কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা গণতান্ত্রিক নির্বাচনের জন্য নতুন হুমকি?

Published on: December 11, 2023

 

আর্টিফিসিয়াল ইন্টিলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিশ্বজুড়ে ইতোমধ্যেই এক বৈপ্লবিক যুগের সূচনা করে ফেলেছে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনেও যোগ করেছে নতুন মাত্রা। যত দিন যাচ্ছে ততই বাস্তবসম্মত লেখা, ছবি ও ভিডিও তৈরি করতে সক্ষম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ক্রমাগত পরিশীলিত হয়ে উঠেছে। এর পাশাপাশি, দুর্ভাগ্যজনকভাবে, নতুন এই প্রযুক্তির অপব্যবহার করে গুজব ছড়ানো ও জনমতকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে, বিশেষ করে গণতান্ত্রিক নির্বাচনগুলোর প্রাক্কালে এই প্রবণতা আরও প্রকট হয়েছে। তাই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিশ্বব্যাপী গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য একটি বড় হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। 

 

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কি?

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা হলো যন্ত্রের মাধ্যমে মানুষের বুদ্ধিমত্তা অনুকরণ করতে সক্ষম এমন একটি প্রযুক্তি। অর্থ্যাৎ, এটি নির্দিষ্ট কোনো তথ্য থেকে নিজেই শিখতে পারে এবং নিজেকে পরিবর্তন করার ক্ষমতা রাখে। এই প্রযুক্তিগুলোর মধ্যে রয়েছে মেশিন লার্নিং (‍machine learning), স্বাভাবিক ভাষা প্রক্রিয়াকরণ (natural language processing)।

 

ভুয়া খবর ছড়ানোয়  কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার

 

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে গুজব বা অপতথ্য প্রাথমিকভাবে ছড়ায় সামাজিক মাধ্যমে। উন্নত অ্যালগরিদম দিয়ে ব্যবহারকারীর আচরণ, পছন্দ, অনলাইন ইন্টারঅ্যাকশন, প্রভৃতি বিশ্লেষণ করার কাজটি করা হয়। এই সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখে আমেরিকার একটি টেলিভিশন নিউজ প্রোগ্রাম পিবিএস নিউজ আওয়ারের নিবন্ধ দাবি করছে, ২০২৪ সালের মার্কিন নির্বাচনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তৈরি বিভ্রান্তিমূলক তথ্য ভোটারদের বিভ্রান্ত করতে পারে। এই সম্ভাবনাটি উদ্বেগজনক। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দ্রুত প্রচারণামূলক ই-মেইল, টেক্সট, ছবি বা ভিডিও তৈরি করতে পারে। প্রার্থীদের ছদ্মবেশ ধারণ করতে পারে। বেশ কয়েকটি উদ্বেগজনক পরিস্থিতি সম্পর্কে সতর্কবার্তা দেয়া হয়েছে। যেমন: একজন প্রার্থীর কণ্ঠ ব্যবহার করে একটি স্বয়ংক্রিয় বার্তা ভোটারদের ভুল তারিখে ভোট দেয়ার নির্দেশ দিচ্ছে। অন্য কোনো প্রার্থীর অডিও ব্যবহার করে কোনো অপরাধের স্বীকারোক্তি দিচ্ছে বা বর্ণবাদী মতামত প্রকাশ করছে। এগুলো মূলত ভোটারদের ভোট দেয়ার সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে উদ্দেশ্যমূলকভাবে তৈরি করা হচ্ছে। এছাড়া, ভিডিও ফুটেজে এমন কাউকে বক্তৃতা দিতে বা সাক্ষাৎকার দিতে দেখা যায়, যেগুলো তারা কখনও দেননি। ৯/১১ হামলার বিষয়ে একটি ষড়যন্ত্র তত্ত্বকে সমর্থন করার জন্য সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার একটি ডিপফেক ভিডিও তৈরি করা হয়েছিল। 

 

ভিডিওটি রক্ষণশীল মিডিয়া আউটলেট এবং ট্রাম্প সমর্থকদের দ্বারা সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার করা হয়। ইউটিউব থেকে সরানোর আগেই লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে বারাক ওবামার এই ডিপফেক ভিডিওটি পৌঁছে যায়। ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির একটি ডিপফেক ভিডিও তৈরি করা হয়েছিলো, যেখানে তার কথা অস্পষ্টভাবে শোনা যাচ্ছিলো এবং তাকে অসংলগ্ন বিবৃতি দিতে দেখা গিয়েছিলো।

ভিডিওটি সেই সময় সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপকভাবে শেয়ার করা হয় এবং অনেক লোক এটি বাস্তব বলে বিশ্বাসও করেছে। 

 

আরেকটি উদাহরণ দেয়া যাক। সিএনএন এর একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী সন্দেহভাজন চীনা প্রযুক্তিবিদেরা অনলাইনে আমেরিকান ভোটারদের পরিচয় নকল করার জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তৈরি ছবি ব্যবহার করছে ও বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। যেমন, কোনো একজন ভোটারের পরিচয় নকল করে অন্য আরেকজন ভোটারকে উৎসাহিত করা যেনো সে নির্দিষ্ট কোনো একটি প্রার্থী বা দলকে ভোট দেয় ২০২৪ সালের মার্কিন নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে বিভক্ত রাজনৈতিক ইস্যুতে আলোচনা উস্কে দিচ্ছে। এই হুমকি শুধুমাত্র এক দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় বরং এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা। স্বয়ংক্রিয় এক্স (সাবেক টুইটার) অ্যাকাউন্ট বা বট (bot) ব্যবহার করে ২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময়ে এবং পরে ভূয়া নিবন্ধ ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিলো। এই বটগুলি যে কোনো লেখাকে যথেষ্ট জনপ্রিয় ও বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে পারে, ফলে ব্যবহারকারীরা এটিকে ব্যাপকভাবে ছড়াতে উদ্ধুদ্ধ হয়।

ভারত বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ। সেখানেও ডিপ ফেক, ভূয়া খবর প্রচারে জেনারেটিভ এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নতুন হুমকি তৈরি করেছে৷ মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে দিয়ে নির্বাচনী প্রচারণার সময় জনমতকে প্রভাবিত করতে জাল ভিডিও, বক্তৃতা, সামাজিক মাধ্যম পোস্ট তৈরি করতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জুড়ি নেই। উদাহরণস্বরূপ, দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনের সময় ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) বর্তমান দিল্লি সরকারের সমালোচনা করার জন্য ডিপফেক প্রযুক্তি ব্যবহার করে। বর্তমান দিল্লি সরকারের মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের বিরুদ্ধে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) দিল্লি শাখার সভাপতি মনোজ তিওয়ারির করা কঠোর সমালোচনা হোয়াটসঅ্যাপে ভাইরাল হয়েছিলো। একটি ভিডিওতে মনোজ  তিওয়ারি ইংরেজিতে কথা বলছেন। অন্যটিতে তিনি হরিয়ানার হিন্দি উপভাষায় কথা বলছেন। যে কেউ ভিডিওটির বক্তব্যকে সত্য বলে মনে করতে পারেন। তবে ভিডিওটি ভূয়া ছিলো।

অথচ, ভিডিওটিকে আসল ভেবে দিল্লি ও এনসিআর অঞ্চলে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ জুড়ে এটি শেয়ার করা হয়েছিলো। কিন্তু আসল ভিডিও ছিল অন্যটা।  

 

বাংলাদেশেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে বানানো কিছু গুজব লক্ষ্য করা গেছে। যেমন: একটি নবজাতক শিশুর ভিডিও শেয়ার করে দাবি করা হয়েছিলো শিশুটি আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল ও কেয়ামতের আলামতের কথা বলছে। ঐ ভিডিওতে দেখা গেছে, নবজাতক শিশু কথা বলছে। পরে অনুসন্ধান করে দেখা যায় যে ঐ নবজাতক শিশুর ছবি কারেন কাসমাউস্কি (Karen Kasmauski) নামক এক ফটোগ্রাফার ২০০২ সালে তুলেছিলেন। তাছাড়া, বিভিন্ন নিবন্ধেও ছবিটি ব্যবহৃত হতে দেখা গেছে। মূলত, এই ছবিটি ব্যবহার করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে ভিডিওটি বানানো হয়। তবে বাংলাদেশের রাজনীতি বিষয়ক গুজবের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার এখনো তেমন ব্যাপকতা পায় নি। যেসকল রাজনৈতিক গুজব দেখতে পাওয়া যায় এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, গত ১২ অক্টোবর Voice of Bangladesh নামক ফেইসবুক পেজ থেকে প্রকাশিত একটি ভিডিও। “ফিলিস্তিন নয় যুক্তরাষ্ট্রকে খুশি রাখতে ইসরাইলকে সাপোর্ট করছে বিএনপি” শিরোনামে প্রকাশিত ভিডিওতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে কথা বলতে দেখা যায়। ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধান পরবর্তীতে এই ভিডিওকে ডিপফেক বলে চিহ্নিত করে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক, সামাজিক এবং গণতান্ত্রিক যেকোনো পরিস্থিতিকে প্রভাবিত করতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যাত্রা শুরু হয়েছে বলেই দেখা যাচ্ছে। জোর দিয়েই বলা যায় যে, সামনের দিনগুলোতে এই প্রযুক্তি-নির্ভর গুজব ব্যাপক জনপ্রিয়তা পাবে।

সমস্যার সমাধান করার জন্য সরকার, সুশীল সমাজ, প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর মধ্যে সমন্বয় জরুরি। উদাহরণস্বরূপ, মেটা বলছে, আগামী মার্কিন নির্বাচনে ভোটারদের সাহায্য করার জন্য রাজনৈতিক বিজ্ঞাপনগুলোতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তৈরি ছবি ব্যবহার করলে সেগুলো তারা দাগিয়ে রাখবে, মানে বলে রাখবে যে এগুলো এআই দিয়ে বানানো। এখন থেকে ফেসবুক এবং ইনস্টাগ্রামে চলমান রাজনৈতিক বিজ্ঞাপনগুলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে কি না, তা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে। সেপ্টেম্বরে গুগল রাজনৈতিক বিজ্ঞাপনের এআই (AI) ট্যাগিংয়ের জন্য একটি কৌশলও ঘোষণা করেছে। ইউটিউব বা অন্যান্য গুগল প্ল্যাটফর্মে রাজনৈতিক বিজ্ঞাপনগুলোতে ভয়েস বা ছবি পরিবর্তন করতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার করে নিজেদের চিহ্নিত করতে হবে। সেইসাথে এআই অ্যালগরিদমে স্বচ্ছতা, কঠোর প্রবিধান, বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণা সনাক্ত ও প্রতিরোধের জন্য সক্রিয় গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। 

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বৈশিষ্ঠ্যগত কারণে এটিকে নিয়ন্ত্রণ করা যথেষ্ট কষ্টসাধ্য। এর দ্রুত বিবর্তন একে মোটামুটি ধরাছোঁয়ার বাইরেই নিয়ে যাচ্ছে। এর নিয়ন্ত্রণে একইসঙ্গে দরকার প্রযুক্তি-বান্ধব সুনির্দিষ্ট নীতিমালা এবং জনগণের প্রযুক্তি-স্বাক্ষরতা। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মন্দ ব্যবহারের বিরূদ্ধে লড়াই করতে হবে দুই ফ্রন্টেই।