উট কি আসলেই সাপ খায়?

Published on: December 28, 2022

বিভিন্ন সময়উট কেন সাপ খায়শিরোনামে একটি ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হতে দেখা গিয়েছে । এসব  ভিডিওতে জানানো হয়, উটেরহায়াম” নামক একটি রোগ থেকে মুক্তির জন্য উট সাপ খায় বা উটকে সাপ খাওয়ানো হয়। কিন্তু উটকে সাপ খাইয়ে দিলে কোন রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায় এমন কোন বৈজ্ঞানিক প্রমাণ ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে পাওয়া যায়নি। উটকে মরুভূমিতে মাঝে মাঝে সাপ খেতে দেখা গেছে, কিন্তু উটের “হায়াম” নামক রোগের কথা কোরান বা বিজ্ঞান কোথাও পাওয়া যায় নি। তাই ফ্যাক্টওয়াচ ভাইরাল পোস্টগুলোকেবিভ্রান্তিকরহিসেবে চিহ্নিত করছে।  

গুজবের উৎস

“উট কেন সাপ খায়” শিরোনামে বিভিন্ন সময়ে ফেসবুকে ভিডিও পোস্ট ভাইরাল হয়েছে।

এমনই কিছু ফেসবুক পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে,এখানে,এখানে,এখানে,এখানে,এখানে।

ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানঃ

Dhakanews.com থেকে প্রকাশিত ভাইরাল ভিডিওটির ০.৯ মিনিট থেকে ০.২৮ মিনিট পর্যন্ত বলতে শোনা যায় “পবিত্র কোরানে উটের একটি রোগের আলোচনা আছে, যে রোগ হলে উট একদম খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দেয়। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত উট শুধু সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকে। বিশেষজ্ঞগণ উটের এই রোগের ব্যাপারে গবেষণা করে কোন উৎস বা কারণ ব্যাখ্যা করতে পারেন নি। তবে এই রোগের নাম হলো হায়াম।”

 

এই দাবিটির কোনও সত্যতা পাওয়া যায়নি। দ্য লাস্ট ডায়ালগ এর এই নিবন্ধ থেকে জানা যাচ্ছে,  পবিত্র কুরআনে ১৫ টি আয়াতে ১৫ বার উটের কথা উল্লেখ আছে। কিন্তু এগুলোর কোথাও উটের ‘হায়াম’ নামক রোগ বা তার প্রতিকারের বিষয়ে কিছুই উল্লেখ নেই।

ইরানের সিরাজ ইউনিভার্সিটির ২ জন গবেষক Aliasghar Chalmeh  এবং Mohamadreza Farangi এর A quick look at camel’s names in holy Quran শীর্ষক গবেষণাপত্র থেকে জানা যাচ্ছে ,একবচন, বহুবচন এবং বিভিন্ন সমার্থক শব্দ মিলিয়ে কোরানে উট শব্দের ১১ টি রূপ রয়েছে কোরানে ।  এদের মধ্যে কয়েক জায়গায় উটের বদলে সকল প্রকার গবাদি পশুকে একত্রে বোঝানো হয়েছে। সব মিলিয়ে উট (বা গবাদি পশু) এর উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে ১৮ টা জায়গায় । এই ১৮ টা আয়াতের কোথাও ‘হায়াম’ বা এই জাতীয় উটের কোনো অসুখ পাওয়া গেল না।


WILD LIFE INFORMAR নামক ওয়েবসাইটের একটা নিবন্ধ থেকে জানা যাচ্ছে উট পানি ছাড়া এক সপ্তাহ বা দশদিন পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। তবে উট তৃষ্ণার্ত থাকলে একসাথে অনেক বেশি পরিমাণ পানি পান করে। এর পরিমাণ প্রায় ৩০ গ্যালন পর্যন্ত হয়ে থাকতে পারে। উট তার কুঁঁজে চর্বি আকারে জমা রাখে এবং প্রতিকুল পরিবেশে  এই চর্বি গলিয়ে পানি এবং খাবারের চাহিদা মেটায়। এই নিবন্ধ থেকে বোঝা যাচ্ছে, উট দীর্ঘদিন পানি অথবা খাবার না খেয়ে বাঁচতে পারে।

WILD LIFE INFORMAR এর আর্টিকেল দেখুন এখানে-

২০২২ সালের ১১ই আগস্ট উটের বিভিন্ন রোগের উপর Frontiers প্রকাশিত একটি আর্টিকেল পাওয়া যায়। উক্ত আর্টিকেলটি সৌদি আরবের কিং ফয়সাল ইউনিভার্সিটি এবং মিশরের কাফরেল শেখ ইউনিভার্সিটির বিশেষজ্ঞরা মিলে প্রকাশ করেছেন। কিন্তু উক্ত আর্টিকেলে কোথাও “হায়াম” বা এই ধরণের নামের উটের কোন রোগের নাম পাওয়া যায়নি।

Frontiers প্রকাশিত আর্টিকেলটি দেখুন এখানে-

THE DAILY WILDLIFE, WILDLIFEBoss এবং PetKeen  ওয়েবসাইটের আর্টিকেল থেকে জানা যাচ্ছে হায়াম (Hyam) নামক যে রোগের উল্লেখ করা হচ্ছে সেটা সম্ভবত ট্রাইপ্যানোসোমিয়াসিস (Trypanosomiasis) নামক একটি রোগ। ট্রাইপ্যানোসোমিয়াসিস টি. ইভানসি (T. evansi) নামক একটি পরজীবী দ্বারা সৃষ্ট একটি প্যাথোজেনিক প্রোটোজোয়াল রোগ। এই রোগটি মাছির কামড়ের মাধ্যমে ছড়ায় এবং এটি রক্তে সংক্রমিত হয়।

এই রোগের উপসর্গগুলো হলো  জ্বর, চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়া বা কান্না, রক্তশূন্যতা, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ফুলে যাওয়া, নিস্তেজ হওয়া, শক্তির অভাব, ক্ষুধা থাকা সত্ত্বেও খেতে না-পারা, শরীর ভেঙে পড়া, ইত্যাদি। যদি চিকিৎসা না করা হয় তবে এই রোগে মারা যাবার সম্ভাবনা শতভাগ।

 

এছাড়া “হায়াম” নামে উটের অন্য কোন রোগের প্রমাণ কোন বিশ্বাসযোগ্য সূত্র থেকে পাওয়া যায়নি। তাই বলা যায় হায়াম নামক যে রোগের কথা ভাইরাল ভিডিওগুলোতে বলা হয়েছে তা শুধুমাত্র আরব লোকদের লোকবিশ্বাস। উটের এই রোগের উপর বিশেষজ্ঞগণের গবেষণার কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে হায়াম রোগটাকে উটের ট্রাইপ্যানোসোমিয়াসিস রোগ হিসেবে ধারণা করা হয়। তবে উটের এই রোগ হলে তাকে সাপ খাইয়ে দিলে উট সুস্থ হয়ে যায় — এর কোন প্রমাণ নেই। এটাও শুধুমাত্র প্রচলিত লোকবিশ্বাস।

 

Dhakanews.com থেকে প্রকাশিত ভাইরাল ভিডিওটির ০.৩৩ মিনিট থেকে ১.১৭ মিনিট পর্যন্ত বলতে শোনা যায়, “কিন্তু আল্লাহ তায়ালা উটের হায়াম নামক রোগের শেফা রেখেছে পবিত্র কোরানে। এর মহৌষধ হচ্ছে একটি জীবিত সাপ খাইয়ে দেওয়া। অনেক সময় সে নিজে নিজেও তা খেয়ে থাকে। উটটি যখন সাপটিকে গিলে ফেলে এ অবস্থায় প্রচণ্ড তৃষ্ণা বাড়তে থাকে এবং আট ঘণ্টা এ অবস্থায় থাকে। আর তখন উটের চোখ থেকে অঝোর ধারায় পানি প্রবাহিত হতে থাকে। উটের চোখ থেকে যে পানি বের হতে থাকে তা খুবই মূল্যবান পানি। কেননা এ পানি অন্য পানি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এই চোখের পানিকে তিরয়াক বলা হয়। আর এই তিরয়াক এমন এক মহৌষধ যা কিনা যেকোন প্রাণীর বিষকে নষ্ট করার জন্য উপযোগী।”

 

উট কি সাপ খায়?

 

WILDLIFEBoss  এর আর্টিকেল থেকে জানা যাচ্ছে উট  মূলত তৃণভোজী প্রাণী। কিন্তু মরুভূমিতে খাওয়ার মতো যথেষ্ট পরিমাণ ঘাস সব সময় থাকে না। কিন্তু মরুভূমিতে অনেক বেশি পরিমাণে সাপ আছে। সম্প্রতি প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে ভারতসহ কিছু দেশে উটকে মাংসাসী আচরণ করতে দেখা গেছে এবং উট সাপও খায়। উট যখন খাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত ঘাস না পায় তখন সাপ খেয়ে থাকতে পারে।

গবেষণাটি দেখুন এখানে

Coachellavalley Preserve অর্গানাইজেশনের একটি নিবন্ধে বলা হচ্ছে, উট মূলত তৃণভোজী প্রাণী হলেও প্রচণ্ড ক্ষুধা বা খাদ্যসংকট থাকলে তাদের মধ্যে মাংসাশী প্রবণতা দেখা দেয়। অর্থাৎ তখন তারা প্রাণীদের মৃতদেহ, মাছের কাঁটা খেয়ে থাকে।

নিবন্ধে আরো বলা হয় যে, উট সাধারণত কখনো সাপ খায় না। উটের সাপ খাওয়ার পক্ষে কোনও জোরালো প্রমাণ নেই।

Coachellavalley Preserve অর্গানাইজেশনের আর্টিকেল দেখুন এখানে-

 

 

PetKeen ওয়েবসাইটের একটি নিবন্ধ থেকে জানা যাচ্ছে, সাপের বিষ ভিন্ন ভিন্ন ভঙ্গুর প্রোটিন দিয়ে তৈরি। সাপের বিষকে কার্যকর হওয়ার জন্য আক্রান্ত প্রাণীর রক্তের সাথে মিশতে হয়। বিষ রক্তের সাথে মিশে শরীরের বিভিন্ন প্রান্তে যায় এবং শরীরের সেসব অংশকে অকার্যকর করে দেয়। বেশিরভাগ সময় এটা নার্ভাস সিস্টেমে আক্রমণ করে। কোন সাপ যদি কোন উটকে কামড়ে দেয় তবে তা বিপুল পরিমাণ বিষ নিঃসরণ করতে পারে। এটা ঊটের জন্য বিপদজনক এমনকী মরণঘাতি হতে পারে। কিন্তু উট যদি সাপ খেয়ে ফেলে তাহলে উটের পরিপাকতন্ত্র সাপের বিষের প্রোটিন ভেঙে ফেলে। এরফলে মরণঘাতি বিষগুলো নিস্ক্রিয় হয়ে পড়ে। তখন উটের আর কোন ক্ষতি হবে না।

THE DAILY WILDLIFE, WILDLIFEBoss এবং PetKeen ওয়েবসাইটের নিবন্ধ থেকে আরো জানা যাচ্ছে “হায়াম” নামক রোগের চিকিৎসায় উটকে সাপ খাইয়ে দেওয়া শুধুমাত্র আরবের মানুষের লোক-বিশ্বাস। সাপ খাইয়ে দিলে উট কোন রোগ থেকে মুক্তি পাবে এর কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে বলা যায় উট খাবার না পেলে সাপ খেতে পারে। কিন্তু উট সাপ খায় কি খায় না — এটা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে।

তবে উটকে সাপ খাইয়ে দিলে কোন রোগের থেকে মুক্তি পায় এটার কোন বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই। তাছাড়া উটকে সাপ খাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা উটের জীবন-নাশের কারণ হতে পারে।

 

উটের কান্নার পানি কি বিষ নষ্ট করার ক্ষমতা রাখে

ভাইরাল ভিডিওতে বলা হয়েছে “উটটি যখন সাপটিকে গিলে ফেলে এ অবস্থায় প্রচণ্ড তৃষ্ণা বাড়তে থাকে এবং আট ঘণ্টা এ অবস্থায় থাকে। আর তখন উটের চোখ থেকে অঝোর ধারায় পানি প্রবাহিত হতে থাকে। এই চোখের পানিকে তিরয়াক বলা হয়। আর এই তিরয়াক এমন এক মহৌষধ যা কিনা যেকোন প্রাণীর বিষকে নষ্ট করার জন্য উপযোগী।”

PetKeen ওয়েবসাইটের আর্টিকেলে বলা হচ্ছে সাপ খাওয়ার পর উটের চোখ দিয়ে পানি পড়ে এর কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। আর উটের চোখের পানি মানুষের জন্য মহৌষধ এটারও কোন প্রমাণ নেই।

তবে THE DAILY WILDLIFE এর নিবন্ধে বলা হচ্ছে এটা শুধুমাত্র একটা লোক-বিশ্বাস, কোন মেডিকেল মরামর্শ নয়।

তবে উট অল্প পরিমাণ সাপের বিষের বিরুদ্ধে এন্টিবডি তৈরি করতে পারে। বৈজ্ঞানিকরা দেখেছেন মরুভূমির মতো প্রতিকূল পরিবেশে ঘোড়া বা ভেড়ার থেকে উটের এন্টিবডি অনেক বেশি কার্যকর। এ কারণে মরুভুমি অঞ্চলে সাপের এন্টিভেনাম তৈরির জন্য উটের ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তবে সেই অ্যান্টিভেনম কোনভাবেই উটের চোখের পানি দিয়ে তৈরি হয় না।

এ ব্যাপারে বিস্তারিত দেখুন এখানে, এখানে, এখানে

উপরোক্ত আলোচনা থেকে বলা যায় উট স্বল্প পরিমাণ সাপের বিষের বিরুদ্ধে এন্টিবডি তৈরি করতে পারে কিন্তু উটের কান্নার পানির বিষ নষ্ট করার কোন ক্ষমতা নেই।

তাছাড়া বাংলাদেশের জনপ্রিয় বিজ্ঞান কমিউনিটি ব্যাঙের ছাতার বিজ্ঞান (বিসিবি)ও উক্ত বিষয়ের উপর মিথ বাস্টিং রিপোর্ট লিখেছে।

বিসিবির রিপোর্ট দেখুন এখানে

সারমর্ম 

অতএব সার্বিকদিক পর্যালোচনা করে বলা যায়, ভাইরাল ভিডিওতে উটের হায়াম নামক যে রোগের উল্লেখ করা হয়েছে তা শুধুমাত্র লোক-বিশ্বাস। এই ধরণের কোন রোগের থাকার প্রমাণ গবেষণায় পাওয়া যায়নি। তাছাড়া উটকে সাপ খাইয়ে দিলে কোন রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায় এটারও কোন বৈজ্ঞানিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত থাকলে উটকে মাঝে মাঝে মরুভূমিতে সাপ খেতে দেখা গেছে। তাছাড়া উটের কান্নার পানি বিষ ধ্বংস করতে পারে বলে যে দাবিটি করা হয়েছে এটারও কোন বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই। তাই ফ্যাক্টওয়াচ ভাইরাল ভিডিওগুলোকে “বিভ্রান্তিকর” হিসেবে চিহ্নিত করছে।

আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন?
কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন?
নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?

এসবের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে জানান।
আমাদেরকে ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh