বিএনপি রাজনীতিবিদদের ভিসা নিষেধাজ্ঞা নিয়ে ভুয়া তালিকা

Published on: September 30, 2023

বাংলাদেশের নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনীতিবিদসহ কয়েকটি শ্রেণি পেশার ব্যক্তিদের ওপর পূর্ব ঘোষিত ভিসা নিষেধাজ্ঞা কার্যকর শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র। যদিও মার্কিন প্রশাসন যাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে তাদের নাম প্রকাশ করেনি। তা সত্যেও ফেসবুকজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে ভিসা নিষেধাজ্ঞার বিভিন্ন তালিকা। এমন একটি তালিকা এবার বিএনপিপন্থী রাজনীতিবিদদের নামে ভাইরাল হয়েছে। সেখানে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ আরও একাধিক ব্যক্তির নাম রয়েছে। তবে ভিসা নীতির আওতায় ভিসা নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের নাম প্রকাশ না করার নীতি নিজ দেশের আইন অনুযায়ী অনুসরণ করছে যুক্তরাষ্ট্র। এ বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু  বলেছেন, “আমরা শুরু থেকেই বলেছি, এই নীতির আওতায় ভিসা নিষেধাজ্ঞা যাদের দেয়া হবে, তাদের নাম আমরা প্রকাশ করব না। কাউকে ভিসা না দেয়াসহ যে কোনো ভিসা রেকর্ড মার্কিন আইন অনুযায়ী গোপনীয় তথ্য”। সঙ্গত কারণে এমন তালিকা সর্বৈব মিথ্যা।

ভাইরাল পোস্টগুলোতে যেমনটি দাবি করা হয়েছেঃ

“অবশেষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়ছে বিএনপি। তারেক, মির্জা ফখরুল, রুহুল কবির রিজভী, আমানউল্লাহ আমান, হাবিব উন নবী সহ আরো ২৮০ জনের বিরুদ্ধে এই ভিসা নীতি আরোপ করা হয়েছে। তালিকায় অভিযুক্তদের নাম আসার কারণ বিস্তর। সে সম্পর্কে কর্তৃপক্ষ এখনো কিছু খোলাসা না করলেও গোপণ সূত্রের ভিত্তিতে জানা গেছে ; আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রোড মার্চ, সমাবেশের নামে সহিংসতা, আগুন সন্ত্রাস ফিরিয়ে আনার ষড়যন্ত্র, দেশকে অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টা এবং দুর্নীতির দুনিয়ায় তাদের অবাধ বিচরণই বিএনপির এসব নেতাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ালো। মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞায় মনক্ষুন্ন হয়েছে বিএনপি নেতাদের। বিএনপি ও আমেরিকার সম্পর্ক যেন মুখে মধু অন্তরে বিষ।“

গুজবের উৎস:

ভাইরাল দাবিটিকে বিশ্বাসযোগ্য করতে বিভন্ন পেজ থেকে NTV টেলিভিশনের একটি ফটোকার্ড প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, ফটোকার্ডটি NTV টেলিভিশন থেকে প্রচারিত হয়নি। NTV টেলিভিশনে এ ধরণের কোনো সংবাদই প্রচারিত হয়নি।

ফেসবুকে ভাইরাল পোস্টগুলো দেখুন এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে

 

ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধান:

বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করার উদ্দেশ্যে গত ২৪ মে যুক্তরাষ্ট্র নতুন এক ভিসা নীতি ঘোষণা করেছিল। ভিসা নীতিতে উল্লেখ ছিল যে, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে সরাসরি বাধাগ্রস্ত করা বা এর সাথে জড়িত থাকা যে কোনো বাংলাদেশি ব্যক্তির যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা বাতিল হয়ে যাবে। এই ঘোষণার প্রায় চার মাসের মাথায় গত ২২ সেপ্টেম্বর ভিসাসংক্রান্ত এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে বলে এক প্রেস বিবৃতির মাধ্যমে নিশ্চিত করেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র অধিদপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার।

বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের অফশিয়াল ওয়েবসাইটে গত ২২ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত ম্যাথিউ মিলারের প্রেস বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, “ডিপার্টমেন্ট অফ স্টেট বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ণ করার জন্য দায়ী বা জড়িত থাকা বাংলাদেশি ব্যক্তিদের উপর ভিসা বিধিনিষেধ প্রয়োগের পদক্ষেপ নিচ্ছে। এর মাঝে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, ক্ষমতাসীন দল এবং বিরোধী দলের সদস্যরা অন্তর্ভুক্ত আছেন।”

এই প্রেস বিবৃতি থেকে আরও জানা যায়, কেবলমাত্র এই তিন বিভাগের সদস্য ছাড়া আর কারও উপর এখন পর্যন্ত এই ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগের পদক্ষেপ নেয়া শুরু হয়নি। তবে, ভবিষ্যতে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ণ করার জন্য যে কেউ দায়ী বা জড়িত বলে প্রমাণিত হলে তার বিরূদ্ধেও একই পদক্ষেপ গ্রহণ করা হতে পারে। বিচার বিভাগের সদস্য, নিরাপত্তা পরিষেবার সদস্যরাও এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন।

ভিসা নীতি নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু ও সংবাদ মাধ্যম দ্য ডেইলি স্টার এর মধ্যে যে আলাপচারিতা হয় সেটি নিম্নরূপ:

দ্য ডেইলি স্টার: নতুন মার্কিন ভিসা নীতির আওতায় কাদের ফেলা হয়েছে? কতজনকে ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে? তাদের ভূমিকা অবস্থান কী ছিল?

ডোনাল্ড লু: আমরা শুরু থেকেই বলেছি, এই নীতির আওতায় ভিসা নিষেধাজ্ঞা যাদের দেওয়া হবে, তাদের নাম আমরা প্রকাশ করব না। কাউকে ভিসা না দেওয়াসহ যেকোনো ভিসা রেকর্ড মার্কিন আইন অনুযায়ী গোপনীয় তথ্য।

আমি এটুকু বলতে পারি যে এই নীতি ঘোষণা করার পর থেকে সার্বিক ঘটনা খুব কাছ থেকে আমরা দেখেছি। সাক্ষ্য-প্রমাণ ভালোভাবে পর্যালোচনা করার পর আমরা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, ক্ষমতাসীন দল বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্যদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছি।

এই নীতির উদ্দেশ্য হলো, সহিংসতা কমানো এবং অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করে এমন যেকোনো কর্মকাণ্ড প্রতিরোধ করার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের গঠনমূলক অংশীদার হওয়া। বিস্তারিত দেখুন এখানে

ভিসানীতি নিয়ে এর আগেও একটি ভুয়া তালিকা ভাইরাল হয়েছিল। তা নিয়ে ফ্যাক্টওয়াচের একটি প্রতিবেদন দেখুন এখানে।

এ নিয়ে আরও অনুসন্ধান করে  ইউএনবি নিউজের অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে গত ২৩ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়। সেখানে ইউএস দূতাবাসের মুখপাত্র ব্রায়ান শিলারের বরাত দিয়ে জানানো হয় যে, “যুক্তরাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী ভিসা সংক্রান্ত যাবতীয় রেকর্ড গোপন রাখা হয়।” যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র অধিদপ্তরের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট থেকেও এই একই তথ্য পাওয়া যায়। তবে আইনের বাইরে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যদি এই ভিসা নিষেধাজ্ঞা পাওয়া ব্যক্তিদের নাম প্রকাশ করে থাকে তাহলে স্বাভাবিক ভাবেই তার উল্লেখ মূলধারার সংবাদমাধ্যমে পাওয়া যেত। যদিও এখনো পর্যন্ত তার কিছুই পাওয়া যায়নি।

আরও লক্ষণীয় যে, ঢাকা পোস্ট একটি প্রতিবেদনে জানিয়েছে,ভিসানীতি নিয়ে প্রশাসনের মাঝেও নানা আলোচনা চলছে। বিভিন্ন মহল মোবাইলে একে-অন্যকে জিজ্ঞেস করছেন, কারা কারা ভিসা নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়লেন এবং ভবিষ্যতে কারা পড়তে পারেন।

অর্থাৎ, বাংলাদেশের যাদের উপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা শুরু হয়েছে, এখন তারা নিজে থেকে যদি নিশ্চিত না করেন, তাহলে বাইরের কারও পক্ষে এ সম্পর্কে জানা সম্ভব নয়।

কিন্তু, ভাইরাল পোষ্টগুলোতে বিএনপির যেসকল রাজনীতিবিদদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তাদের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো বিবৃতি নেই। তাদের পক্ষ থেকে এখনও এ সংক্রান্ত কোনো বিবৃতি দেখা যায়নি। সঙ্গত কারণে ভাইরাল পোস্টগুলোকে ফ্যাক্টওয়াচ “মিথ্যা” হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

এই নিবন্ধটি ফেসবুকের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রামের নীতি মেনে লেখা হয়েছে।।
এর উপর ভিত্তি করে ফেসবুক যে ধরণের বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এখানে
এছাড়া এই নিবন্ধ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন, সম্পাদনা কিংবা আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার জন্য আবেদন করতে এই লিঙ্কের সাহায্য নিন।

কোনো তথ্যের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকেঃ
ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh