শাবিপ্রবি শিক্ষার্থীরা কি সারারাত মেয়েদের হল খোলা রাখার জন্য আন্দোলন করছে ?

Published on: January 23, 2022

সারা রাত মেয়েদের হল খোলা রাখার দাবি প্রত্যাখ্যান করায় বামপন্থী শিক্ষার্থীরা শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) উপাচার্য ফরিদ উদ্দীন আহমদের পদত্যাগের জন্য অনশন করছে—এমন একটি পোস্ট ফেসবুকে দেখা যাচ্ছে। ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা গত ১৩ই জানুয়ারি সুনির্দিষ্ট ৩ টি দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছিল। এবং এই ৩ টি দাবির মধ্যে ‘সারারাত মেয়েদের হল খোলা রাখা’র কোনো দাবি ছিল না।

গুজবের উৎস

মূলত , শ্রাবণ ইস্পাহানি নামক একটি পেজ থেকে শাবিপ্রবি’র চলমান আন্দোলন সম্পর্কে এই দাবি করা হয়। পরবর্তীতে আরো কয়েকটি পেজ এবং গ্রুপে শেয়ারের মাধ্যমে এটি ছড়িয়ে পড়ে। যেমন দেখুন এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে

এই পোস্টে বলা হয়, সারা রাত মেয়েদের হল খোলা রাখার দাবী প্রত্যাখ্যান করায় বামপন্থী শিক্ষার্থীরা শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবি প্রবি) উপাচার্য ফরিদ উদ্দীন আহমদের পদত্যাগের জন্য অনশন করছে। এদের সাথে যোগ হয়ছে জাফর ইকবাল, মামুন গংরা।

বামপন্থী শিক্ষার্থীরা বরাবরই মেয়েদের হল সারারাত খোলা রাখার দাবীতে আন্দোলন করে থাকে। কারণ তাদের তো কোনো নীতি-নৈতিকতা নাই, চরিত্র নাই। রাতের বেলা মেয়েদের হল খোলা থাকলে অশ্লীল-অশালীন কাজ করতে তাদের সুবিধা হয়, চরিত্রবান মেয়েদের চরিত্র নষ্ট করার সুযোগ পাওয়া যায়। শাবি প্রবির উপাচার্য ফরিদ উদ্দীন আহমদ বামপন্থী-নাস্তিক শিক্ষার্থীদের এই দাবীটা প্রত্যাখ্যান করায় তার পদত্যাগে দেশের সকল বামপন্থীরা একজোট হয়ে মাঠে নেমেছে, সাথে বামপন্থী মিডিয়াও।

এরপর শাবিপ্রবি ভিসি ফরিদ উদ্দিন আহমেদের ফাস হওয়া পুরনো একটি অডিও ক্লিপে বর্ণিত কথোপকথন কে সাম্প্রতিক আন্দোলনের কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়।

ফ্যাক্টওয়াচ অনুসন্ধান

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান ছাত্র আন্দোলনের সূচনা ঘটে গত ১৩ই জানুয়ারি বৃহস্পতিবার রাত থেকে।

সে রাতের ঘটনা প্রবাহ সম্পর্কে দেশ রূপান্তর এর এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,  পানি, সিট, ইন্টারনেট, খাবারসহ বেশ কিছু সমস্যা নিয়ে বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের আবাসিক ছাত্রীরা বৃহস্পতিবার রাতে হলের রিডিং রুমে আলোচনায় বসেন। আলোচনার মাঝে সমস্যাগুলো নিয়ে কথা বলার জন্য হলের প্রভোস্টকে ফোন দিয়ে অল্প সময়ের জন্য হলে আসার জন্য অনুরোধ করা হয়। প্রভোস্ট অসুস্থতার কারণে ছুটিতে থাকার কথা শিক্ষার্থীদের জানালে তারা প্রভোস্ট বডির কাউকে আধা ঘণ্টার জন্য হলেও পাঠানোর অনুরোধ জানান। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, তারা অনেক অনুনয়-বিনয় করে বিষয়টি জরুরি বলে জানালেও প্রভোস্ট গুরুত্ব দেননি। উল্টো শিক্ষার্থীদের বলেন, ‘কেউ তো মরেনি। বের হলে বের হয়ে যাও, কোথায় যাবা? আমার এত ঠেকা পড়েনি।’ প্রভোস্টের এমন মন্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়ে রাত ৯টার দিকে হল থেকে বের হয়ে বিক্ষোভ করতে থাকেন ছাত্রীরা। একপর্যায়ে রাত সাড়ে ১১টার দিকে উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদের বাসভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন তারা। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. আলমগীর কবির এবং ছাত্র উপদেশ ও নির্দেশনা পরিচালক অধ্যাপক জহীর উদ্দীন আহমেদসহ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনেকেই ছাত্রীদের শান্ত করতে সেখানে যান। কিন্তু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আসায় রাত ২টার দিকে উপাচার্য সেখানে গিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন এবং তাদের সঙ্গে বসে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করবেন বলে আশ্বস্ত করেন।

‘শিক্ষার্থীবান্ধব শাবিপ্রবি চাই’ নামক ফেসবুক পেজ থেকে ১৪ জানুয়ারি রাত ১ টা ১১ মিনিটেই ৩ দফা দাবির ব্যাপারে জানানো হয়েছিল। পরবর্তীতে ১৪ই জানুয়ারি থেকে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় এই ৩ দফা দাবি ছাপা হতে থাকে।

পরবর্তী দিনে (১৪ই জানুয়ারি) বেলা সাড়ে ১১টার দিকে উপাচার্যের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের ১০-১২ জনের একটি প্রতিনিধিদল আলোচনায় বসে। তবে এ বৈঠকে কোনো সমাধান না আসায় শিক্ষার্থীরা প্রশাসন ভবনের সামনে দিনভর অবস্থান কর্মসূচী চালিয়ে যান।

এই ৩ টি দাবি ছিল

১. শাবিপ্রবির বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের দায়িত্বজ্ঞানহীন প্রভোস্ট কমিটিকে পদত্যাগ করতে হবে।

২. অতিসত্বর একটি ছাত্রীবান্ধব এবং দায়িত্বশীল প্রভোস্ট কমিটি নিয়োগ দিতে হবে।

৩. অবিলম্বে যাবতীয় অব্যবস্থাপনা নির্মূল করে হলের সুস্থ-স্বাভাবিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।

বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় এই ৩ দফা দাবির কথা প্রকাশিত হয়েছিল তখন। যেমন – দেশ রূপান্তর , বাংলানিউজ টুয়েন্টি ফোর , মানব জমিন , প্রথম আলো , জনকন্ঠ ইত্যাদি ।

দেখা যাচ্ছে, এই ৩ দফা দাবির মধ্যে কোথাও ‘সারারাত হল খোলা রাখার দাবি’ অন্তর্ভুক্ত ছিল না।

আন্দোলনের পরবর্তী পর্যায়ে ১৬ই জানুয়ারি তারিখে আন্দোলনকারীরা শাবিপ্রবির উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদকে আইসিটি ভবনে অবরুদ্ধ করে। সেসময়ে পুলিশ-শিক্ষার্থী সংঘর্ষ ঘটে এবং পুলিশ উপাচার্যকে অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে উদ্ধার করে।

এই ঘটনার পর থেকে শিক্ষার্থীরা উপচার্যের পদত্যাগ এর একদফা দাবি নিয়ে আন্দোলন করছে।

অর্থাৎ, দেখা যাচ্ছে, আন্দোলনের কোনো পর্যায়েই রাতে হল খুলে রাখা সংক্রান্ত কোনো দাবি আলোচনায় আসেনি।

প্রসঙ্গ : উপাচার্যের অডিও ক্লিপ

বাংলানিউজ টুয়েন্টি ফোর ডট কম এর এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগ দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এরই মাঝে এই উপাচার্যের একটি বক্তব্য ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে।

ফেসবুকে ভাইরাল ওই অডিও বিষয়ে জানা যায়, গত বছর শাবিপ্রবির সমাবর্তন উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের হল বন্ধের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানান শিক্ষার্থীরা। তারা বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেন। এর অংশ হিসেবে উপাচার্যের সঙ্গেও তারা সাক্ষাৎ করেন। তখন তাদের দাবি ছিল ৩৬৫ দিন হল খোলা রাখা, ছেলে ও মেয়েদের ক্ষেত্রে হলে প্রবেশের সময়সীমা চাপিয়ে না দেওয়া। এ প্রেক্ষিতে এক ছাত্রলীগ নেতার বরাত দিয়ে ওই বিরূপ মন্তব্য করেন উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদ।

অডিওতে উপাচার্যকে বলতে শোনা যায়, ‘যারা এই ধরনের দাবি তুলেছে যে, বিশ্ববিদ্যালয় সারা রাত খোলা রাখতে হবে, অবশ্যই এই দাবিটা এসেছে এবং এইটা একটা জঘন্য রকম দাবি। আমরা মুখ দেখাইতে পারতাম না

এখানে আমাদের ছাত্রনেতারা বলছেন যে, জাহাঙ্গীরনগরের মেয়েদের কেউ সহজে বউ হিসেবে নিতে চায় না। কারণ সারা রাত এরা ঘুরাফিরা করে। বাট আমি চাই না যে, আমাদের যারা এত ভালো ভালো স্টুডেন্ট, যারা এত সুন্দর সুন্দর… আমাদের এখানকার যে ডিপার্টমেন্টগুলো এবং আমাদের যে বিখ্যাত শিক্ষকরা… তারা যাদের গ্র্যাজুয়েট করে তোমাদের বের করতে চায়, তাদের এ রকম একটা কালিমা লেপুক তাদের মধ্যে

শাবিপ্রবি উপাচার্য আরও বলেন, ‘ওই জায়গাটা কেউ চায় না, কোনো গার্জিয়ান চায় না কিন্তু। এখন, আমরা যদি কাউকে বলি, তোমার বাবা-মা কাউকে ফোন করব। তখন তোমরাই তো এটা বাধা দিবা না না না, এইটা হবে না, দেখ হয়রানি করতেছে। এটা তো প্রত্যেকের নৈতিক দায়িত্ব, তোমাদেরও নৈতিক দায়িত্ব যে, এই মেয়ে কেন রাতের বেলা সোয়া দশটা পর্যন্ত স্যাররে সময় দিছে। ’

উপাচার্য বলেন, ‘কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশে সোয়া দশটা পর্যন্ত মেয়েরা অফিসে থাকতে পারে না। তারপরেও আমরা সুযোগ দিয়েছি। কিন্তু তোমরা কেন বল না যে… কি তুমি একদিন রাস্তায় বের হও.. তোমরা, এটা বল যে, তুমি বারোটা-একটায় কী করতেছ? দুইটার সময় কী করতেছ?

‘আমি মাঝে মাঝে ঢাকা থেকে যখন আসি রাতে বারোটা-একটা বেজে যায়। আমি দেখি যে, আমাদের ওয়ান কিলোমিটার রাস্তা দিয়া ছেলেমেয়ে হাত ধরাধরি করে কনসালটিং করতেছে। একটা অঘটন ঘটলে কিন্তু দায়দায়িত্ব ভাইস চ্যান্সেলরকে নিতে হবে। যত দোষ, নন্দ ঘোষ। ভাইস চ্যান্সেলর দায়ী সে জন্য’।

শ্রাবণ ইস্পাহানির পেজ থেকে এই কথোপকথন এবং অডিও ক্লিপ এর প্রসঙ্গ তুলে ধরা হলেও, সেখানে উল্লেখ করা হয়নি যে এটি কতদিন আগের পুরনো ক্লিপ কিংবা কোন বছরের প্রসঙ্গ।

ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২ বছর আগে, ২০২০ সালের ৮ই জানুয়ারি তারিখে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই সমাবর্তন উপলক্ষে কয়েক মাস আগে নতুন করে বেশ কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করেছিল কতৃপক্ষ। যেমন-১৯শে নভেম্বর ২০১৯ বুধবার  এক নোটিশে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দুটি ছাত্রী হলের অবাসিকদের সন্ধ্যা ৭টার মধ্যে হলে ঢোকার নির্দেশ দেয় ।  একই সাথে, সমাবর্তন এর সময়ে সমাবর্তনের সময় ছাত্র হল বন্ধ রাখার ঘোষণা দেয়া হয়।

এই দু’টি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন সহ মোট ১৬ দফা দাবিতে তখন শাবিপ্রবি শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করেছিল।

৮ই ডিসেম্বর ২০১৯ তারিখে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসন পূর্বের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে, এবং ছাত্রী হল রাত ১০টা ১৫ মিনিট পর্যন্ত খোলা রাখার ঘোষণা দেয়। সমাবর্তন চলাকালীন সময়ে ছাত্র হল খোলা রাখা, রাত ১০ টা পর্যন্ত কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি খোলা রাখা সহ আরো বেশ কিছু সিদ্ধান্তের কথা তখন জানানো হয়।

অর্থাৎ, মেয়েদের হলের সময়সীমা সংক্রান্ত দাবিদাওয়া ২ বছরের পুরনো, এবং সেটা তখনই সমাধান হয়ে গিয়েছিল। সাম্প্রতিক সময়ে, অর্থাৎ ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে নতুন করে সময়সীমা সংক্রান্ত কোনো দাবি ওঠেনি। কেবলমাত্র ৩ দফা দাবিতেই শাবিপ্রবির শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করেছিল।

পুরনো ভিন্ন একটি আন্দোলন এবং দাবিকে বর্তমান আন্দোলনের সাথে জড়ানোর ফলে বিভ্রান্তি তৈরি হতে পারে। সার্বিক বিবেচনায় ফ্যাক্টওয়াচ এই পোস্টকে ‘মিথ্যা’ সাব্যস্ত করছে।

 

আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন?
কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন?
নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?

এসবের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে জানান।
আমাদেরকে ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh

Leave a Reply