নারকেল টুকরা ভিজিয়ে গরম পানি পানে ক্যান্সার কোষ ধ্বংস হয়? রক্ত জমাট বাঁধে না?

Published on: May 1, 2023

ভারতের টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতালের পরিচালক ড. রাজেন্দ্র বুড়বের নামে সম্প্রতি ক্যান্সার নিয়ে একটি পরামর্শ ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। পরামর্শটিতে দাবি করা হচ্ছে নারকেলের গরম জল ক্যান্সারের কোষ নষ্ট করে দেয়। ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া পোস্টে আরো বলা হয়েছে ফুটানো নারকেলের জল আলসার এবং টিউমার নষ্ট করে।

ফ্যাক্ট-ওয়াচের অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে “গরম নারকেলের জল ক্যান্সারের কোষ নষ্ট করে” এমন কোন পরামর্শ  টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতালের পরিচালক ড. রাজেন্দ্র বুড়বে দেয়নি।এক বিবৃতিতে তিনি তাঁর নামে ছড়ানো এই গুজবের ব্যাপারে সতর্ক করেছেন এবং  ক্যান্সার নিয়ে এ ধরণের ক্ষতিকর বার্তা না ছড়াতে অনুরোধ করেন। অন্যান্য ক্যান্সার বিশেষজ্ঞরাও এমন দাবির কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই বলে জানিয়েছেন।

গুজবের উৎস

সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে

পূর্বে বিভিন্ন সময়ে ভাইরাল হয়েছে এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে

এসব পোস্টে মূলত ৪ টি দাবি করা হয়েছে।

১। টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতালের ড রাজেন্দ্র এ বুড়বে ক্যান্সার প্রতিরোধের জন্য নারকেল ফুটানো গরম জল খেতে পরামর্শ দিয়েছেন।

২। নারকেলের টুকরো যুক্ত গরম জল পান করলে ক্যান্সার কোষ ধ্বংস হয়ে যায়।

৩। নারকেলযুক্ত গরম জল আলসার এবং টিউমার নষ্ট করে।

৪। নারকেলের এ্যমিনো এসিডের পলিফেনল উচ্চ রক্তচাপ কমায়, রক্তে দানা বাঁধতে দেয় না এবং থ্রম্বসিস থেকে রক্ষা করে।

 

ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধান

দাবি ১

১৮ মে, ২০১৯ তারিখে  The Times of India “গরম নারকেলের পানি ক্যান্সার সারাতে পারে না : হাসপাতাল” শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেই প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে “নারকেল ফুটানো গরম জল ক্যান্সারের কোষ নষ্ট করে” এমন বার্তাটি ২০১৯ সালে ভারতে ভাইরাল হয়েছিলো। ভারতে ভাইরাল হওয়া ক্যান্সার বিষয়ক পরামর্শটির উৎস হিসেবে টাটা মেমোরিয়াল হসপিটালের পরিচালক ড. রাজেন্দ্র বুড়বের (Dr Rajendra Badwe) নাম উল্লেখ করা হয়।

উক্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায় ১৬ই মে, ২০১৯ সালে টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতালের একটি অফিশিয়াল বিবৃতিতে জানায় ভাইরাল হওয়া বার্তাটা সম্পূর্ণ ভুল। গরম নারকেল জল ক্যান্সার নিরাময় করতে পারে এর কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। ক্যান্সার সারাতে ড. রাজেন্দ্র বুড়বে এমন কোন নির্দেশনাও দেন নি। ড. রাজেন্দ্র বুড়বের সাক্ষর করা সেই বিবৃতিতে তিনি ক্যান্সার নিয়ে এই ধরনের ক্ষতিকারক বার্তা না ছড়াতে অনুরোধ করেন।

এ ব্যাপারে টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতালের আরেক পরিচালক ড. সি এস প্রামেশ (Dr C S Pramesh) বলেন “এই ধরণের বার্তা লাভের থেকে ক্ষতি বেশি করে। অনেক রোগী এসব বার্তার জন্য মূল চিকিৎসা থেকে দূরে সরে যায়। এটা দীর্ঘসময় পর বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাড়ায়।”

ভারতে ভাইরাল হওয়া ক্যান্সারের সতর্কবার্তা নিয়ে ফ্যাক্টচেক করেছে ভারতের ফ্যাক্ট চেকিং ওয়েবসাইট Factly। ১৯ মার্চ, ২০২১ সালে করা তাদের ফ্যাক্টচেক রিপোর্টে টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতালের পরিচালক ড. রাজেন্দ্র বুড়বের সাক্ষর করা বিবৃতির ছবি খুঁজে পাওয়া যায়।

 

Factly এর রিপোর্টেও ড. রাজেন্দ্র বুড়বের এমন কোন বিবৃতি কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না।

দাবি ২

২১ জুলাই, ২০২২ সালে Editorji -এর করা একটি ফ্যাক্টচেকিং রিপোর্টে ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ড. মানিশ সিংহাল (Dr. Manish Singhal) জানান “ কোন সন্দেহ নেই নারকেলের পানি শরীরের জন্য খুবই উপকারী। এটা আপনাকে হাইড্রেটেড রাখতে সহায়তা করবে। কিন্তু এটাকে গরম করে পান করলে সব ক্যান্সার ধ্বংস হয়ে যাবে, এটা সঠিক কোন তথ্য নয়। দয়া করে এমন কিছু করবেন না যা খুব উদ্ভট এবং অযৌক্তিক।”

২৮ আগস্ট, ২০১৯ সালে Boom Live “গরম নারকেল জল পান করলে ক্যান্সার কোষ মরে যায়?” শিরোনামে একটি ফ্যাক্টচেকিং রিপোর্ট প্রকাশ করে। তাদের রিপোর্টেও ভাইরাল হওয়া দাবীর স্বপক্ষে কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যায়নি।

Boom Live এর রিপোর্টে বাঙ্গালোর (Bangalore) এইচ সি জি হাসপাতালের (HCG Hospitals) ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ড. এস ভট্টাচার্য বলেন “ আমি এ ধরণের চিকিৎসার কথা শুনিনি, তাই আমি জানি না এটা সম্পূর্ণ ভূয়া কিনা। কিন্তু হ্যাঁ এই দাবীর পক্ষে বৈজ্ঞানিক প্রমাণের অভাব রয়েছে। এটা যেহেতু বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত না, তাই এই ধরণের চিকিৎসা আমি কখনো প্রেসক্রাইব করবো না।”

Boom Live এর রিপোর্ট থেকে আরও জানা যাচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৮ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী পৃথিবীতে প্রায় ৯৬ লক্ষ মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। বর্তমানে ক্যান্সারের চিকিৎসায় নির্ভুল ওষুধ, ইমিউনোথেরাপি, কেমোথেরাপি, সার্জারি, রেডিয়েশন থেরাপি, টার্গেটেড থেরাপি, হরমোন থেরাপি এবং স্টেম সেল ট্রান্সপ্ল্যান্ট পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।

২৬ এপ্রিল, ২০১৯ সালে The Quint নামক ফ্যাক্টচেকিং ওয়েবসাইট ক্যান্সার নিয়ে ছড়ানো ভুয়া বার্তাটির ফ্যাক্টচেক করেছে।  The Quint এর ফ্যাক্টচেক রিপোর্টেও গরম নারকেল জল ক্যান্সার কোষ নষ্ট করে ফেলে এই দাবির পক্ষে কোন সত্যতা পায়নি। উক্ত রিপোর্টে দিল্লির অ্যাপোলো হাসপাতালের ক্যান্সার  বিশেষজ্ঞ ড. রামেশ সারিন (Dr Ramesh Sarin) বলেন “নারকেলের টুকরো গরম জলে মিশালে তা টিউমার বা ক্যান্সারের চিকিৎসায় উপকারী হবে এমন কোনও গবেষণা এখনও পর্যন্ত হয়নি। এটি একটি মিথ, সোশ্যাল মিডিয়ায় এমন অনেক বার্তা ভাইরাল হয় যা সত্য নয়।”

 

দাবি ৩

অনিয়ন্ত্রিতভাবে কোষ বিভাজন হতে থাকলে ত্বকের নিচে মাংসের দলা বা চাকা দেখা যায়। একে টিউমার বলে। এই টিউমার কলা ভেদক ক্ষমতা সম্পন্ন হলে তাকে ম্যালিগন্যান্ট টিউমার বা ক্যান্সার বলে।

Punch এর একটি নিবন্ধ থেকে জানা যাচ্ছে নারকেলের তেল অথবা নারকেলের দুধ আলসার উপশম করতে পারে।

তবে ফুটানো গরম নারকেলের জল আলসার এবং টিউমার উপশম করতে পারে এমন কোন তথ্য কোথাও পাওয়া যায়নি।


দাবি ৪

Bistro MD এর একটি নিবন্ধ থেকে জানা যাচ্ছে নারকেলে পলিফেনলিক যৌগ যেমন গ্যালিক এসিড প্রদাহ কমানোর জন্য দ্বায়ী। নারকেলের তেল রক্ত জমাট বাধায়ও বাধা দেয়।

থ্রম্বোসিস হলো রক্তনালীর ভিতর রক্ত জমাট বেঁধে রক্ত চলাচলের পথে বাঁধা সৃষ্টি করে কখনো কখনো বন্ধ করে দেয়। যেহেতু নারকেল রক্ত জমাট বাঁধায় বাধা দেয় তাই এটা থ্রম্বোসিসেরও প্রতিকার করবে। নারকেলের তেল রক্তচাপ নামিয়ে আনতেও সহায়তা করে।

অর্থাৎ, ভাইরাল পোস্টের এই দাবিটি সত্য।

ক্যান্সার প্রতিরোধে নারকেলের কি কোনো ভূমিকা আছে ?

The Quint এর রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে গরম নারকেল জল ক্যান্সারের কোষ নষ্ট করতে না পারলেও, নারকেলের অনেক স্বাস্থ্যগত উপকারিতা রয়েছে।

FIT এর নিবন্ধ মতে নারকেলের তেল এমন একটি খাবার যা ভাইরাস, ব্যাক্টেরিয়া এবং ইনফেকশন থেকে সুরক্ষা দিতে পারে এবং গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি শোষণে সাহায্য করে।

FIT এর আরেকটি নিবন্ধ মতে, ডাবের জলে কোলেস্টেরল কমানো, বিপাকীয় শক্তি বৃদ্ধি (boosting metabolism), কিডনির কার্যকারিতা উন্নত করা, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখাসহ বেশ কিছু স্বাস্থ্য উপকারিতা রয়েছে।

 

ভিয়েতনামের ভিনমেক সেন্টাল পার্ক হাসপাতালের অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে গরম নারকেলের পানির উপকারিতা নিয়ে একটি নিবন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। সেখানে বলা হচ্ছে গবেষণায় প্রমাণ পাওয়া গেছে গরম নারকেল জল পান করলে এটি শরীরে একটি সতেজ প্রভাব ফেলে এবং শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ করে, যা অনেক স্বাস্থ্য সমস্যাকে নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়তা করে। নারকেল জলে প্রচুর পরিমাণে সাইটোকিনিন থাকে – উদ্ভিদ হরমোনের একটি গ্রুপ (ডাইহাইড্রোজেটিন, কাইনটিন, ট্রান্স-জেটিন, জিবেরেলিন সহ)। এই পদার্থগুলিতে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, অ্যান্টিকোয়াগুল্যান্ট রয়েছে, যা বার্ধক্য প্রক্রিয়া ধীর করে এবং ক্যান্সারের ঝুঁকির কারণগুলিকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রতিরোধ করে।

৩১ আগস্ট, ২০২২ সালে ফ্যাক্টওয়াচে “চিনিমুক্ত খাদ্যাভ্যাস,গরম পানি, লেবু বা নারকেল তেল কি ক্যান্সার ঠেকাতে পারে?” শিরোনামে একটি ফ্যাক্টচেকিং রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়। উক্ত রিপোর্টে নারকেলের তেল ক্যান্সার সারাতে পারে কিনা এ ব্যাপারে লেখা হয়েছে। সেই প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে , ২০১৪ সালে মেডিকেল সায়েন্স অফ ইউনিভার্সিটি সাইন্স মালয়েশিয়া বিশুদ্ধ নারকেল তেল স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীদের কাজে লাগে কিনা এই বিষয়ে একটা গবেষণা করে। গবেষণায় দেখা যায় বিশুদ্ধ নারকেল তেল গবেষণায় অংশগ্রহণকারী স্বেচ্ছাসেবকদের জীবনমান উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছে এবং ক্যান্সারের পার্শ্বপতিক্রিয়াও অনেকাংশে কমে।

২০১৭ সালে ইটালির ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালাব্রিয়া এর ফার্মেসি ডিপার্টমেন্টের একটি গবেষণায় জানা যাচ্ছে নারকেলে থাকা লাউরিক এসিড বিশেষ কিছু ক্যান্সারের কোষের বৃদ্ধিকে প্রতিহত করতে পারে। তবে এ বিষয়ে আরো বিস্তর গবেষণার প্রয়োজন আছে।

তবে এটা গুরুত্বপূর্ণ যে নারকেল বা স্বাস্থ্যকর খাবার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে এবং নির্দিষ্ট  পরিমাণ পর্যন্ত একটি স্বাস্থ্যকর জীবনধারা তৈরিতে সাহায্য করে। কিন্তু শুধুমাত্র একটি খাবার মারাত্মক কোন রোগের চিকিৎসা করতে পারে না। ক্যান্সারের মতো মারাত্মক রোগের জন্য সঠিক চিকিৎসা নেয়া উচিত।

 

সারমর্ম

নারকেলের ফুটানো গরম জল ক্যান্সারের কোষ ধ্বংস করতে পারে এমন কোন প্রমাণ কোন বিশ্বাসযোগ্য উৎস থেকে পাওয়া যায়নি। তাছাড়া এই পরামর্শটি টাটা মেমোরিয়াল হসপিটালের পরিচালক ড. রাজেন্দ্র বুড়বের নামে নামে ভাইরাল পোস্টগুলোতে ছড়ানো হচ্ছে। কিন্তু ড. রাজেন্দ্র বুড়বে তার একটি বিবৃতির মাধ্যমে স্পষ্ট করেন এমন কোন পরামর্শ তিনি দেননি। তিনি এ ধরণের ভুল বার্তা না ছড়ানোরও পরামর্শ দেন। ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া পোস্টে আরো বলা হয়েছে ফুটানো নারকেলের জল আলসার এবং টিউমার নষ্ট করে। তবে ফুটানো গরম নারকেলের জল আলসার এবং টিউমার উপশম করতে পারে এমন কোন তথ্য কোথাও পাওয়া যায়নি।

তবে নারকেলের এ্যমিনো এসিডের পলিফেনল উচ্চ রক্তচাপ কমায়, রক্তে দানা বাঁধতে দেয় না এবং থ্রম্বসিস থেকে রক্ষা করে — এই দাবির পক্ষে সত্যতা খুঁজে পাওয়া গেছে।

অর্থাৎ ফেসবুক পোস্টে দাবি করা ৪ টা তথ্যের মধ্যে ৩ টি ভুল এবং ১ টা সঠিক তথ্য দেওয়া হয়েছে । তাই ফ্যাক্টওয়াচ এ পোস্টগুলোকে ‘আংশিক মিথ্যা’ তথ্য হিসেবে চিহ্নিত করছে।

আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন?
কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন?
নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?

এসবের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে জানান।
আমাদেরকে ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh