“অচিরেই সমগ্র বিশ্ব ইসলামি বিশ্ব হবে” – রাশিয়ান পুরোহিতেরা বলেছেন এ কথা?

Published on: May 13, 2022

সম্প্রতিক সময়ে “রাশিয়ান পুরোহিতরা বলেছেন,অচিরেই সমগ্র বিশ্ব ইসলামি বিশ্ব হবে।” এমন একটি পোস্ট ফেসবুকে ভাইরাল হয়। পোস্টের ছবিতে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে একজন পুরোহিতকে দেখা যাচ্ছে।ফ্যাক্ট ওয়াচের অনুসন্ধানে জানা যায় ওই পুরোহিতের নাম পেট্রিয়ার্ক কিরিল। তবে মুসলিমদের নিয়ে তার  বিভিন্ন সময়ে দেওয়া বক্তব্যের সাথে পোস্টে উল্লেখিত বক্তব্যের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তাছাড়া সম্প্রতিক সময়েও এমন কোন বক্তব্য দেওয়ার প্রমাণ মেলেনি।

তাছাড়া পোস্টে আরো দাবি করা হয়, জার্মানিতে মুসলমানদের হার ৭০ শতাংশে পৌঁছেছে এবং ব্রাসেলসের জনসংখ্যার ৪৯ শতাংশ মুসলমান। কিন্তু ফ্যাক্ট-ওয়াচের অনুসন্ধানে দেখা যায় জার্মানিতে মুসলমানের জনসংখ্যা (৬.৪-৬.৭)% শতাংশ এবং ব্রাসেলসে মুসলমানদের জনসংখ্যা ১৭ %। ফ্যাক্ট-ওয়াচ তাই এসব দাবিকে “মিথ্যা” হিসেবে চিহ্নিত করছে।

গুজবের উৎস

 গত ৬ই মে Daily Insaf নামক একটি ফেসবুক পেজ থেকে একটি পোস্ট করা হয়। পোস্টের ছবিতে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে একজন পেট্রিয়ার্ক বা পুরোহিতকে দেখা যাচ্ছে। পোস্টের ক্যাপশনে বলা হয় “রাশিয়ান পুরোহিতরা বলেছেন,অচিরেই সমগ্র বিশ্ব ইসলামি বিশ্ব হবে।  রাশিয়া ও ইউরোপ শেষ হয়ে যাবে এবং ইসলাম বিশ্ব শাসন করবে। জার্মানিতে মুসলমানদের হার ৭০ শতাংশে পৌঁছেছে। রাশিয়ার লোকেরা গানের কনসার্টে যোগ দেয় এবং গির্জায় যায় না যখন মসজিদগুলি মুসলমানদের দ্বারা পূর্ণ থাকে। ইউরোপ শেষ হয়ে যাবে কারণ সে তার ধর্ম ত্যাগ করেছে। মুহাম্মদ নামটি যুক্তরাজ্য জুড়ে এবং ব্রাসেলসের জনসংখ্যার ৪৯ শতাংশ মুসলমান।

ইসলাম অচিরেই বিশ্ব শাসন করবে,ইনশাআল্লাহ।

আল্লাহ আমাদের নবী মুহাম্মাদ (সাঃ) এবং তাঁর পরিবারের সাথীদের উপর আশীর্বাদ ও বরকত দান করুন এবং অনেক শান্তি দিন, আমিন।”


পোস্টটি ভাইরাল হয় এবং বিভিন্ন পেজ,আইডি এবং গ্রুপ থেকে একই ধরনের  পোস্ট পাওয়া যায়।
এমনি কিছু পোস্ট এখানে , এখানে, এখানে, এখান, এখানে, এখানে

ফ্যাক্ট-ওয়াচের অনুসন্ধান

 ভাইরাল হওয়া পোস্টে পুতিনের সাথে যাকে দেখা যাচ্ছে তিনি পাট্রিয়ার্ক কিরিল। কিরিল মস্কো এবং অল রাশিয়ার সর্বোচ্চ সম্মানিত অর্থোডক্স বিশপ।

প্যাট্রিয়াক কিরিল বিভিন্ন সময়ে ইসলাম সম্পর্কিত যেসব বক্তব্য দিয়েছেন সেগুলো নিচে দেওয়া হলো:

২০১৫ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারী Radio Free Europe/Radio Liberty নামক সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত একটা প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে সেই সময় প্যাট্রিয়ার্ক কিরিল ইসলামিক জঙ্গী গোষ্ঠী আই এস -এর কঠোর সমালোচনা করেছে। প্যাট্রিয়ার্ক কিরিল বলেন “ আইএস সমগ্র বিশ্বের চোখে ইসলামের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করছে।”

কিরিল আরো বলেন “”ইসলামের জন্য এর চেয়ে ভয়ঙ্কর কিছু কল্পনা করা যায় না, যা তারা [আইএস জঙ্গিরা] করছে। সারা বিশ্ব টেলিভিশনে যে ছবিগুলি দেখছে — তা ইসলামের যেকোনো ইতিবাচক ভাবমূর্তি ধ্বংস করে”।

কিরিল বলেন “ আইএস জঙ্গিরা জ্ঞাতে এবং অজ্ঞাতে মধ্যপ্রাচ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে।”

কিরিলের মতে, “এই ঘটনার উৎপত্তি অন্বেষণ করা এবং এটি কতটা ইসলাম-বিরোধী এবং আরব-বিরোধী পদক্ষেপ তা বোঝার প্রয়োজন।”

তবে এখানে তিনি কোথাও ভাইরাল হওয়া উক্ত পোস্টের কোন বক্তব্য দেননি।

প্রতিবেদনটি দেখুন এখানে

কিরিল ২০১৮ সালের ২৮ এপ্রিল আলবেনিয়া যান। এটি ছিল কিরিলের প্রথম কোন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে ভ্রমণ। সেখানে তিনি বলেন “ ঐতিহাসিক শান্তি সফর উল্লেখযোগ্য এবং গুরুত্বপূর্ণ।”

এখানেও তার ভাইরাল হওয়া উক্ত পোস্টের কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

প্রতিবেদনটি দেখুন এখানে

২০১৯ সালের ২৫ জুলাই Arab News -এর একটি রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে পাট্রিয়ার্ক কিরিল পাট্রিয়ার্ক অফ মস্কো এন্ড অল রাশিয়ার হয়ে মুসলিম ওয়ার্ল্ড লীগের সাথে সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করেন।

সেই অনুষ্ঠানে প্যাট্রিয়ার্ক কিরিল বলেন “আপনি (ডা. মোহাম্মদ বিন আব্দুল করিম আল-ইসসা, মুসলিম ওয়ার্ল্ড লীগের জেনারেল সেক্রেটারী) এশিয়া এবং আফ্রিকার অনেক অভাবী মানুষকে সাহায্য করছেন এবং এটি আমাদের গভীর উদ্বেগের বিষয় এবং প্রশংসার বিষয়। এমডব্লিউএল(মুসলিম ওয়ার্ল্ড লীগ)-এর কার্যক্রমে আপনার ব্যক্তিগত অবদানের কারণে এটি খ্রিস্টান বিশ্বে সুপরিচিত হয়ে উঠেছে,সেইসব অসাধারণ কর্মকান্ড প্রশংসার যোগ্য। অর্থোডক্স চার্চের ইসলামী সমাজ এবং সম্প্রদায়ের সাথে একটি দূর্দান্ত সম্পর্ক রয়েছে এবং আমাদের দেশের মুসলিমদের সাথেও যোগাযোগ রয়েছে। রাশিয়ার ইতিহাস কখনো মুসলমানদের সাথে যুদ্ধ বা সংঘাত দেখেনি। যেহেতু অর্থোডক্স খ্রিস্টান এবং মুসলমানরা পশ্চিমা সভ্যতার অন্তর্গত, তাই আমাদের মধ্যে অনেক মিল রয়েছে। আমার কাজ … এই সত্যটি আমার কাছে খুব স্পষ্ট করে তুলেছে। আমি ধর্ম, সম্প্রদায় বা জাতি নির্বিশেষে রাশিয়ান জনগণের ঐক্যের উপর জোর দিয়েছি। রাশিয়া অন্য দেশ এবং ধর্ম ও সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের জন্য একটি উদাহরণ হিসাবে দাঁড় করাতে পারে।”

প্যাট্রিয়ার্ক কিরিল এই চুক্তি অনুষ্ঠানেও ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া পোস্টের কোন বক্তব্য দেন নি।

খবরটি দেখুন এখানে

২০২০ সালে প্যাট্রিয়ার্ক কিরিল জর্ডান সফরে যান। সফরকালীন সময়ে তিনি জর্ডানের রাজার সাথে দেখা করেন। কিন্তু তার জর্ডান সফরেও ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া পোস্টের উল্লেখিত কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

প্যাট্রিয়ার্ক কিরিল জর্ডান সফরের নিউজগুলো দেখুন এখানে, এখানে

পাট্রিয়ার্ক কিরিল রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের একনিষ্ঠ সমার্থক এবং রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণকেও সমর্থন করে বক্তব্য দিয়েছেন। তার মতে এটা শয়তানের শক্তির সাথে যুদ্ধ যা পবিত্র রাশিয়ার ঈশ্বরপ্রদত্ত ঐক্যকে ধ্বংস করতে চেয়েছে। রাশিয়া নিয়ে কিরিলের করা বিভিন্ন মতবাদ দেখুন এখানে 

তাছাড়া সম্প্রতিক সময়ে পাট্রিয়ার্ক কিরিলের বক্তব্যে যুদ্ধকে উস্কে দেওয়া এবং পুতিনকে একপাক্ষিক সমর্থনের জন্য পোপ ফ্রান্সিস তাকে সতর্ক করেছেন এবং তার এমন আচরণের জন্য ইইউ তাকে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার কথা ভাবছে।

এ বিষয়ক খবরগুলো দেখুন এখানে, এখানে

যেহেতু ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া উক্ত দাবির সাপেক্ষে নির্ভরযোগ্য কোন প্রমাণ মেলেনি এবং প্যাট্রিয়ার্ক কিরিলের মুসলিমদের নিয়ে বিভিন্ন সময়ে দেওয়া বক্তব্যেও তার কোন প্রমাণ মেলেনি তাই ফ্যাক্ট-ওয়াচ এটিকে গুজব হিসেবে চিহ্নিত করছে।

তাছাড়া ভাইরাল হওয়া পোস্টে দাবি করা হয় জার্মানিতে মুসলমানদের হার ৭০ শতাংশে পৌঁছেছে এবং ব্রাসেলসের জনসংখ্যার ৪৯ শতাংশ মুসলমান।

কিন্তু ফ্যাক্ট-ওয়াচের অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে ২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী জার্মানির জনসংখ্যার মাত্র ৬.৪ থেকে ৬.৭% অংশ মুসলিম।

তাছাড়া বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে মোট জনসংখ্যার ১৭% নাগরিক হলেন মুসলিম, অথচ ভাইরাল পোস্টে লেখা হয়েছে ৪০ শতাংশ।

তথ্যগুলো দেখুন এখানে, এখানে

ফ্যাক্টওয়াচ উক্ত দাবির সাথে মিল না পাওয়ায় এটিকে মিথ্যা হিসেবে চিহ্নিত করছে।

 

আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন?
কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন?
নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?

এসবের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে জানান।
আমাদেরকে ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh

Leave a Reply