ছবিটি সম্রাট শাহজাহান পত্নী মমতাজ মহলের?

Published on: February 25, 2024

সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমে একজন নারীর প্রতিকৃতি শেয়ার করে দাবি করা হচ্ছে যে, উনি সেই মমতাজ যার জন্য সম্রাট শাহজাহান তাজমহল নির্মাণ করিয়েছিলেন! তবে আলোচিত ছবিটির উৎস অনুসন্ধান করে জানা গেছে, উক্ত নারী প্রতিকৃতিটি ভারতের ভূপালের জমিদার নওয়াব শাহ জাহান বেগমের৷ তিনি তৃতীয় নারী জমিদার হিসেবে ভূপাল শাসন করেন। তাঁর শাসনামলে ভূপালের শিল্প, সাহিত্য, এবং স্থাপত্যশিল্প ভালো পৃষ্ঠপোষকতা পায় এবং বেশ উন্নতি লাভ করে। অন্যদিকে, সম্রাট শাহজাহানের স্ত্রী মমতাজ মহল ১৬৩৮ সালে মৃত্যুবরণ করেন যখন পৃথিবীর প্রথম ক্যামেরাটি উদ্ভাবিত হতে আরো দু’শ বছর বাকি! মূলত সম্রাট শাহজাহান এবং নওয়াব শাহ জাহান বেগম এর নামের মাঝে মিল থাকায় এই বিভ্রান্তিটির সৃষ্টি হয়েছে। তাই সঙ্গত কারণে ফ্যাক্টওয়াচ সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত ছবিটির সাথে সংশ্লিষ্ট দাবিকে “মিথ্যা” বলে সাব্যস্ত করছে।

এমন কয়েকটি পোস্টের নমুনা দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এবং এখানে

 

ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধান:

সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত নারী প্রতিকৃতিটি সম্রাট শাহজাহানের পত্নী মমতাজ মহলের কিনা তা যাচাই করতে আমরা সেটি নিয়ে রিভার্স ইমেজ সার্চ পদ্ধতিতে অনুসন্ধান করি। আমাদের অনুসন্ধানে আলোচিত প্রতিকৃতিটির বেশকিছু উৎস খুঁজে পাওয়া গেছে। উক্ত উৎসগুলোর ( ) মারফত জানা গেছে যে, এই প্রতিকৃতিটি ভূপালের তৃতীয় নারী শাসক নওয়াব শাহ জাহান বেগমের (জন্ম: ১৮৩৮, মৃত্যু: ১৯০১)। রয়াল কালকেশন ট্রাস্ট এর ওয়েবসাইট হতে প্রাপ্ত ভূপালের নওয়াব শাহ জাহান বেগমের ঐ প্রতিকৃতিটির বর্ণনা পড়ে জানা গেছে যে, ১৮৭৫ সালে ইংল্যান্ডের রাণী ভিক্টোরিয়া’র বড় ছেলে আলবার্ট এডওয়ার্ড, প্রিন্স অব ওয়েলস, ভারতীয় শাসক এবং ব্রিটিশ রাজের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করার লক্ষ্য নিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশের (বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়া) কয়েকটি দেশে ভ্রমণ করেন এবং ১৮৭৬ সালে ইংল্যান্ডে ফিরে যাওয়ার সময় তিনি এই ভ্রমণের স্মারক হিসেবে ছয়টি ছবির অ্যালবাম সাথে করে নিয়ে যান। নওয়াব শাহ জাহান বেগমের এই আলোচিত প্রতিকৃতিটিও সেই ছয়টি অ্যালবামের অন্তর্ভুক্ত ছিলো, যা বর্ন এবং শেফার্ড (Bourne and Shepherd) নামক দুজন ফটোগ্রাফার তুলেছিলেন।

 

ভূপালের নওয়াব শাহ জাহান বেগমের পরিচয়: 

১৮১৯ সালে ভূপালের জমিদার নওয়াব নজর মুহাম্মদ খানের আকস্মিক মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী কুদশিয়া বেগম ভূপালের প্রথম নারী জমিদার হিসেবে জমিদারিটি শাসন করেন। ৮২ বছর বয়সী কুদশিয়া বেগম মৃত্যুর আগে তাঁর সমস্ত সম্পত্তি নাতনী শাহ জাহান বেগমকে অর্পণ করে যান। শাহ জাহান বেগম ছিলেন কুূদশিয়া বেগমের মেয়ে সিকান্দার বেগমের মেয়ে। ১৮৪৫ সালে ব্রিটিশ সরকার শাহ জাহান বেগমকে ভূপালের শাসনকর্তা হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং সিকান্দার বেগমকে তাঁর প্রতিনিধি (Regent) হিসেবে নিয়োগ দেয়, কেননা শাহ জাহান বেগমের বয়স তখন মাত্র সাত বছর। অপ্রাপ্তবয়স্ক বা নাবালক শাসকদের ক্ষেত্রে শাসনকার্য পরিচালনা করার জন্য একজন রাজপ্রতিনিধি (Regent) নিয়োগ দেয়া হতো। শাহ জাহান বেগমের রাজপ্রতিনিধি হয়ে সিকান্দার বেগম প্রজাদের জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে বেশ ভালোভাবে কাজ করছিলেন। তিনি ভূপালে একটি মেডিকেল ডিপার্টমেন্ট স্থাপন করেন এবং ইউনানি শাস্ত্রে বিশেষজ্ঞ একজন মেডিকেল অফিসার সেখানে নিয়োগ দেন। ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহ তথা ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধে সিকান্দার বেগম ব্রিটিশদের সাথে মিলিত হয়ে কাজ করেন এবং বেশকিছু জায়গায় বিদ্রোহ দমন করে ব্রিটিশদের অনুগ্রহ লাভ করেন। সিকান্দার বেগমের আনুগত্যের প্রতিদানস্বরূপ ব্রিটিশ রাজ ১৮৬০ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁকে ভূপালের শাসনকর্তা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ১৮৬৪ সালে হজব্রত পালন করতে তিনি মক্কা গমন করেন এবং সেখান থেকে ফেরার পর ১৮৬৮ সালে অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।

সিকান্দার বেগমের মৃত্যুর পর তাঁর মেয়ে শাহ জাহান বেগম ভূপালের তৃতীয় নারী জমিদার হিসেবে শাসনভার হাতে নেন। তাঁর শাসনামলে ভূপালের শিল্প, সাহিত্য, শিক্ষা, এবং স্থাপত্যশিল্প বেশ উন্নতি সাধন করে। তিনি তাঁর পুরো শাসনামলে মেয়েদের জন্য দুটো গার্লস স্কুল এবং ৭৬টি প্রাইমারি স্কুল স্থাপন করেন। শিক্ষালাভে উৎসাহিত করার জন্য তিনি প্রতিটি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানে চাকরি লাভের জন্য স্কুল অথবা কলেজের সার্টিফিকেট প্রদর্শন করা বাধ্যতামূলক করে দেন। শাহ জাহান বেগমের পূর্ববর্তী দুজন নারী শাসক কুদশিয়া বেগম এবং সিকান্দার বেগম ভূপালের সামরিক বাহিনীকে শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে কাজ করেছেন, যা আমরা ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহ দমনে সিকান্দার বেগমের ভূমিকা থেকে বুঝতে পারি। অন্যদিকে, ভূপালের নতুন জমিদার শাহ জাহান বেগম তাঁর পূর্ববর্তীদের পথে হাঁটেননি। বরং তিনি শিল্প, সাহিত্য, এবং স্থাপত্যশিল্পের উন্নয়ন সাধনে অনেক পৃষ্ঠপোষকতা করেন। তিনি ভূপালে মুঘল সম্রাট শাহজাহনের তৈরি দিল্লি’র জামে মসজিদের অনুরূপ “Taj-ul-Masjid” নামক একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। তাছাড়া, নওয়াব শাহ জাহান বেগমের পৃষ্ঠপোষকতা এবং উদ্যোগে ১৮৮৯ সালে ইংল্যান্ডের প্রথম মসজিদটি নির্মাণ করা হয় যা “শাহ জাহান মসজিদ” নামেও পরিচিত। 

স্থাপত্যশিল্পে শাহ জাহান বেগমের উচ্চাকাঙ্ক্ষার পরিচয় মেলে তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় নির্মিত বিভিন্ন প্রাসাদ এবং ভবনে। তাজ-উল-মসজিদ বা ইংল্যান্ডের শাহজাহান মসজিদ ছাড়াও তিনি ভূপালে বেগমদের বসবাসের জন্য “তাজ মহল” নামে একটি প্রাসাদ নির্মাণ করেন। এছাড়া, সাঁচির বৌদ্ধ স্তূপ (Stupa) সংরক্ষণ এবং রক্ষার জন্য শাহ জাহান বেগম এবং তাঁর মেয়ে সুলতান জাহান বেগম আর্থিক সহায়তা প্রদান করেন। যার কৃতজ্ঞতাবশে তৎকালীন আর্কিওলজিকাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া এর ডিরেক্টর-জেনারেল জন মার্শাল তাঁর একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ “A Guide to Sanchi” বইটি সুলতান জাহান বেগমকে উৎসর্গ করেন। উল্লেখ্য যে, ১৯০১ সালে শাহ জাহান বেগমের মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার সূত্রে তাঁর মেয়ে সুলতান জাহান বেগম ভূপালের চতুর্থ নারী জমিদার হিসেবে ক্ষমতায় বসেন। উর্দু এবং ফারসি কবিতার প্রতি শাহ জাহান বেগমের আগ্রহের নমুনা পাওয়া যায়। তিনি মির্জা গালিবের সমসাময়িক অনেক কবিকে রাষ্ট্র কর্তৃক ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা করেছিলেন। তাছাড়া, হাসনারা বেগম, মনোয়ার জাহান বেগম, মুশাররফ জাহাম বেগম নামক অনেক মহিলা কবিকেও তিনি পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করেছিলেন। এছাড়াও, কবিতার প্রতি শাহ জাহান বেগমের আগ্রহ এতো বেশি ছিলো যে তিনি আবুল কাশিম মুহতেশাম নামক একজন কবিকে তাঁর দরবারে নিয়োগ দিয়েছিলেন মহিলা কবিদের লেখা ফারসি কবিতাগুলোর একটি সংকলন সংগ্রহ করতে। “Akhtar-i-taban” নামক এই সংকলনটি ৮১ জন কবির কবিতার সংগ্রহ নিয়ে ১৮৮১ সালে প্রকাশিত হয়। 

অতএব, উপরের আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পেরেছি যে, সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত নারী প্রতিকৃতিটি সম্রাট শাহজাহানের পত্নী মমতাজ মহলের নয়। বরং সেটি ভূপালের নারী জমিদার নওয়াব শাহ জাহান বেগমের প্রতিকৃতি, যা বর্ন এবং শেফার্ড নামক দুজন ফটোগ্রাফার ক্যামেরায় ধারণ করেছিলেন।

সুতরাং, সবকিছু বিবেচনা করে ফ্যাক্টওয়াচ সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত ছবিটির সাথে সংশ্লিষ্ট দাবিকে মিথ্যা বলে সাব্যস্ত করছে।

এই নিবন্ধটি ফেসবুকের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রামের নীতি মেনে লেখা হয়েছে।।
এর উপর ভিত্তি করে ফেসবুক যে ধরণের বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এখানে
এছাড়া এই নিবন্ধ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন, সম্পাদনা কিংবা আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার জন্য আবেদন করতে এই লিঙ্কের সাহায্য নিন।

কোনো তথ্যের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকেঃ
ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh