শিশুর শরীরে ভেসে উঠছে কোরআন/হাদিসের বাণী — বারো বছর আগের পোস্ট

Published on: [July 23,2021]

‘‘প্রতি শুক্রবার এই শিশুর শরীরে পবিত্র কোরআন বা হাদিসের একেকটা বাণী লেখা ভেসে ওঠে!’’ -এমন শিরোনামে একটি পোস্ট গত কিছুদিন ধরে ভাইরাল হয়েছে। ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে দেখা গিয়েছে , এটা সাম্প্রতিক কোনো ঘটনা নয়, বরং ২০০৯ সালের ঘটনা এটি। সে সময়ে অনেক বড় বড় গণমাধ্যম এটি নিয়ে প্রতিবেদন করেছে। কিন্তু শিশুটির শরীরে এমন লেখা ‘ভেসে ওঠে’ নাকি কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে তার শরীরে এগুলো লিখে দেয়, সে বিষয়ে কেউ কোনো নিশ্চিত সিদ্ধান্ত দিতে পারে নি। তবে, ২০০৯ সালের ঘটনা ১২ বছর পর নতুন করে শেয়ার দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিতভাবেই বিভ্রান্তিকর।

বিভ্রান্তির উৎস

একাধিক অনলাইন নিউজ পোর্টালের খবর শেয়ারের মাধ্যমে ফেসবুকের বিভিন্ন পেজ এবং গ্রুপ থেকে এই পোস্ট টি শেয়ার হতে দেখা যায়। এমন কয়েকটি পোস্ট দেখুন এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে



ফেসবুক পেজ এ শেয়ার করা টুডে বিডি ২৪ ডট কম এর মূল নিউজ পোর্টাল এর খবরে বলা হয়েছে,

  উত্তর রাশিয়ার দাগিস্তানে এক মুসলিম পরিবারে জন্ম নেয় শিশু আলিয়া ইয়াকুব। প্রতি শুক্রবার তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে ত্বকের নীচে জমাট রক্তের মতো হরফে পবিত্র কোরআন বা হাদিসের একেকটা বানী লেখা ভেসে ওঠে। এর স্থিরচিত্র বিভিন্ন মানুষ তুলে রাখেন। বাড়িতে একটি অ্যালবামের প্রদর্শনী খোলা হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের একটি টেলিভিশন শিশুটির মায়ের সাক্ষাৎকার নেয়।

শিশুটির মা টেলিভিশনটিতে বলেন, ‘যে সময় তার দেহে আয়াত বা হাদিস ভেসে ওঠে এর আগে তার অনেক জ্বর আসে। সে সময় সে প্রচণ্ড কান্না করতে থাকে।

এরপর লেখাগুলো ভেসে উঠলে জ্বর কমে এবং কান্না থেমে যায়। দুধ পান করার সময়ও সে খুব শান্ত থাকে। ভিডিওটিতে শিশুটির নানা অঙ্গে আয়াত ও হাদিসের কিছু চিত্র দেখা যাবে। কিছু স্থিরচিত্র প্রদর্শনের জন্য রাখা হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ‘এটি আল্লাহর কুদরত ও মহানবী স-এর মুজিযা। যে কোনও কারণে আল্লাহ তা তার বান্দা অথবা প্রকৃতির মধ্যে প্রকাশ করে থাকেন। যাতে মানুষ শিক্ষা গ্রহণ ও ঈমান মজবুত করতে পারে ।

অনেকে বলছেন, ‘এটি ইমাম মাহাদির আগমনের অন্যতম নমুনা। কিয়ামতের নিদর্শনও হতে পারে এটি। শিশুটির পেটে ‘আল্লাহ গলায়, পায়ে, ঘাড়ে, পিঠে ও কানে আল্লাহর নাম।

পা থেকে উরু হয়ে কোমর পর্যন্ত লম্বা লেখাটি হচ্ছে একটি হাদিসের বানী। যার অর্থ, আমি যা জানি তা যদি তোমরা জানতে তাহলে হাসতে কম কাঁদতে বেশি। টিভিতে বলা হয়, প্রতিদিন আলিয়া ইয়াকুবদের বাড়িতে গড়ে ২ হাজার লোক বিস্ময়কর এ ঘটনা দেখতে আসেন।

 

একই খবর দেখা গেল আরো কয়েকটি অনলাইন পোর্টাল যেমন ডিজিটাল লাইভ নিউজ ,জেনে নিন, ক্লিক নিউজ লাইভ , নিউজ লাইট, কে নিউজ , আপডেট মিডিয়া ইত্যাদি ।

২০০৯ সালে এই খবর প্রথম বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল। (যেমন- এখানে এবং এখানে)

এর পর বিভিন্ন সময়েই বারবার এই খবর ছাপা হয়েছে। যেমন-  ২০১৯ সালেও একই খবর দেখা গিয়েছিল এখানে ,২০২০ এ দেখা গিয়েছে এখানে এবং  এখানে।

সংশ্লিষ্ট সংবাদমাধ্যমের সুত্র ধরে ফেসবুকেও গত ১২ বছরে বিভিন্ন সময়েই এই খবর এবং ছবি শেয়ার হতে দেখা গেছে ।

আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে এই খবর প্রথম পাওয়া যায় ২০০৯ সালে। ২২শে অক্টোবর তারিখে এই বাচ্চাটার সম্পর্কে প্রতিবেদন দেখা যায় রয়টার্স এবং এবিসি নিউজ এ ।

প্রায় কাছাকাছি সময়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল টেলিগ্রাফ , গার্ডিয়ান , ডেইলিমেইল , হাফিংটন পোস্ট সহ অনেক সংবাদমাধ্যমে ।

এসব খবর থেকে জানা যাচ্ছে , রাশিয়ার চেচনিয়া প্রদেশের সীমান্তবর্তী মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় এই বাচ্চার জন্ম হয়েছে । স্থানীয় পত্রিকায় ৯ মাস বয়সী এই বাচ্চার শরীরে আরবি কোরআনের আয়াত ভেসে ওঠার খবর পেয়ে আন্তর্জাতিক সাংবাদিকরা সেখানে যান। তবে বিদেশি সাংবাদিকরা সেখানে গিয়ে বাচ্চাটার শরীরে কেবলমাত্র একটি অক্ষর দেখতে পান। কারন ,তার শরীর থেকে অক্ষরগুলো সময়ের সাথে সাথে মুছে যায় , এবং কিছুদিন পরে পুনরায় আবির্ভূত হয় বলে জানা যায়।

শিশুটির নাম আলি ইয়াকুবভ( Ali Yakubov), মা মদিনা একজন গৃহকর্মী এবং বাবা শামিল একজন পুলিশ কর্মকর্তা।

এই এলাকায় বেশ যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে । ইসলামপন্থী বেশ কিছু সশস্ত্র গ্রুপ মাঝেমাঝেই এখানে হামলা চালায়। তাদের দমন করার জন্য সরকারী রাশিয়ান বাহিনীও বিভিন্ন সময় আক্রমণ করে। এই পটভূমিতে এই ‘অলৌকিক শিশু’র জন্ম স্থানীয়দের মধ্যে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। আলি ইয়াকুবভ কে দেখার জন্য তাদের বাসার সামনে দূর দূরান্ত থেকে অনেক দর্শনার্থী আসছে।

রয়টার্স এর সাংবাদিক কে আলি এর মা মদিনা বলেন, আল্লাহ আমার অলৌকিক শিশুকে পাঠিয়েছেন দাগেস্তান এর মানুষদের রক্ষা করার জন্য।

চেচনিয়া বর্ডার থেকে আলি কে দেখতে আসা দর্শনার্থী আহমেদ খাজদি বলেন, আল্লাহ দাগেস্তান কে দেখছেন ।

স্থানীয় ইমাম বলেন, এটা কেয়ামতের আলামত। পৃথিবী খুব দ্রুত ধ্বংস হয়ে যাবে।

কিজলায়ার অঞ্চলের প্রধান সাজিদ মুরতাজালিয়েভ বলেন, ভুলে যাওয়া যাবে না যে এখানে একটা যুদ্ধ চলছে। এই অলৌকিক শিশুর মাধ্যমে আল্লাহ আমাদের বলতে চাচ্ছেন, আমাদের উচিত এখন নেতৃত্ব দেওয়া এবং আমাদের ভাইদের সাহায্য করা।

‘রাশিয়ান কাউন্সিল অফ মুফতি’ এক বিবৃতিতে বলেছে, যারা যারা দাগেস্তান  এবং ককেশাস অঞ্চলের এই পূন্য ভূমিতে অশান্তি সৃষ্টি করেছে , তাদের সবারই নিজেদের কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা করা উচিত এবং সকল হানাহানি হিংসা বিদ্বেষ ভুলে যাওয়া উচিত।

ককেশাস রিসার্স সেন্টার অফ মস্কো’র ডেপুটি ডিরেক্টর ভ্লাদিমির জাকারভ বলেন, উত্তর ককেশাসের এই এলাকায় প্রাধান্য বিস্তার করে আছে ইসলাম এবং সন্ত্রাসবাদের ভয়। স্থানীয়রা সম্ভবত এই অলৌকিক ঘটনাকে ব্যবহার করছে অনিবার্য পরিণতিকে ভুলে থাকার জন্য।

অলৌকিক ঘটনা ? নাকি গুজব ?

ডিসকভার ম্যাগাজিন এ ফিল প্লেইট সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, শিশুটির মা নিজ হাতে বাচ্চাটার শরীরে কোরআনের আয়াত লিখে এটাকে অলৌকিক ঘটনা হিসেবে দাবী করতে পারেন। কারন , এটা কোনো ধরনের জন্মদাগ হয়ে থাকলে সেটা স্থায়ী হত। কিন্তু কোনো কালি দিয়ে লিখলে সেটা কিছুদিন পরেই মলিন হয়ে উঠে যাবে, যেটা ঘটছে আলি নামক এই বাচ্চার ক্ষেত্রে ।

ডেইলিমেইল এই প্রতিবেদন এর শিরোনাম করেছে- অলৌকিকতা নাকি গুজব ? (Miracle or Hoax?)

আলি সিনা ডট অর্গ নামের আরেকটা ওয়েবসাইট জানাচ্ছে, এটা বিরল এক ধরনের চর্মরোগ হতে পারে। Dermatographic urticaria নামের চর্মরোগের ক্ষেত্রে রোগীর শরীরে আকাবাকা অনেক রেখা ফুটে
ওঠে , যার সাথে অনেক সময় পরিচিত কোনো ভাষার অক্ষরের মিল পাওয়া যায়।

একই বিষয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করেছে নিউইয়র্ক টাইমস ,২০১১ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারি তে।
রাশিয়ার রেন টিভিতে প্রচারিত সাবেক গোয়েন্দা Anna Chapman এর টিভি অনুষ্ঠান ‘সিক্রেটস অফ দ্য ওয়ার্ল্ড’ এর বরাত দিয়ে সাংবাদিক Andrew E. Kramer এই প্রতিবেদনে আলি ইয়াকুবভ এর অলৌকিক ঘটনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে।

আনা চ্যাপম্যান এর শো তে একজন পেশাদার যাদুকর দেখান,কিভাবে রেড ওয়াইন এবং মেহেদি দিয়ে আলি ইয়াকুবভ এর শরীরের মতই একই রঙের লেখা ফুটিয়ে তোলা যায়।

সেই অনুষ্ঠানে একজন আরবি ভাষা বিশেষজ্ঞ জানান, আলিয়া ইয়াকুবভের শরীরের আরবি বাক্যে মাঝে বানান ভুল দেখা যায়। ( It cited an Arabist who noted that the messages on Ali’s skin sometimes appear with spelling errors)

আনা চ্যাপম্যান এর এই অনুষ্ঠান প্রচারের পর সাংবাদিক এন্ড্রু ক্রেমার দাগেস্তানে গিয়ে দেখতে পান, ইয়াকুবভ দের পরিবার আর কোনো সাংবাদিকের সাথেই কথা বলছে না। স্থানীয় বাসিন্দারাও বাচ্চাটা কোথায় কি অবস্থায় আছে, সেটাও বলছেনা। স্থানীয়রাও এ সম্পর্কে প্রায় ভুলে গেছে। আলির দাদী, জুলিখাতা ইয়কুবভা  (Zulikhata Yakubova)  বলেছেন, আমরা কোনো সাংবাদিককে বিশ্বাস করিনা। আর কখনো কোনো সাংবাদিকের কাছে আলিকে দেখাব না।

পরবর্তী বছরগুলোতে এই আলি ইয়াকুবভ এর আর কোনো ফলো আপ প্রতিবেদন প্রকাশিত হতে দেখা যায়নি। বাংলাদেশে নতুন করে যে প্রতিবেদন গুলো প্রকাশিত হয়েছিল সেগুলো সবই ২০০৯ সালের পুরনো খবর ই কপি করে প্রকাশ করা হয়েছিল।

সিদ্ধান্ত

আলি ইয়াকুবভ এর ছবিটি সাম্প্রতিক সময়ের নয় ,বরং ১২ বছরের পুরনো। খবরের মূল অংশে এটাকে যেভাবে অলৌকিক ঘটনা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, তেমন অলৌকিকত্বের নিশ্চিত কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি কখনো। ১২ বছরের পুরনো খবর বর্তমানে শেয়ার করার মাধ্যেম বিভ্রান্তির সৃষ্টি হচ্ছে বলে ফ্যাক্টওয়াচ মনে করে।

আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন?
কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন?
নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?

এসবের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে জানান।
আমাদেরকে ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh

 

Leave a Reply