়, সেদিন পিটির পর প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে ওই ছাত্রীর দেখাই হয়নি।

মীরসরাইয়ের ইউএনও মিনহাজুর রহমান জানান, অভিযোগটি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি), উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার, উপজেলা চেয়ারম্যান, জোড়ারগঞ্জ পুলিশ ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এবং স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সমন্বয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন।

ইউএনও মিনহাজুর রহমান আরো বলেন, “ওই ছাত্রীর অভিযোগের পক্ষে প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তদন্ত কমিটি সিসিটিভি ফুটেজ যাচাই করেছে। সেখানে মারধরের মতো কোনো কিছুই চোখে পড়েনি।”

স্কুল কমিটির সভাপতি মাকসুদ আহমেদ চৌধুরী জোড়ারগঞ্জ ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান। তিনি এ ঘটনায় একটি অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। সেই কমিটিও ওই ছাত্রীর অভিযোগের কোনো সত্যতা পায়নি।

তিনি আরও বলেন, “আমাদের স্কুলে ৭০টি সিসিটিভি ক্যামেরা আছে। পুরো স্কুলের সব জায়গা সার্বক্ষণিক সেগুলোর মাধ্যমে নজরদারি করা হয়। কর্তৃপক্ষ সবগুলো ফুটেজই পুঙ্খানুপূঙ্খভাবে খতিয়ে দেখেছে, কিন্তু এমন কিছু পাওয়া যায়নি। ওই ছাত্রীর অভিযোগ সন্দেহজনক।

মাকসুদ আহমেদ চৌধুরী আরও জানান, ওই ছাত্রীর মায়ের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন তিনি। অথচ এই অভিভাবক ঘটনার কিছুই জানেন না।

অনলাইন পোর্টাল বাংলাদেশের কথা ও একই বিষয়ে , মীরসরাইয়ে হিজাব পরায় মারধরের কাহিনি বানোয়াট  শিরোনামে  প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

একই বিষয় নিয়ে NewsBangla24 নামক অনলাইন পোর্টালে এবার চট্টগ্রামের স্কুলে হিজাব নিয়ে ভুয়া অভিযোগ  শিরোনামে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ,

মিরসরাইয়ের জোরারগঞ্জ বৌদ্ধ উচ্চ বিদ্যালয়ের চারপাশে সংযুক্ত ৭০টি সিসি ক্যামেরা। ঘটনার দিন পিটি সেশনের পরের সময়ের সিসিটিভি ফুটেজ এসেছে নিউজবাংলার হাতে।


ফুটেজে দেখা যায়, ২৯ মার্চ সকাল ১০টা ৫৪ মিনিটে পিটি শেষ হয়। এক মিনিট পর ছাত্রীরা স্কুল মাঠ থেকে শ্রেণিকক্ষে ঢুকছে। ১০টা ৫৫ মিনিট ৩২ সেকেন্ডের সময় স্কুল ড্রেসের সঙ্গে স্কার্ফ পরা তিন ছাত্রীকে ডেকে কথা বলেন সাদা শার্ট পরা প্রধান শিক্ষক তুষার কান্তি বড়ুয়া। এরপর ১০টা মিনিট ৩৪ সেকেন্ডের সময় ওই তিন ছাত্রী শ্রেণিকক্ষে চলে যায়।

সব শিক্ষার্থীর শ্রেণিকক্ষে ঢোকা শেষ হয় বেলা ১১টায়। এর দুই মিনিট পর আরেকটা ক্যামেরায় শিক্ষককে বিদ্যালয়ের ভেতরে ঢুকতে দেখা যায়। তিনি প্রথমে শিক্ষক মিলনায়তনে ও পরে নিজ কক্ষের দিকে যান। এ সময় তার হাতে একটি বেত ছিল।

এরপর ১১টা ৮ মিনিটে অভিযোগকারী লামিয়া আরেক ছাত্রীকে সঙ্গে নিয়ে শিক্ষক মিলনায়তনে গিয়ে বিদ্যালয়ের শিক্ষক রবিউল ইসলামের কাছে যান। এক মিনিট পর শিক্ষক রবিউলকে সঙ্গে নিয়ে শ্রেণিকক্ষের সামনে যান।

শ্রেণিকক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে শিক্ষক রবিউলের মোবাইল দিয়ে লামিয়া তার কথিত চাচার সঙ্গে ফোনে কথা বলার চেষ্টা করেন। এই সময় রবিউল অন্য একটি শ্রেণিকক্ষে ঢোকেন। এর মধ্যে লামিয়া তার সেই কথিত চাচর সঙ্গে ফোনে কথা বলতে না পেরে ১১ টা ১৩ মিনিটে ফোনটা ফেরত দিয়ে যান।

অভিযোগকারী লামিয়া বিনতিহা বলেন, ‘ওইদিন হেডস্যার অ্যাসেম্বলির পর আমাকে ডেকে হিজাব পরার কারণে মারধর করেন। পরে আমি রবিউল স্যারের কাছ থেকে ফোন নিয়ে বিষয়টি বাসায় জানাই। দুপুরে আমার চাচা এসে স্যারদের সঙ্গে কথা বলেছেন।’

সিসিটিভিতে কাউকে মারতে দেখা যায়নি জানালে সে বলে, ‘ওই তিনজনের মধ্যে আমি ছিলাম না। আমাকে একা ডেকেছিল স্যার।’

তাহলে সিসিটিভি ফটেজে নেই কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি জানি না।’

প্রাপ্ত তথ্য উপাত্তের আলোকে ফ্যাক্টওয়াচ ‘হিজাব পরায় ছাত্রীকে হেনস্থা ও মারধর’ শীর্ষক খবরটিকে গুজব হিসবে চিহ্নিত করছে।

 

সংশোধনী :  নয়া দিগন্তের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত খবরের বর্তমান ভার্সনের সাথে ভাইরাল হওয়া স্ক্রিনশট এর লেখার মিল না থাকায় , উক্ত স্ক্রিনশট যুক্ত ফিচার্ড ইমেজ সরিয়ে ভিন্ন ফিচার্ড ইমেজ যুক্ত করা হল।

আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন?
কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন?
নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?

এসবের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে জানান।
আমাদেরকে ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh

Leave a Reply