কবরে “অলৌকিক” আগুনের ভিডিও ভাইরাল

Published on: January 17, 2022

কবরের মধ্যে জ্বলন্ত আগুনের একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। দাবি করা হচ্ছে, এটি একটি অলৌকিক ঘটনা। কবরের মধ্যে উক্ত ব্যক্তি জীবিত অবস্থায় অনেক খারাপ কাজ করেছিল,তাই শাস্তি স্বরুপ এখন তার কবরের মধ্যে অলৌকিক উপায়ে আগুন জ্বলছে-এমন দাবি করছে কয়েকটি ফেসবুক পেজ। তবে অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা জানাচ্ছেন, উদ্দেশ্যমূলকভাবে একটি কবরের মধ্যে দাহ্য পদার্থে আগুন জ্বালিয়ে কিছু তরুন ফেসবুকে ভাইরাল হওয়ার জন্য এই  বিভ্রান্তিকর বার্তা সম্বলিত ভিডিওটা ছড়িয়েছে। এখানে অস্বাভাবিক বা অলৌকিক কোনো ঘটনা ঘটেনি।

গুজবের উৎস

ভাইরাল হওয়া কয়েকটি ভিডিও দেখুন এখানে , এখানে , এখানে , এখানে  ।

অনেকে আবার এসব ভিডিওকে নির্দিষ্ট এ্যাপ এর মাধ্যমে ‘লাইভ’ হিসেবে প্রচার করেন, যার ফলে দর্শক মনে করে, আগুনের ঘটনাটা সরাসরি ঘটছে।

কি বলা হচ্ছে এসব ভিডিওতে ?

১ মিনিট ৫২ সেকেন্ডের মূল ভিডিওতে ভাষ্যকারকে কোনো কথা বলতে শোনা যায়নি। নির্জন একটি কবরস্থানের পাশে ক্যামেরাপার্সন সামনে পিছনে হেটে হেটে নির্দিষ্ট একটি কবরের মধ্যে জ্বলন্ত আগুনের ভিডিও করছেন বলে ভিডিওতে বোঝা যাচ্ছে। এসময় কাছাকাছি একটি কবরের এপিটাফে ‘মরহুম মোজাম্মেল হক’ নামটি দেখা গেল।

এই ভিডিওটাই বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ক্যাপশন সহযোগে ভাইরাল হয়েছে।

যেমন- ভৈরব ইসলামিক চ্যানেলে আপলোড করা ভিডিওর ক্যাপশনে বলা হয়েছে , সিরাজগঞ্জ শহরের রহমতগঞ্জ কবর স্থানে (10.01.2022) এক জনের কবরে হঠাৎ দাঊ দাঊ করে আগুন 🔥🔥 জ্বলে ওঠে। হে আল্লাহ আপনি আমাদের সবাইকেই মাফ করে দিন।

একইসাথে, এই ভিডিওর ব্যাকগ্রাউন্ডে মৃত্যু এবং কবরের আজাব সম্পর্কিত একটি গজল ( ইসলামী ভক্তিমূলক সঙ্গীত) যুক্ত করা হয়েছে ।

M Sabbir Ahmed Osmani পেজ থেকে এই ভিডিও আপলোড করে বলা হয়েছে , কবর স্থানের একটি কবরে ১০ দিন হল আগুন জ্বলছে।

‘দীনের পথে আসো ইসলাম কে জানো’ গ্রুপে আপলোড করা ভিডিওর ক্যাপশন ছিল- ইন্না-লিল্লাহ!!!  আল্লাহর সতর্ক বার্তা 😢 সিরাজগঞ্জের হাতুড়ি পাড়ায় একটি কবর হতে আগুন জ্বলছে। আল্লাহ হেফাজত করুক।

‘ইসলামের পথ’ নামক ফেসবুকে পেজের ভিডিওর ক্যাপশনে বলা হয়, ইন্না-লিল্লাহ, সিরাজগঞ্জ রাঙ্গামাটির এক কবরে ভয়াবহ আগুন😭😭😭

মায়াবী মায়া’ পেজ থেকে বলা হয়, কবর স্থানে এক কবরে আগুন,, হে আল্লাহ এই কবরের আযাব থেকে আমাদের সবাইকে রক্ষা কর,, আমিন।

AH Agun Hussain লিখেন , কবরে আগুন। সিরাজগঞ্জের এক কবরস্থানের কবরে দাও দাও করে আগুন জ্বলছে,,,,হে মহান প্রভু, অসীম শক্তির মালিক আমাদের এমন আজাব থেকে রক্ষা করো আমিনপ্লিজ শেয়ার করে মানুষদেরকে দেখার সুযোগ করে দিন, যেনো মানুষ আল্লাহর নাফরমানী না করে!!!

RA Media ক্যাপশনে জানায়, কিয়ামতের আলামত দেখুন খারাপ মানুষের কবরে কিভাবে আগুন জ্বলছে।


ফেসবুক অঙ্গন ছাড়িয়ে ইউটিউবেও এই ভিডিও ভাইরাল হতে দেখা যায়। যেমন দেখুন- এখানে , এখানে

ফ্যাক্টওয়াচ অনুসন্ধান

সিরাজগঞ্জের কবরে আগুন নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যমুনা টিভি , মানব জমিন , জাগো নিউজদি ডেইলি ক্যাম্পাস , বার্তা টুয়েন্টিফোর সহ অনেক সংবাদমাধ্যম।


যমুনা টিভির প্রতিবেদন থেকে এখানে কিছু অংশ উদ্ধৃত করা হল।

স্থানীয় বাসিন্দা মনির রহমান যমুনা মিউজকে জানান, গত ১০ জানুয়ারি সন্ধ্যায় মাগরিবের নামাজের সময় কে বা কারা কবরস্থানের পলিথিন ও কাগজ দিয়ে আগুন লাগিয়ে দেয়। এবং সেটা ভিডিও করে ভাইরাল করার জন্য ফেসবুকে আপলোড করে। ভিডিও দেখে গত তিনদিন থেকে কবরস্থানে লোকজন সমাগম করে। তবে কারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে তা আমরা কেউ দেখিনি।

স্থানীয় চা দোকানদার মোস্তফা শেখ বলেন, আমরা মাগরিবের নামাজ শেষ করে বের হয়ে দেখি কবরস্থানে আগুন জ্বলছে। মসজিদ থেকে মুসুল্লিদের বের হতে দেখে কয়েক জন ছেলে দৌড়ে পালিয়ে যায়। তবে তারা কারা ছিলো তা কেউই নিশ্চিত করতে পারেনি।

কবরস্থানের খাদেম আফজাল হোসেন জানান, কবরস্থানের কিছু পলিথিন কাগজ ও গাছের পাতা একত্রিত করে কে বা কারা আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। আমরা মাগরিবের নামাজ শেষে একটি কবরে আগুন জ্বলতে দেখতে পাই। পরে আমরা পানি দিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনি। কেউ হয়তো ইচ্ছে করেই মোবাইলে প্রচার করার জন্য এ কাজ করেছে।

আরেক স্থানীয় বাসিন্দা জনি আহম্মেদ বলেন, যারা এটি করেছে হয়তো তাদের উদ্দেশ্যই ছিল ভিডিওটি ফেসবুকের মাধ্যমে ভাইরাল করে তাদেরকে ফেসবুক পেজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। বিষয়টি নিয়ে গুজব না ছড়ানোর জন্য অনুরোধ জানান তিনি।

ওই এলাকার কাউন্সিলর মো. জুলফিকার হাসান খান জানান, কিছু কুচক্রী ইসলাম বিরোধী কুসংস্কার রটানোর জন্য এসব করেছে। কবরস্থানে পরিত্যক্ত আগাছা আর শুকনা পাতায় কে বা কারা অগুন ধরিয়ে দেয়। এতে তারা নিজেদের ফায়দা লুটতে চেয়েছিলো। আমরাও এসব ছেলেদের খুঁজছি। পাওয়া মাত্র তাদের প্রশাসনের হাতে তুলে দেয়া হবে। এটি ঘটনা সম্পূর্ণ সাজানো, এটি কোনো অলৌকিক ঘটনা নয়।

সিরাজগঞ্জ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম জানান, আমার মনে হয় ওরা টিকটক বানানোর জন্যই এ কাজ করেছে। কেউ যেন এ নিয়ে মিথ্যে সংবাদ প্রচার না করে সে দিকটা খেয়াল রাখবেন বলে সাংবাদিকদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

অনুসন্ধানে কোনো সাংবাদিকই এখানে অলৌকিক কোনো ঘটনা দেখতে পাননি, কিংবা ১০ই জানুয়ারি ছাড়া অন্য কোনো দিনে এমন কোনো আগুন সেখানে জ্বলতে দেখা যায়নি। এটাকে সাজানো ঘটনা হিসেবেই সকলে সাক্ষ্য দিচ্ছে।

সার্বিক বিবেচনায় ফ্যাক্টওয়াচ আলৌকিক আগুনের এই দাবিকে ‘মিথ্যা’ সাব্যস্ত করছে।

আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন?
কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন?
নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?

এসবের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে জানান।
আমাদেরকে ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh

Leave a Reply