“শিক্ষা ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে হিন্দুরা” – দাবিতে প্রচারিত তালিকাটি বিভ্রান্তিকর

Published on: February 22, 2024

বিগত বেশ কয়েকবছর ধরে সামাজিক মাধ্যমে প্রায়ই শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বোর্ডের বিভিন্ন পদ এবং সেইসব পদে দায়িত্বরত ব্যক্তিদের নাম সংবলিত একটি তালিকা শেয়ার হতে দেখা গেছে এবং উক্ত তালিকার সাথে সংশ্লিষ্ট পোস্টে দাবি করা হচ্ছে যে, হিন্দুরা বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে! বরাবরের মতো সাম্প্রতিক সময়েও একই দাবি সংবলিত আরেকটি তালিকা সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার হতে দেখা যাচ্ছে। তবে ফ্যাক্টওয়াচ আলোচিত তালিকাতে যেসব পদ রয়েছে সেগুলোর বিপরীতে বর্তমানে দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের নাম যাচাই করে দেখেছে এবং নিশ্চিত হয়েছে যে, আলোচিত পদগুলোর বিপরীতে যেসব ব্যক্তিদের নাম রয়েছে তাদের সাথে বর্তমানে সেসকল পদগুলোর বিপরীতে দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের নামের কোন মিল নেই। তবে তারা পূ্র্বে বিভিন্ন সময়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্বরত ছিলেন এবং পরবর্তীতে অন্য পদ বা বিভাগে বদলি হয়ে চলে গিয়েছেন। তাই সঙ্গত কারণে ফ্যাক্টওয়াচ সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত পোস্টের দাবিগুলোকে “বিভ্রান্তিকর” বলে সাব্যস্ত করছে।

এমন কয়েকটি পোস্টের নমুনা দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এবং এখানে

 

ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধান:

সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত তালিকা এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট দাবিগুলো যথাযথ কিনা তা যাচাই করতে আমরা উক্ত তালিকাতে যেসকল পদ এবং সেগুলোর বিপরীতে দায়িত্বরত ব্যক্তিদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে তার সাথে বর্তমানে সেসকল পদে দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের নাম মিলিয়ে দেখেছি। উক্ত তালিকায় উল্লেখিত সতেরটি পদের বিপরীতে বর্তমানে কারা দায়িত্বরত আছেন তাদের নামসহ অনুসন্ধানে প্রাপ্ত ফলাফল নিচে আলোচনা করা হলো।

 

(০১) প্রাথমিক শিক্ষা অধিপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) শ্যামল কান্তি ঘোষ?

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের বর্তমান মহাপরিচালক (ডিজি) হচ্ছেন শাহ রেজওয়ান হায়াত, যিনি ২০ সেপ্টেম্বর ২০২২ থেকে এই পদে দায়িত্বরত আছেন। তবে অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে যে, শ্যামল কান্তি ঘোষ ১৪ জানুয়ারি ২০০৯ থেকে ০১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক পদে দায়িত্বরত ছিলেন।

 

(০২) পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) সচিব বজ্র গোপাল ভৌমিক?

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) এর বর্তমান সচিব হচ্ছেন মোসাঃ নাজমা আখতার। তাছাড়া, পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের বর্তমান কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তালিকায় বজ্র গোপাল ভৌমিকের নাম পাওয়া যায়নি।

 

(০৩) কারিগরি শিক্ষা অধিপ্তরের মহাপরিচালক ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব জনাব অশোক কুমার বিশ্বাস? 

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের বর্তমান মহাপরিচালক হচ্ছেন মোঃ আজিজ তাহের খান। তবে, অশোক কুমার বিশ্বাস উক্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক পদে ২৯ জুন ২০১৫ থেকে ২১ জানুয়ারি ২০১৯ পর্যন্ত দায়িত্বরত ছিলেন। তাছাড়া, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব পদে অশোক কুমার বিশ্বাসের নাম পাওয়া যায়নি। 

 

(০৪) সৃজনশীল পদ্ধতি বাস্তবায়নকারী মাধ্যমিক শিক্ষা খাত উন্নয়ন কর্মসূচির (সেসিপ) যুগ্ম পরিচালক রতন কুমার রায়?

অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, সৃজনশীল পদ্ধতি বাস্তবায়নকারী মাধ্যমিক শিক্ষা খাত উন্নয়ন কর্মসূচির (সেসিপ) যুগ্ম (প্রোগ্রাম) পরিচালক পদে বর্তমানে দায়িত্বরত কর্মকর্তা হচ্ছেন প্রফেসর ড. সামসুন নাহার।

 

(০৫) সৃজনশীল পদ্ধতি বাস্তবায়নকারী মাধ্যমিক শিক্ষা খাত উন্নয়ন কর্মসূচির (সেসিপ) বিশেষজ্ঞ ড. উত্তম কুমার দাশ?

আমাদের অনুসন্ধানে সৃজনশীল পদ্ধতি বাস্তবায়নকারী মাধ্যমিক শিক্ষা খাত উন্নয়ন কর্মসূচি (সেসিপ) এ “বিশেষজ্ঞ” নামক কোন পদ খুঁজে পাওয়া যায়নি। 

 

(০৬) ঢাকা বোর্ডের উপ-কলেজ পরিদর্শক অদ্বৈত কুমার রায়?

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের উপ-কলেজ পরিদর্শক পদে বর্তমানে দায়িত্বরত কর্মকর্তার নাম হচ্ছে মুহাম্মদ রবিউল আলম। 

 

(০৭) চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সচিব ড. পীযুষ কান্তি দন্ত?

অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের সচিব পদে বর্তমানে দায়িত্বরত আছেন প্রফেসর নারায়ণ চন্দ্র নাথ। 

 

(০৮) শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপ প্রধান তথ্য কর্মকর্তা সুবোধ চন্দ্র ঢালী?

আমাদের অনুসন্ধানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের “উপ-প্রধান তথ্য কর্মকর্তা” নামক কোন পদ খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য ও জনসংযোগ কর্মকর্তা পদে দায়িত্বরত মোহাম্মদ আবুল খায়ের নামক একজন কর্মকর্তার নাম পাওয়া গেছে। 

 

(০৯) বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের চেয়্যারম্যান নারায়ন চন্দ্র পাল?

অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) এর বর্তমান চেয়ারম্যান হচ্ছেন প্রফেসর মোঃ ফরহাদুল ইসলাম। 

 

(১০) ঢাকা বোর্ডের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক শ্রীকান্ত কুমার চন্দ্র?

অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, ঢাকার পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক পদে বর্তমানে দায়িত্বরত কর্মকর্তার নাম হচ্ছে প্রফেসর মোঃ আবুল বাশার।

 

(১১) শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব অজিত কুমার ঘোষ?

আমাদের অনুসন্ধানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের বর্তমান কর্মকর্তাদের তালিকায় অজিত কুমার ঘোষের নাম খুঁজে পাওয়া যায়নি। 

 

(১২) শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব পতিত পাবন দেবনাথ?

আমাদের অনুসন্ধানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের বর্তমান কর্মকর্তাদের তালিকায় পতিত পাবন কুমারের নাম খুঁজে পাওয়া যায়নি।

 

(১৩) শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব অসীম কুমার কর্মকার?

আমাদের অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, অসীম কুমার কর্মকার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব (বিধিবদ্ধ নিরীক্ষা) নামক পদে বর্তমানে দায়িত্বরত আছেন।

 

(১৪) শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-প্রধান স্বপন কুমার ঘোষ?

আমাদের অনুসন্ধানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের বর্তমান কর্মকর্তাদের তালিকায় যুগ্ম-প্রধান নামক কোন পদ কিংবা স্বপন কুমার ঘোষের নাম খুঁজে পাওয়া যায়নি। 

 

(১৫) শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের অতিরিক্ত সচিব শ্রী বনমালী ভৌমিক?

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের বর্তমান কর্মকর্তাদের তালিকায় শ্রী বনমালী ভৌমিকের নাম খুঁজে পাওয়া যায়নি।

 

(১৬) শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. অরুণা বিশ্বাস?

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের বর্তমান কর্মকর্তাদের তালিকায় ড. অরুণা বিশ্বাসের নাম খুঁজে পাওয়া যায়নি। 

 

(১৭) শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব স্বপন কুমার সরকার?

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের বর্তমান কর্মকর্তাদের তালিকায় স্বপন কুমার সরকারের নাম খুঁজে পাওয়া যায়নি।

 

অতএব, উপরের আলোচনা থেকে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে যে, সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত তালিকাটিতে উল্লেখিত প্রত্যেকটি পদের বিপরীতে যেসকল ব্যক্তিদের নাম উল্লেখ করা হয়েছিল তাদের সাথে বর্তমানে সেসকল পদে দায়িত্বরত, কেবল একজন ব্যতীত, কর্মকর্তাদের নামের কোন মিল নেই। তাছাড়া, সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত তালিকাটিতে প্রত্যেকটি পদের বিপরীতে যেসকল ব্যক্তিদের নাম রয়েছে তাদের প্রায় সবাই কোন না কোন সময় শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং বোর্ডের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে দায়িত্বরত ছিলেন এবং পরবর্তীতে অন্য কোন বিভাগ বা পদে বদলি হয়েছেন। 

উল্লেখ্য, বছর দুয়েক আগে সামাজিক মাধ্যমে সাম্প্রতিক সময়ের অনুরূপ একটি তালিকা ভাইরাল হয়েছিল যেখানে প্রত্যেকটি পদের বিপরীতে যেসকল (হিন্দু) ব্যক্তিদের নাম উল্লেখ করা হয়েছিল তাদের সাথে সেই সময় ঐ পদগুলোতে দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের নামের মিল খুঁজে পায়নি ফ্যাক্টওয়াচ। আমাদের ঐ প্রতিবেদনটি দেখুন এখানে

সুতরাং, সবকিছু বিবেচনা করে ফ্যাক্টওয়াচ সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত তালিকা এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট দাবিগুলোকে বিভ্রান্তিকর বলে সাব্যস্ত করছে।

এই নিবন্ধটি ফেসবুকের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রামের নীতি মেনে লেখা হয়েছে।।
এর উপর ভিত্তি করে ফেসবুক যে ধরণের বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এখানে
এছাড়া এই নিবন্ধ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন, সম্পাদনা কিংবা আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার জন্য আবেদন করতে এই লিঙ্কের সাহায্য নিন।

কোনো তথ্যের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকেঃ
ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh